ঢাকা, শনিবার   ২৩ আগস্ট ২০২৫

ভারতে লাগে ২৫ রুপি

বিসিএস আবেদনে ফি ৭০০ টাকা কেন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:০১, ১১ জুলাই ২০১৭ | আপডেট: ১৭:০৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

Ekushey Television Ltd.

দেশের চাকরির বাজারে বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)-ক্যাডার পদের চাকরিগুলোকেই সবচেয়ে ‘এলিট’ চাকরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনপ্রশাসনে যুক্ত থেকে দেশের কাজে সরাসরি অবদান রাখার সুযোগ, সামাজিক মর্যাদা, চাকরির নিরাপত্তা, চাকরিজীবন শেষে পেনশন সুবিধা এবং অন্য আনুষঙ্গিক দিক বিবেচনায় রেখেই ক্যাডার সার্ভিসের চাকরিগুলো এখন তরুণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।  আর তাই দেশের চাকরি প্রত্যাশীদের  বড় একটি অংশ ক্যারিয়ার হিসেবে বিসিএসকে পছন্দের তালিকার শীর্ষে স্থান দেন।

৩৮ তম বিসিএসের সার্কুলার জারির পর গতকাল সোমবার থেকে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই  আবেদনের ক্ষেত্রে প্রতি শিক্ষার্থীদের ৭০০ টাকা ফি গুনতে হচ্ছে। আবেদনকারীদের বেশিরভাগই তরুণ বেকার। বেকার জীবনের ঘানি টেনে চাকরির আবেদন করতে গিয়ে এই টাকা দিয়ে আবেদন করা অনেকের জন্যই কষ্টকর।

চাকরি প্রার্থীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার ফি বাতিল করেছে। এখন রাষ্ট্রায়ত্ব কিংবা বেসরকারি কোনো ব্যাংকেই আবেদন করতে টাকা লাগে না। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠানে (পিএসসি) আবেদনের ক্ষেত্রে প্রতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৭০০ করে  টাকা নেওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন দেশের চাকরি প্রত্যাশী তরুণেরা। তাদের প্রশ্ন ব্যাংকে আবেদনে টাকা লাগে না, তবে বিসিএসে কেন? পিএসসির মাধ্যমে প্রতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এত টাকা নিয়ে কী করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়? এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতের সিভিল সার্ভিসে আবেদন করতেও ফি নেয়া হচ্ছে নামেমাত্র।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে পিএসসি ৭০০ টাকা ফি নেয়া অযৌক্তিক। গ্রাজুয়েশন শেষ করার থেকে চাকরিতে প্রবেশের সময়টুকু প্রতিটি শিক্ষার্থীদের জন্যই কষ্টের। এই সময়টাতে অনেকেই অর্থকষ্টে ভোগেন। এসময় বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে ফি যোগার করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের এই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিসিএসে আবেদনের ফি ৭০০ টাকা থেকে কমিয়ে আনা উচিত। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন সনি পিটার পেরেইরা। একাডেমিক পড়াশুনা শেষে এখন প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ৩৭তম বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণও করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একাডেমি ডিগ্রি নেয়ার পর চাকরির জন্য আরও কমপক্ষে দুই বছর প্রস্তুতি নিতে হয়। মাস্টার্স পাশ করার পর পরিবার থেকে টাকা আনার মতো অবস্থা আমাদের অনেকেরই থাকে না। অন্য দিকে পরিবারের প্রত্যাশা থাকে পড়ালেখা শেষ, সন্তান এখন চাকরিতে প্রবেশ করবে। কষ্ট করে আর টাকা পয়সা দিতে হবে না। এমতাবস্থায় বিসিএসে আবদনের ক্ষেত্রে ৭০০ টাকা দিতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়। এছাড়া পরিবার থেকে আরও একটি কথা শুনতে হয় যে, ‘চাকরি হতে আর কত দিন লাগবে’। একজন বেকারের কাছে এগুলো খুবই কষ্টের!’

 একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্প্রতি পাশ করা মোহাম্মদ নাহিদ হাসান আক্ষেপ করে বলেন, ‘পড়াশুনা শেষ করে চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টা শিক্ষার্থীদের জন্য সব থেকে ‘কঠিন ও বাজে’ সময়। এ সময় পকেটে না থাকে হাত খরচের টাকা, না থাকে উপার্জনের কোনো সুযোগ। অথচ এই সময়েই সরকারি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন পরিমাণে ফি দিতে  হচ্ছে। পিএসসি- এর মত সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমাদের মত অসহায় বেকারদের কাছ থেকে এত টাকা নেওয়া সত্যি দুঃখজনক।’

ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী নাসমারি আক্তার মলি বলেন,  ‘বিসিএসের একটা আবেদনের ক্ষেত্রে ৭০০ টাকার পাশাপাশি কিছু চার্জ কাটে। কম্পিউটারের (সাইবার সেন্টার) দোকান থেকে আবেদন করতে গেলে প্রতিটি আবেদন বাবদ আরও কিছু টাকা খরচ হয়। বলতে গেলে আবেদন করতে প্রায় এক হাজার টাকাই খরচ হয়ে যায়। এত আবেদনকারীর ভিড়ে চাকরি যে হবে, তারও কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নাই।’

সরকারি কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী নয়ন আহমেদ বলেন, ‘চাকরির জন্য ব্যাংকে আবেদন করতে টাকা লাগে না। অথচ পিএসসি সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও আবেদনের ক্ষেত্রে ফি বাবদ এত টাকা নেয়। এটা অন্যায়, মেনে নেয়া কঠিন।’

ফরিদপুর সরকারি ইয়াসিন কলেজের শিক্ষার্থী জাসিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিমাসে বিভিন্ন চাকরির আবেদনের জন্য সর্বনিন্ম খরচ হয় দু’হাজার টাকা। এছাড়া থাকা খাওয়া বাবদ আরও খরচ আছে। একজন কৃষক বা স্বল্প বেতনধারী পিতার পক্ষে বেকার সন্তানের এত খরচ দেওয়া সম্ভব হয় না। তবুও তারা ধার দেনা করে, জমি বন্ধক দিয়ে এই খরচ যোগান দেন। প্রত্যাশা থাকে পড়ালেখা শেষেই ছেলে চাকরি পেয়ে যাবে। তখন সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। কিন্তু চাকরির বাজারের যে অবস্থা তাতে দুই তিন বছর চেষ্টা করেও চাকরি হচ্ছে না। এমতাবস্থায় সরকারি চাকরিতে এত ফি নেয়া ‘মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ এর মত’।’ বেকারদের কাছ থেকে আবেদন ফি না নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত আবেদন জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, নিয়োগদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তো  বিভিন্ন আয়ের উৎস আছে। কিন্তু বেকারদের তো কোনো আয়ের উৎস নেই। অনেক বেকার লজ্জায় বাবার কাছে টাকা চায় না। কিন্তু এদের কত বেলা না খেয়ে কাটে! না খেয়েও আবেদনের টাকা দিতে হয়। এই কষ্ট কী কেউ বুঝবেন?’

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি চাকরির অবেদনের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোতে আবেদনের ক্ষেত্রে ফি লাগে না, লাগলেও নামেমাত্র। এমনকি  আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিসে আবেদনের ক্ষেত্রেও শিথীলতা আছে। দেশটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি চাকরিতে জনবল নিয়োগ করে থাকে ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে আবেদন বাবদ ফি নেওয়া হয় মাত্র ২৫ রুপি (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩২ টাকা)। পৃথিবীতে বাংলাদেশই সম্ভবত সরকারি চাকরির আবেদনে এত বেশি টাকা ফি নিয়ে বিরল(!) দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আগে বিসিএসে আবেদন করতে ৫০০ টাকা ফি লাগলেও পিএসসি ৩৬তম বিসিএস থেকে তা বাড়িয়ে সাতশ’ টাকা করে নিচ্ছে। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সূত্র মতে, সর্বশেষ ৩৭ তম বিসিএসে এক হাজার ২২৬ টি শূন্য পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা  হয়। এই পদের বিপরীত আবেদন জমা পড়ে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬ টি। প্রতি পদে আবেদনে ফি সাতশ’ টাকা ধরে হিসাব করলে দেখা যায়,  ১৭ কোটি চার লাখ ৩৩ হাজার দুইশ’ টাকা চাকরি প্রার্থীদের পকেট কেটে বের করে নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক মুঠোফোনে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘প্রার্থীদের কাছ থেকে বিসিএস পরীক্ষার আবেদনের ফি বাবদ যে টাকা নেওয়া হয় তা আসলে পিএসসি পায় না। সম্পূর্ণ টাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার নিয়ে নেয়। পরীক্ষা সংক্রান্ত খরচের জন্য মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে কমিশনকে টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রার্থীদের আবেদনের টাকা পিএসসির সরাসরি খরচ করার কোনো এখতিয়ার নেই।

 তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয় কশিনকে পরীক্ষার খরচের জন্য যে টাকা দেয় তা যতসামন্য। পরীক্ষার কেন্দ্রে যারা দায়িত্ব পালন করেন, যে পরীক্ষককে দিয়ে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ণ করানো হয়, ভাইবা বোর্ডে যাদেরকে নিয়ে আসি তাদেরকে যথাযথ সম্মানি দিতে পারি না।’

চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলো কোনো ধরনের ফি নিচ্ছে না। বেকার চাকরি প্রার্থীদের আর্থিক দিক বিচেনায় পিএসসি এ ধরনের অথবা নামেমাত্র ফি দিয়ে আবেদনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে করেছে, তা আমার জানা নেই। পিএসসিতেও আগে এ ধরনের কোনো নিয়ম বা উদ্যোগ ছিলো না। তবে প্রার্থীদের বেকার জীবনের কথা বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করবো। যাতে আবেদনের ফি কমানো হয়।’

এ বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা ১০ মিনিটে তার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি সাড়া দেননি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি।

বিসিএস ক্যাডার ও নন ক্যাডার পরীক্ষার ফি নামেমাত্র নেয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে টেলিফোনে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব আয় রয়েছে। পিএসসির সে রকম কোনো আয় নেই। এ বিষয়ে কিছু করতে হলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে করতে হবে। এখানে পিএসসির নিজস্ব কোনো এখতিয়ার নেই। তবে একেবারে ফ্রি করে দিলে কিছু সমস্যাও আছে। তখন দেখা যাবে কোনো প্রার্থী পরীক্ষা দিবে না কিন্তু আবেদন করে বসে আছে। পিএসসির কিন্তু প্রত্যেক আবেদনকারীর জন্য একটি প্রশ্ন ও আসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই আমার বক্তব্য হচ্ছে আবেদনের ফি একেবারে ফ্রি না করে নমিনাল (নামেমাত্র) একটা ফি রাখা যেতে পারে।’

চাকরি প্রার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে আবেদন ফি কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও। তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘একজন গ্রাজুয়েটের পড়ালেখা শেষ করার পর চাকরিতে প্রবেশ করার সময়টুকু বেশ কষ্ট করতে হয়। এই সময়টাতে অনেকেই অর্থকষ্টে ভোগেন। এসময় বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে ফি এর টাকা ম্যানেজ করা তাদের জন্য কষ্টের।  তাদের এই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিসিএসে আবেদনের ফি ৭০০ টাকা থেকে কমিয়ে আনা উচিত। সরকার ও পিএসসি এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে।’ 

//এআর


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি