ঢাকা, মঙ্গলবার   ২১ মে ২০২৪

সন্তান লালনে কীভাবে ধৈর্যশীল হবো

প্রকাশিত : ১৪:২৮, ৮ এপ্রিল ২০১৯

এখনকার মা-বাবাদের সন্তানকে নিয়ে একটাই অভিযোগ যে সন্তান কথা শুনতে চায় না। এর একটি কারণ হলো জেনারেশন গ্যাপ। এক্ষেত্রে মা-বাবাকে ধীরস্থির হতে হবে। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যখন সন্তানের বন্ধু হতে পারবেন, তখন সন্তান আপনার কথায় অনুপ্রাণিত হবে। সন্তানের সাথে সবসময় বুদ্ধির খেলা খেলবেন।

সন্তানকে কমান্ড করবেন না বা চাপ দেবেন না। আর বাচ্চাদের গায়ে কখনো হাত তুলবেন না। সন্তানকে জোর করে বা বাধ্য করে কাজ করানো উচিত নয়। নবীজী (স)-এর জীবনের একটি ঘটনা এমন

হযরত আনাসকে (রা) মাত্র আট বছর বয়সে তার মা রসুলুল্লাহর (স) সেবায় অর্পণ করেছিলেন। আনাস (রা) নবীজী (স)-এর বাসাতেই থাকতেন। আনাস (রা)-কে একবার নবীজী (স) এসে বললেন, আনাস তুমি কি এই কাজটি করতে পারবে? ছোট্ট আনাস (রা) বললেন, না পারব না। নবীজী (স) এই উত্তর শুনে হাসলেন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।  নবীজী (স) অনেকক্ষণ পরে ঘরে ফিরে বললেন আনাস তোমাকে যে কাজটি করতে বলেছিলাম তুমি কাজটি করেছ? তখন আনাস (রা) বললেন, আমি এখনই যাচ্ছি। আসলে কোনো কারণে তার হয়তো তখন করতে ইচ্ছা হয় নি। পরে তাকে বলাতে তিনি করেছেন। আসলে সন্তানের কোনো আচরণ পছন্দ না হলে রেগে গিয়ে কথা না শুনিয়ে, তাকে কিছুটা সময় দিন। যে মুহূর্তে বললে সে শুনবে তখন বলুন।

যে মা যত বেশি ধৈর্যশীল ও ইতিবাচক তিনি তার সন্তানকে তত বেশি অনুপ্রাণিত করতে পারেন। আমরা জানি, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্কুলে তার সহপাঠীদের দ্বারা নানানরকম উৎপীড়নের শিকার হতেন। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ছিল না। কারণ তার মায়ের শিক্ষা হলো, এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তোমাকে চলতে হবে, যদি তুমি ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারো, তাহলে জীবনের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। মায়ের এই শিক্ষা তিনি সারাজীবন অনুসরণ করেছেন, যে কারণেই তিনি বড় হতে পেরেছেন।

কর্মজীবনে কুশলী হোন :

একটি অফিসে ধরুন, পাঁচজন সুপারভাইজারের অধীনে পাঁচজন কাজ করছেন। দুজন কাজটা বুঝতে পারেন নি। তারা কাজটা ভুল করছেন। এক্ষেত্রে সুপারভাইজার যদি সেই দুজনকে সবার সামনে ডেকে জবাবদিহি করেন তাহলে তাদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে। কোয়ান্টামে আমরা বলি, জনসম্মুখে এমনকি শত্রুকেও অপমান করা থেকে বিরত থাকব। অন্যদিকে তিনি যদি আলাদাভাবে তাদেরকে ডেকে মমতাসহকারে বুঝিয়ে বলেন, তাহলে এই কর্মীরা আরো বেশি উদ্যম নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কীভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা যায় তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ বণিক সিন্দবাদ। একবার তিনি বাণিজ্য করতে জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে গেলেন। ঝড়ের মুখে জাহাজ ডুবি হলো। তিনি একটি কাঠের ভেলায় ভাসতে ভাসতে একটি দ্বীপে এসে পৌঁছান। তার সহকর্মীরা সবাই মারা গেছে। তিনি যে দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন সেখানে তিনিই একা মানুষ, আর কেউ নেই।

এরকম পরিস্থিতিতে তিনি দিশেহারা না হয়ে দ্বীপের ভেতরে প্রবেশ করেন। ওখানকার গাছপালা থেকে ফল সংগ্রহ করে ক্ষুধা নিবারণ করেন। এরপর অনেক দিন ধরে বনের কাঠ দিয়ে নিজের থাকার জন্যে একটি ঘর তৈরি করেন। এভাবেই তার দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন তিনি পশু শিকারের জন্যে বনের গভীরে প্রবেশ করেন। এ সময়ে চুলাতে রান্না চড়িয়ে যান। শিকার শেষে ফিরে এসে দেখেন যে, উনুনের আগুন বাইরে বের হয়ে তার একমাত্র ঘরটি পুড়ে গেছে। কিন্তু তিনি তখনও হতাশ হন নি। এসময়ে দূর সমুদ্র থেকে একদল নাবিক দেখতে পেল, সেই দ্বীপে আগুনের ধোয়া। নাবিকদল ভাবল, ওখানে নিশ্চয়ই মানুষ রয়েছে। নতুবা ধোয়া এলো কীভাবে? তারা খুঁজতে খুঁজতে ঐ ধোয়াবেষ্টিত স্থানে এসে পৌঁছাল এবং সিন্দবাদ নাবিককে উদ্ধার করল।

