ঢাকা, শনিবার   ২৬ অক্টোবর ২০২৪

২১ আগস্ট ট্রাজেডি

ভালো নেই নিহতের পরিবার, শরীরে স্প্রিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন আহতদের

কালকিনি (মাদারীপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১০:৫৩, ২১ আগস্ট ২০২৩

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার মহসমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় কালকিনি উপজেলায় নিহতের পরিবারের সদস্যরা ভাল নেই। এসব পরিবারে শোকের ছায়া এখনও কাটেনি। একই ঘটনায় আহতরা শরীরে স্প্রিন্টার নিয়ে পঙ্গু হয়ে দুঃসহ জীবন-যাপন করছেন। এখনও তাদের সে দিনের নারকীয় স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। 

দীর্ঘ ১৯ বছর অতিবাহিত হলেও সে দিনের দু:সহ স্মৃতি আজও কষ্ট দেয় স্বজনদের। ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে নিহত ও আহত পরিবারগুলো প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত দুই থেকে দশ লাখ টাকা অনুদান পেলেও এলাকার কেউ আর তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

কালকিনি পৌর এলাকার চরঝাউতলা গ্রামের সাইদুল ২১ আগস্ট ঢাকা পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাসমাবেশে গ্রেনেট হামলার শিকার হয়ে চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিল সে। প্রধানমন্ত্রীর অনুদান পেয়ে সে ডিশ ব্যবসা করতে নামেন কিন্তু এলাকার প্রভাবশালীদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে সেই ব্যবসাও লাটে বসেছে। 

২০১৩ সাথে জীবনকে পরিবর্তন করবার জন্য বাড়ির জমি বিক্রি করে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে ওমান যান। পরিশ্রমের কাজ করতে না পারায় ৮ মাস পর তাকে ফিরে আসতে হয় দেশে। সে জানায়, ৮ মাসে সে ৫০ হাজার টাকাও উপার্জন করতে পারেননি। উপরন্তু ফিরে আসবার সময় বাড়ি থেকে ২০ হাজার টাকা তাকে নিতে হয়েছে।

চোখ হারিয়ে এখন সে প্রতিবন্ধী। বর্তমানে তিনি চায়ের দোকান দিয়ে কোন মতে চলে তার সংসার। কিন্তু সাইদুল বর্তমানে অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পরেছেন। সাইদুলের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চরঝাউতলা গ্রামের মো. অহেদ সরদারের ছেলে মো. সাইদুল সরদার (৩০)। তার বয়স ৫ বছর থাকতে মা মুঞ্জু বেগমকে হারায়। এরপর সে পড়ালেখা ছেড়ে সাইদুল অন্যের জমিতে কাজ করেন। কিন্তু ২০০৪ সালে ২১ আগষ্ট পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহা-সমাবেশে সেই ভয়াবহ গ্রেনেট হামলায় তিনি তার চোখের দৃষ্টি হারায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। 

সেখান থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সাইদুলের বর্তমানে স্ত্রী, দুই সন্তান, ৩ ভাই, ১ বোন নিয়ে সংসার চলছে খুব কষ্টে। তার পিতা বিভিন্ন রোগ শোকে কাতর হয়ে ৩ বছর আগে মারা যান।

বর্বরোচিত এ গ্রেনেড হামলায় নিহত কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামের শ্রমিক নেতা নাসির উদ্দিন ছিল আওয়ামী লীগের একজন অন্ধ ভক্ত। তাই আওয়ামী লীগের মিছিল, মিটিং বা সমাবেশ হলে তাকে কেউ বেঁধে রাখতে পারতো না। মিছিল-মিটিংয়ের আগে থাকতো, স্লোগান দিত। শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেই প্রতিবাদী কণ্ঠ আর শোনা যাবে না।

নাসিরের বড় ছেলে মাহাবুব হোসেন (২১) জানান, বাবার উপার্জনেই চলতো সংসার। বাবার মৃত্যুর পর টাকার অভাবে আমাদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন কোনদিন আধপেট আবার কোনদিন খাবারই জোটেনি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এখন সেই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে আমার মা, আমি আর আমার ভাই নাজমুলকে নিয়ে কোনরকম বেঁচে আছি। এ ছাড়া আমাদের খবর আর কেউ রাখেনি।

গ্রেনেড হামালায় নিহত যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহাম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর। সে বরিশালের মুলাদি নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। এ কারণেই তার লাশ মুলাদিতেই দাফন করা হয়। কথা হয় সেন্টুর স্ত্রী আইরিন সুলতানার সাথে। তিনি ঢাকার মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। এক মেয়ে আফসানা আহমেদ রীদিকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। 
তিনি বলেন, এমন দু:খজনক স্মৃতি কি ভোলা যায়, না মুছে যায়। মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিলাম। সে সম্বল আর চাকরি থেকে যা পাই, তা দিয়েই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। তিনি ঢাকায় একা থাকেন, মহিলা মানুষের একা থাকা বিড়ম্বনা উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যদি মৃতদের পরিবারের জন্য একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে উপকৃত হতাম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কালকিনি পৌরসভার বিভাগদি গ্রামের মোহাম্মদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিলেন হালান। এখন সে ঢাকা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কাঁচা মালের ব্যবসা করেন। হালানের সাথে কথা হলে সে বলে, খোড়া পা নিয়ে কষ্ট হয় ঘুরে ঘুরে কাঁচা মাল বিক্রি করি। তাছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ স্প্রিন্টার। জ্বালা-যন্ত্রণায় অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে। সে কারণে তেমন আয়ও করতে পারি না। স্ত্রী ও এক ছেলেকে গ্রামের বাড়িতেই রাখতে হয়েছে। 

হালান জানান, সরকার যদি কোন একটা চাকরি দিতেন, যাতে এরকম শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে না, তাছাড়া আমার চিকিৎসারও প্রয়োজন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে স্প্রিন্টার আছে। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। সরকার সাহায্য করলে ভাল হতো।

কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেনের ডানহাত স্প্রিন্টারের আঘাতে বাঁকা হয়ে গেছে। বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬। উপার্জন করে শুধু কবির। অনেকেই অনেক টাকা পেলেও কবির পেয়েছিল এক লাখ বিশ হাজার টাকা। কবির জানান, ঘটনার পর আমি ৩ বৎসর ভীষণ অসুস্থ ছিলাম। বাড়ির জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে আমার ৪-৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু শরীরে এখনও স্প্রিন্টার রয়ে গেছে। যার যন্ত্রণায় এখনও ঘুম আসে না। আামার পরিবার এখন অন্যের জায়গায় বাস করে। সব হারিয়ে এখন আমি নি:স্ব। কোন রকম জীবন চলছে। সরকার যদি একটু সু’নজর দিত, একটু চিকিৎসা করাতো হয়তো বাকি জীবন পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন কাটাতে পারতাম।

প্রত্যেকের স্মৃতিতে সেদিনের নারকীয় দৃশ্য আতঙ্ক হয়ে আছে। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে এরা দিন দিন পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে গিয়ে সুচিকিৎসার সামর্থ্য এদের নেই। সবারই অভিযোগ, স্থানীয়ভাবে তাদের কেউ খোঁজ রাখেনি।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি