বিডিআর বিদ্রোহ
ভেতরের ও বাইরের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে: হাইকোর্ট
প্রকাশিত : ১৬:৪৩, ২৭ নভেম্বর ২০১৭

তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে ভেতরের ও বাইরের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে পর্যবেক্ষণে বলেছে আদালত। আদালত বলছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে গণতন্ত্র ধ্বংস করাই ছিল বিদ্রোহের অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে এ কখা বলা হয়। সোমবার সকাল ১০টা ৫৩ মিনিটে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার রায় পড়া শুরু করেন। সেখানে তিনি এই পর্যবেক্ষণের কথা বলেন।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তথ্য দিতে গোয়েন্দারা কেন ব্যর্থ হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আলোচিত এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণ দেওয়ার সময় সাত দফা সুপারিশও দেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) হাইকোর্ট বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী।
সুপারিশে আদালত বলেছে, কোনোরকম ষড়যন্ত্র ছাড়া এত বড় হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে না। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে বিপদে ফেলা এবং রাজনৈতিক সংকট তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল।
আদালতের দেওয়া সাত দফা সুপারিশ হলো -
অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচিতে বিডিআরের মতো এ ধরনের ফোর্সকে যুক্ত করা উচিত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে এ জাতীয় কর্মসূচি যেন আর না নেওয়া হয়।
বিজিবি আইন অনুযায়ী বাহিনীতে সৈনিক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব বজায় রাখা উচিত। এ জন্য অনেক সময় অভ্যন্তরীণ মতবিনিময়ের আয়োজন করা যেতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি-দাওয়া পাঠানো হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা নিরসন করা হয়নি। তাই ভবিষ্যতে দাবি-দাওয়া থাকলে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
বাহিনীর সদস্যদের কোনো সমস্যা থাকলে তা বিজিবির মহাপরিচালক সমাধান করবেন।
যদি তাদের কোনো পাওনা থাকে, সেটিও দ্রুত সমাধান করতে হবে।
যেকোনো সমস্যা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার আগাম তথ্য দিতে গোয়েন্দারা কেন ব্যর্থ হয়েছে, সেটিও খুঁজে বের করা উচিত।
এর আগে আদালত বলেন, ‘এখানে কোনো সেনা অফিসার থাকবে না, এটাই ছিল মূল মেসেজ। পৃথিবীর অনেক দেশ মৃত্যুদণ্ডকে অনুৎসাহিত করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এটার বিরোধিতা করছেন। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ড এত জঘন্য ছিল যে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। এ বিচার দেশের জন্য নজির হয়ে থাকবে।’
এ ছাড়া সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, এ ঘটনা ছিল ভেতরে-বাইরের গভীর ষড়যন্ত্র। দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মামলা। এ মামলায় সহায়তার জন্য উভয় পক্ষের আইনজীবীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
এই রায়ে এক হাজার পৃষ্ঠার বেশি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। মূল রায়টি প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার।
সোমবার রায় পড়তে গিয়ে বিচারপতি নজরুল বলেন, তৎকালীন বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দারা কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, তা আগে জানতে পারেননি। সেই ব্যর্থতা খুঁজতে একটি তদন্ত কমিটি করা দরকার। তিনি মহাপরিচালকের উদ্দেশে বলেন, কোনো সমস্যা এলে তা তাৎক্ষণিক সমাধান করতে হবে। বিজিবির জোয়ানেরা কোনো সমস্যা নিয়ে এলে তা মীমাংসা করতে হবে এবং বিজিবিতে সেনা কর্মকর্তা ও জোয়ানদের মধ্যে পেশাদারি সম্পর্ক থাকতে হবে।
নজরুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, কেন সে সময়ের বিডিআর ডাল-ভাত কর্মসূচি নিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো কর্মসূচি যেন না নেওয়া হয়, সে ব্যাপারে বিজিবিকে সতর্ক করেন তিনি।
আরেক বিচারপতি মো. শওকত হোসেন বলেন, কোনো সেনা কর্মকর্তা সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে থাকবে না—এটাই ছিল বিদ্রোহে অংশ নেওয়াদের মূল মনোভাব। তিনি জোয়ানদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক (কলোনিয়াল) আমলের মতো ব্যবহার না করার কথা বলেন। তিনি বলেন, একই দেশ। এখানে সবাই ভাই ভাই।
গতকাল আদালত পর্যবেক্ষণে নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডকে নৃশংস ও বর্বরোচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালত বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন ইপিআর পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত এই বাহিনী দেশে-বিদেশে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরের কিছু সদস্য আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এই কলঙ্কচিহ্ন তাদের অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হবে। একসঙ্গে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার নজির ইতিহাসে নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌক্তিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আসামিসংখ্যার দিক থেকে এই মামলা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ওই হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। এই হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালত রায় দিয়েছিলেন। সোমবার হাইকোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়ার দুটি ধাপ শেষ হতে যাচ্ছে।
এসএইচ/
আরও পড়ুন