আসলে এখানে সিনবাদ প্রতিটি স্থানে তার করণীয় কাজটুকু সুন্দরভাবে করেছেন। কখনো হতাশ হন নি, অস্থির হন নি। তার করণীয় কাজটুকু ধৈর্যের সাথে করেছে বলেই, তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। আসলে যে-কোনো পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যেতে হয় না। বরং তখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে করণীয় কাজটুকু করে গেলেই গন্তব্যে পৌঁছানো সহজ হয়।

গত বছর শেষের দিকে থাইল্যান্ডের এটি গুহায় আটকে পড়া ঘটনার কথা আমরা জানি। একটি কিশোর ফুটবল টিমের ১২ জন সদস্য এবং সহকারী কোচ একাপল চ্যান্টাওয়াং। এরকম কঠিন পরিস্থিতিতেও কোচ একাপল ছিলেন ধীরস্থির। খাবারদাবার শেষ হয়ে গেলে, নিজে না খেয়ে তার খাবারটি সব ছেলেদের মাঝে বিতরণ করে দেন। খাবার পানি ফুরিয়ে গেলে, বন্যার ঢুকে পড়া পানির পরিবর্তে গুহার ছাদ থেকে চুইয়ে পড়া পানি পান করতে শিখিয়েছিলেন। এই কঠিন মুহূর্তেও কোচ একাপল বালকদেরকে সবসময়ই আশা দিয়ে গেছেন যে কেউ না কেউ তাদের উদ্ধার করবে। তিনি বালকদের ফুটবল খেলায় মনোঃসংযোগের জন্যে ধ্যান শিখিয়েছিলেন। মেডিটেশন করে তারা ভেতর থেকে প্রশান্ত ও সুস্থ ছিল এবং গুহায় তুলনামূলক অক্সিজেনের কম ব্যবহার হয়েছিল। বাইরের দুনিয়ার সবাই যখন প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিল তখন প্রায় ১৮ দিন পরে ডুবুরীরা তাদের প্রত্যেককে জীবিত উদ্ধার করেন। কোচ একাপল যদি নিজে প্রশান্ত না থাকতেন এবং তার বিশ্বাসকে যদি বালকদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে না পারতেন, মৃত্যুই হতো তাদের নিয়তি এবং সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি এই দুর্ঘটনার জন্যে অপরাধী হয়ে থাকতেন। কিন্তু ধীরস্থিরতার সাথে পুরো পরিস্থিতিকে তার অনুকূলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন বলেই তিনি আজ সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে একজন সত্যিকার হিরো।

একাপল ফুটবল কোচ হবার আগে, তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে সাধনা করছেন। ধ্যান তার জীবনের অঙ্গ। কেননা যখন একজন মানুষ নিয়মিত ধ্যান করেন, তার শরীরে কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ কমে আসার পাশাপাশি মস্তিস্কে সেরেটনিন হরমোনের প্রভাব বাড়তে থাকে। এর ফলে মস্তিস্কের বিশ্লেষণী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অংশ প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স এর কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে তিনি উদ্ভুত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিটি সমস্যা সমাধানে সব থেকে সঠিক ও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

 পবিত্র ধর্মবাণীগুলোতেও মহান স্রষ্টা আমাদের  ধীরস্থির হবার উপদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই, আমি তোমাদের অনেককে ভয়, ক্ষুধা, জানমাল ও শ্রমের ফল বিনষ্ট করে অর্থাৎ বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করব। তবে এ বিপদের মধ্যে যারা ধৈর্যধারণ করে তাদের সুসংবাদ দাও। ধৈর্যশীলরা বিপদে পড়লে বলে, `আমরা আল্লাহর। তাঁর কাছ থেকে এসেছি। তাঁর কাছেই ফিরে যাব।` এদের ওপর তাদের প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়। বস্তুত এরাই সৎপথে পরিচালিত।

এই বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবতে কারা তার প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাসে অবিচল থাকতে পারেন সেটা স্রষ্টা দেখতে চান।

ধম্মপদে বলা হয়েছে, যিনি অস্থিরচিত্ত, যিনি সত্যধর্ম অবগত নন, যার মানসিক প্রসন্নতা নেই, তিনি কখনো প্রাজ্ঞ হতে পারেন না।


Ekushey Television Ltd.





© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি