ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪

সঙ্গীত জগতকে যেমন দেখতে চেয়েছিলেন সুবীর নন্দী [ভিডিও]

প্রকাশিত : ১৪:১৩, ৮ মে ২০১৯ | আপডেট: ২১:০৪, ৮ মে ২০১৯

আশি এবং নব্বই দশকে ঢাকার চলচ্চিত্রে তার গান তাকে দারুণ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীত জীবনে রেডিও, টিভি এবং চলচ্চিত্রে আড়াই হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন সুবীর নন্দী। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গতকাল মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

যারা অসীম পৃথিবীকে সুন্দরের আলোয় আলোকিত করতে, যারা তাদের কর্মে-সৃষ্টিতে –ত্যাগে –মহিমায় সাধারণ আমিকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেন একেকজন উজ্জল নক্ষত্র তাদের মধ্যে একজন হলেন সুবীর নন্দী। মৃত্যুর আগে জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী অতিথি হয়ে এসেছিলেন একুশে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ‘অতঃপর আমি’তে।

আসলে প্রচলিত একটা কথা, যারা জাতশিল্পী তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু আলাদা হন, একটু খেয়ালি হন- এই কথাটা সুবীর নন্দীর ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য?

এ বিষয়ে ওই অনুষ্ঠানে সুবীর নন্দী বলেন, আমি নিজেকে একেবারে সাধারণ মানুষের মতোই মনে করি; খুব একটা অসাধারণ মনে করি না। আমার কাছের মানুষদের কেউ কেউ বলেন, আমাকে খুব ভালো লাগে। কারণ আমি নিজেকে আলাদাভাবে ভাবি না। অনেকেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন এটা খুবই ভালো। আমাকে অনেকেই তারিফ করেন।

‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নিজেকে অসাধারণ ভাবার কিছু নেই। কারণ পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষকেই আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়। অনেক মানুষকে দেখি যেটা আমি পারি না কিন্তু উনি পারেন।’

‘ছেলেবেলায় ডানপিটে ছিলাম। আমার জন্ম চা বাগানে। জন্ম যেহেতু চা বাগানে তো একটু পাহাড়ি ভাব ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে একটা চমৎকার মেলামেশা ছিল। আমাদের বয়স যখন ৭/৮ বছর ছিল, তখন পাহাড়ের উপর থেকে যে ছড়া সেখানে বৃষ্টি হলে প্রচণ্ড পানি আসতো। তারপর আমরা সেখানে জাম্প করতাম।’

তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমাদের ছকে বাধা জীবন, এই সময়টুকু, ওই সময়টুকু…। আমার বাবা চা বাগানের ডাক্তার ছিলেন। আর মা গৃহিনী ছিলেন। আমরা ৬ ভাই ৩ বোন। আমি হলাম ৪ নম্বরে।’

গানের চর্চা বিষয়ে বিশিষ্ট এই সঙ্গীত শিল্পী বলেন, আমার মায়ের বাড়িতে গান-বাজনার চর্চা ছিল। আর বাবা গান না গাইলেও তার কাছে গানের অনেক কালেকশন ছিল। সেগুলো শুনতাম। আর আমরা সব ভাই বোনেরা সন্ধ্যা বেলায় এক সঙ্গে গান গাইতাম। গান গাওয়ার সাধটা ওখান থেকেই। বাড়িতে একটা পরিবেশ ছিল। আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই কুমার নন্দী বলেছেন, ওই সময় থেকেই খুব কঠিন কঠিন গান নাকি আমার পছন্দের ছিল।

‘আমরা বলি শুনার মধ্যে অর্ধেক আর শেখার মধ্যে অর্ধেক। তো ওই জিনিসটা আমাদের বাড়ির মধ্যে ছিল। সব জায়গায় একটা ডিসিপ্লিন ছিল। যে যেই প্রফেশনে থাকুন না কেন ডিসিপ্লিনটা অনেক বড় জিনিস।’

‘লেখাপড়ায় আমি খুব ভালো ছিলাম, খুব শার্প ছিলাম। চা বাগানে আমাদের লেখা পড়ার আলাদা ব্যবস্থা ছিল। হবিগঞ্জে যখন আসি, তখন হবিগঞ্জ হাইস্কুল, বৃন্দাবন কলেজে পড়াশুনা করি। তারপরে অন্য একটি প্রফেশনে যোগদান করেছিলাম। তারপর ব্যাংকে ঢুকলাম। জনতা ব্যাংক। ২০১০ সালে ওই চাকরি থেকে অবসর নিই।’

বিশিষ্ট অভিনেত্রী শর্মীলি আহমেদ বলেন, আমার মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষই গান ভালোবাসেন। আর আমরা যারা শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত, তারা তো অবশ্যই ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকেই আমার গান ভালো লাগে। অনেকের গানে প্রাণ ছুঁয়ে যায়। সেই তালিকায় সুবীর নন্দীর নাম অবশ্যই আসে। ভীষণ বড়মাপের একজন শিল্পী। আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন শিল্পী। এতো দরদী গলা, এতো মিষ্টি করে গায়; গাওয়ার ভঙ্গি-কণ্ঠ সব মিলিয়ে অত্যন্ত মাধুর্যময়। তার সব গানই আমার ভালো লাগে। কিন্তু ‘আমর দুটি চোখ, পাথর তো নয়…’ এই গানটা যে এতো ভালো লাগে কেন যেন শুনলেই আমার চোখে পানি চলে আসে।

বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌস আরা বলেন, আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যে শিল্পীদেরকে সবচেয়ে উচ্চমানে স্থান দিয়ে থাকি, তাদের মধ্যে সুবীর নন্দী অন্যতম। যার গান আমাদের সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সুরে দৃঢ় বিচরণ; হৃদয় নিড়ানো আবেগ-যা সুবীর নন্দীর মধ্যে পাওয়া যায়। আমি নিজে একজন নজরুল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে অনেক দিনই শুনেছি, সুবীর নন্দী বলেছেন আমি কিন্তু নজরুল সঙ্গীত দিয়েই শুরু করেছিলাম আমার জীবন। সুবীর নন্দীর কণ্ঠে নজরুল সঙ্গীত অবশ্যই অনবদ্য। একজন আপাদমস্তক শিল্পী বললে যা বুঝায়, সুবীর নন্দী তাই। একজন সু গায়ক বা সু শিল্পী হিসেবে সুবীর নন্দী যথার্থই মূল্যায়ন পেয়েছেন।    

সুবীর নন্দী বলেন, ১৯৬৩ সালে আমাদের পাশে জগদীশপুর হাইস্কুলে এক বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আমার এক বড় ভাই নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন ছোট মানুষ আমি। সেখানে একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি গান করেছিলাম। সেখানে একটা বই পেয়েছিলাম। সেখানে হেডমাস্টার লিখেছিলেন বেস্ট সিংগার সুবীর নন্দী। আর প্রফেশনালি গান করি ১৯৬৭ সাল থেকে। সিলেট রেডিওতে।

জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী বলেন, স্কুলের থেকেই আমার চলাচল ছিল বৃন্দাবন কলেজে, হবিগঞ্জে। তখন ঢাকা থেকে খুব বড় বড় শিল্পীরা যেতেন বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৬৭ কথা বলি। তারা তখন আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ভালো গাইতাম বলে আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তখন আমি একটা দুইটাতে চান্স পেতাম।

তখন মূলত আমি নজরুলের গান গাইতাম আর তখন ১৯৬৭- এর যে ভারতীয় গান ছিল সেগুলো গাইতাম। আমার মনে আছে আমি প্রথম গান করেছিলাম, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব…’।

বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা ভালো ভালো কণ্ঠ পাচ্ছি, যেগুলো রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই কণ্ঠগুলো দেখা যাচ্ছে খুব অল্প সময়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সুবীর নন্দী বলেন, আমরা যে কষ্টতে ভুগছিলাম, অনেক ছেলেমেয়ে ভালো গাইতে পারলেও স্থানীয়ভাবে এরপর বাইরে আসতে পারেননি। প্রতিযোগিতাগুলো হয় কি, এটা জাতীয় পর্যায়ে তাদের নিয়ে আসা হচ্ছে; তারা একটা ভালো প্লাটফর্ম পাচ্ছে। যখন ফাইনাল হয়ে যায়, যখন তাদের ডিক্লার করা হয় ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড। এটা করার পরে যেদিন অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যায়, তখন অনুষ্ঠানটা যারা করেন তাদের দায়িত্বটা শেষ হয়ে যায়। পরের সকালটা কিন্তু সবার জন্য সমান; সেখানে তাকে প্র্যাকটিস করতে হবে। সে জায়গাটা সবাই করতে পারছেন না বলেই তারা হারিয়ে যাচ্ছেন।

সঙ্গীতশিল্পী প্রিয়াংকা গোপ বলেন, শুধু জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে বলবো না, মানুষ হিসেবে, একজন পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে উনি অনেক উচু একটি আসনে স্থান পেয়েছেন। সুবীর নন্দী একটি অবিস্মরণীয় নাম, অসাধারণ একটি নাম, যিনি তার গান দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন। এবং আমি বলবো যে, এখন গানের যে চল চলে এসেছে যে ক্লাসিক্যাল ধারার গান করলে সে জায়গায় পৌঁছানো যায় না- এটার প্রথাটা উনিই ভেঙ্গে দিয়েছেন।

চলে যাওয়ার সময় বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতকে যেখানে দেখে যেতে চেয়েছিলেন সুবীর নন্দী।

সুবীর নন্দী বলেন, আমি মনে করবো যে আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গীত যেন কখনও পৌরত্বের দিকে না যায়। মাথা তুলে যেন বলতে পারি, হ্যাঁ এটা আমার বাংলাদেশের সঙ্গীত, এটা আমার সাহিত্য, এটা আমার রাজনীতি, এটা আমার অর্থনীতি, এটা আমার সামাজিক অবস্থা, এটা আমার শিক্ষা ব্যবস্থা। এক নম্বরে চাই।

অনেক মৃত্যু দৃশ্যের গান গাওয়ার বিষয়ে সুবীর নন্দী তিনি বলেন, মৃত্যু ভয় আমার নেই। কিন্তু অপমৃত্যুর ভয় আছে। এ রকম মৃত্যু চাই না যে ধুঁকে ধুঁকে মরা।

বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী প্রশ্ন করা হয়েছিল, গান ছাড়া সুবীর নন্দীকে চিন্তাই করা যায় না। এমন কোনো গানের কথা কি মনে হয় যে আমার মৃত্যুর সময়টা যদি এ রকম হতো বা মৃত্যুর সময় যদি এই গানটা বাজতো?

সুবির নন্দী গেয়ে উঠলেন, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি ‘।

(শ্রুতিলিখন করেছেন আব্দুল করিম।)


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি