ঢাকা, শুক্রবার   ১০ মে ২০২৪

বিজেপির উত্থান সাম্প্রদায়িকতার নীল বিষ

কোন পথে ভারত?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:০৭, ২০ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১১:০৯, ২০ মার্চ ২০১৮

ভারত যে এক বিরল সন্ধিক্ষণে, তা কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক তত্পরতার বহরটা এই মুহূর্তে যে রকম, তেমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি, এমন নয়। তাই এই তত্পরতা নজিরবিহীন নয়। কিন্তু প্রথমত, এহেন রাজনৈতিক ঘনঘটার কাল বার বার আসে না, অনেক দশকের ইতিহাসে হয়ত কয়েক বার আসে। আর দ্বিতীয়ত, এ বারের রাজনৈতিক তত্পরতা তার প্রাবল্যে অন্য বেশ কয়েকটি সন্ধিক্ষণের সঙ্গে তুলনীয় হলেও, প্রকৃতপক্ষে এর মাত্রা ভিন্ন। ভারতীয় রাজনীতি তথা গণতন্ত্র যে এক বিরল সন্ধিক্ষণে উপনীত, সে কথা মানতেই হচ্ছে।

সঙ্ঘ পরিবার নামক এক শক্তির অস্তিত্ব ভারতভূমিতে দীর্ঘ দিনের। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই মূলত উদারপন্থী গণতন্ত্রের অনুশীলনে অভ্যস্ত সঙ্ঘীয় কট্টরবাদের চর্চা ভূখণ্ডে খুব সহজে শিকড় ছড়াতে পারেনি। রাজনীতির মূল স্রোতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে সঙ্ঘীয় ভাবধারাকে। এ ভাবধারার মুখমণ্ডল সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, বুঝে মুখোশের ব্যবস্থাও করতে হয়েছে সমান্তরাল ভাবে। এক দিকে ধর্মীয় কট্টরবাদ, অন্য দিকে আর্থ-সামাজিক উদারপন্থা, এক দিকে আডবাণীর উগ্র রামরথযাত্রা, অন্য দিকে বাজপেয়ীর উদার মানবতাবাদী কণ্ঠস্বর, এক দিকে মোহন ভাগবতের কণ্ঠে একরঙা সনাতনী ভাবধারার জীবনের পক্ষে জোর সওয়াল, অন্য দিকে বৈচিত্রে ভরপুর ভারতীয় সমাজের নানা রঙে রং মেলানোর চেষ্টা সঙ্ঘ প্রচারকদের, এক দিকে গুজরাত দাঙ্গার মতো মধ্যযুগীয় কালিমা, অন্য দিকে, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ নামক আধুনিক স্লোগান— এমনই নানা সমান্তরাল ব্যবস্থাপনাকে সামনে রেখে এগিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। এবং সেই সঙ্ঘীয় ভাবধারা প্রসূত বিজেপি আজ সঙ্ঘের ইতিহাসে তথা নিজের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী সাফল্যে সওয়ার হয়ে দিল্লির মসনদে আসীন।

সঙ্ঘ তথা বিজেপির এই বিপুল উত্থান স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে নজিরবিহীন তো বটেই। সেই বিপুল নির্বাচনী উত্থান নিজের প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই সঙ্ঘ বিরোধী প্রায় সবক’টি রাজনৈতিক ভাবধারা যে ভাবে এক ছাতার তলায় বা এক মঞ্চে সমন্বিত হতে উদগ্রীব, সে ছবিও এ দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পরে বেশ কয়েক দশক ভারতীয় রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিল কংগ্রেসই। সেই কংগ্রেসে ইন্দিরা গাঁধী জমানার শুরুতে অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন দেখা গিয়েছে বিস্তর। দল ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। সে কালের নিরিখে ইন্দিরা বনাম নিজলিঙ্গাপ্পা-মোরারজিদের সেই লড়াই রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণই ছিল বটে।


উত্তাল সত্তরের দশকও ছিল আর এক সন্ধিক্ষণ। ভারত-পাক যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, দেশে নকশাল ভাবধারার উত্থান, জরুরি অবস্থা, জয়প্রকাশ নারায়ণ, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে দেশজোড়ে বিপুল রাজনৈতিক ঐক্য, দেশে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার গঠিত হওয়া— সে ঘটনাপ্রবাহ অভূপূর্বই ছিল সে সময়। আশির দশকের শেষ দিকে দেশ দেখেছে রাজীব বিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য। বফর্স কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে আয়োজিত হয়েছিল সেই সমীকরণ।

আর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় দু’দশক এ দেশ দেখছে জোট রাজনীতির যুগ। জাতীয় স্তরে জোট সরকার বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছিল সে দু’দশকে। এমন বৈচিত্রপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাসকে পিছনে রেখে শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদীদের যুগ। এ যুগে জোট রয়েছে, কিন্তু প্রধান শাসক দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং দোর্দণ্ড প্রতাপে শরিক দল, বিরোধী দল, নিরপেক্ষ দল— সকলেই খানিক অপ্রাসঙ্গিক বা হীনবল হয়ে পড়ছে যেন।

মোদীদের এই প্রবল প্রতাপের কাল আর প্রলম্বিত হতে দিতে চায় না দেশের রাজনৈতিক শিবিরের একটা বড় অংশ। কংগ্রেস যে বিজেপি বিরোধিতায় বড় ভূমিকা নেবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু কংগ্রেস ছাড়াও আরও অনেক রাজ্য দল, আঞ্চলিক দল জোটবদ্ধ হচ্ছে। যারা শুরু থেকেই বিজেপি বিরোধী ছিল, শুধু তারা নয়, বিজেপির অনেক শরিক দলও বিরোধী মঞ্চে হাজির হওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। নতুন যুগের সূচনা ত্বরান্বিত করতে চায় এই দলগুলো।

কলকাতায় বৈঠক হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের। বৈঠক শেষে দু’জনেই জানালেন, ভারতের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে গড়ে উঠছে নতুন ফ্রন্ট। এ সবের ফাঁকেই চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে ফোনে কথা হল মমতার। আবার শরদ পওয়ারের দলের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে বিভিন্ন দলকে নিয়ে বৈঠক আয়োজন করছেন পওয়ার।

বিজেপির সর্বাত্মক বিরোধিতায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে হবে— প্লেনারি অধিবেশনের মঞ্চ থেকে দলকে বার্তা দিচ্ছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী। কতটা চড়া হবে আক্রমণের সুর, নিজেই দেখিয়ে দিচ্ছেন সে নমুনা। সনিয়া গাঁধী উদ্যোগী হচ্ছেন কংগ্রেসকে ঘিরে সহযোগী দলগুলির একটি বলয় তৈরি করতে। বিরোধী শিবিরে যখন এমন মরিয়া লড়াইয়ের ডাক, তখন এনডিএ-র অন্দরমহলেও উথাল-পাথাল। একের পর এক শরিক অবহেলা-অবজ্ঞার অভিযোগ তুলতে শুরু করে দিচ্ছে, কোনও শরিক জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শিবসেনা জানাচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে আসন সমঝোতা হবে না। নীতীশ কুমার, রামবিলাস পাসওয়ান, ওমপ্রকাশ রাজভড়রাও একে একে মুখ খুলছেন। বিজেপি কী করলে জোট বহাল থাকতে পারে, সে নিয়ে বেশি কথা বলছেন না তাঁরা। কেন জোট ভেঙে দেওয়া উচিত, তার উপরেই বেশি করে আলোকপাত করছেন।

বিজেপির বিরুদ্ধে এই প্রবল রাজনৈতিক তত্পরতা কিন্তু অবশ্যই ভারতীয় রাজনীতিতে এক নয়া সন্ধিক্ষণ। যাবতীয় বিরোধিতা দূরে ঠেলে ক্ষমতার উপরে নিজের কর্তৃত্ব আরও সুদৃঢ় করবেন মোদী? নাকি সঙ্ঘের প্রবল প্রতাপের শেষের শুরু এখান থেকেই? এই দুই প্রশ্ন আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে এই সন্ধিস্থলে। উত্তরটাই নির্ধারণ করে দেবে ভারতীয় রাজনীতির পরবর্তী অভিমুখ।

সূত্র: আনন্দবাজার
এমজে/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি