ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

গণহত্যা দিবস পালিত, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:৪৬, ২৬ মার্চ ২০২১

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম জঘন্য গণহত্যা। এ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গণহত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করতে হবে।

বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) জাতীয় জাদুঘরে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, বিশেষ বক্তা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ৩০ বছরই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় থাকায় গণহত্যার ইতিহাস তারা ভুলিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে বিজয়ের গল্পের সাথে পাকিস্তানের অত্যাচার ও গণহত্যার ইতিহাসও বলতে হবে।

তিনি বলেন, ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবী রাখে। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আরও ব্যাপকভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

শাজাহান খান বলেন, পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানিদের ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

মুনতাসীর মামুন বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে গণহত্যা দিবস পালনের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় গণহত্যা বিষয়ে বাংলাদেশে তেমন আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে বলা হলেও এই সংখ্যা আরও বেশি। 

এছাড়া ধর্ষণের শিকার হন ৫ লাখ নারী, এ তথ্য উল্লেখ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘দেশের ইউনিয়ন-উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর, শহীদদের স্মৃতি ও নির্যাতনের স্মারকগুলো চিহ্নিত করে তা রক্ষার চেষ্টা করছি। এ সময় তিনি গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের উপর গবেষণার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

মফিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার কথা আমাদেরকেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করে এ বিষয়ে বিশ্বকে অবহিত করছে।

ঘন তমসাচ্ছন্ন এক রাত নেমে এসেছিল এই ভূখণ্ডে। মর্মন্তুদ সেই রাতের স্মরণে ২০১৭ সাল থেকে পালিত হচ্ছে 'জাতীয় গণহত্যা দিবস'। এর পর থেকে প্রতি বছরই ২৫ মার্চের কালরাতে এক মিনিটের জন্য নিষ্প্রদীপ হয়ে যায় সারাদেশ। আঁধারবিনাশী চেতনার আলোয় দীপ্ত স্তব্ধতার এ আয়োজন হয় একাত্তরে গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে।

কিন্তু গত বছরের মার্চ মাসে করোনা কালো থাবা বসিয়েছিল সারাদেশে। সেই থেকে সময় কাটছে নিঃসাড়ে। গত বছরের এই সময় লকডাউন থাকায় গণহত্যা দিবসে তেমন কোনও অনুষ্ঠান হয়নি দেশে। এবারও করোনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু বাঙালি এবার করোনাভয় উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পালন করেছে 'জাতীয় গণহত্যা দিবস'। একাত্তরের পঁচিশ মার্চের কালরাতে অপারেশন সার্চলাইটের অতর্কিত হত্যাযজ্ঞে হতচকিত ঢাকাবাসীর ঘরে ঘরে যে আলো নিভে গিয়েছিল, তারই স্মরণে এবার এক মিনিটের জন্য পুরো দেশে নির্বাপিত হয় যাবতীয় আলোকশিখা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত দেশের কোথাও কোনও আলো জ্বলেনি। গণহত্যা দিবসের জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে গতকাল রাত ৯টা বাজতেই রাজধানীজুড়ে আঁধার নেমে আসে। দেশবাসীও নিজ নিজ বাতি নিভিয়ে ভয়াল রাতের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনেন ক্ষণিকের জন্য।

একই দিন জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত গণহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে বলে জানান। তিনি বলেন, একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি প্রথমে কূটনৈতিকভাবে সারাবিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে, যাতে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করা হলে কেউ আপত্তি জানিয়ে সেটি বাতিল করতে না পারে।

২৫ মার্চের কালরাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে মুক্তিযদ্ধে শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অ্যালামনাই নেতারা এ দাবি জানান। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ ও মহাসচিব রঞ্জন কর্মকারের নেতৃত্বে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আফজালুর রহমান বাবু, প্রচার ও যোগাযোগ সম্পাদক কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নাসির উদ্দিন মাহমুদ নান্টু, শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ, খুকু খালেদ, মাহমুদা সুলতানা হেলেন, সম্মানিত সদস্য সবিতা সাহা, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জোহরা খাতুন প্রমুখ।

পরে এ. কে. আজাদ বলেন, ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীকে নির্বিচারে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তিনি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার প্রতি নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ২৫ মার্চের এই গণহত্যাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দিতে হবে।

রঞ্জন কর্মকার বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা চাই এই গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাক। এ সময় তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা প্রতিটি দেশের মানুষকে এ বিষয়টি তুলে ধরে তাদের সংগঠিত করে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করুন।

গণহত্যা দিবসে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি ভোর ৬টায় দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখে। সকাল ৯টায় মিরপুর বি ব্লকে জল্লাদখানা বধ্যভূমি এবং সকাল ১১টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও জগন্নাথ হল বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাসদ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

এছাড়া সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শহীদ কর্নেল তাহের মিলনায়তনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে আলোক প্রজ্বালন এবং সন্ধ্যা ৭টায় জাসদ কার্যালয়ের সামনে আলোর মিছিল বের হয়।

গণহত্যা দিবস স্মরণে এবং সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার বিচারের দাবিতে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে, জাতীয় টেনিস কমপ্লেক্স এবং শাহবাগে আলোর পদযাত্রা ও আলোচনা সভা হয়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য দেন সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য পঙ্কজ ভট্টাচার্য (ভার্চুয়াল), ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, অধ্যাপক এম এম আকাশ (ভার্চুয়াল), ঐক্য ন্যাপ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুনার রশিদ ভূঁইয়া, সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিরুল ইসলাম জহির, কাজী সালমা সুলতানা প্রমুখ।

গতকাল বিকেলে রাজধানীর তথ্য ভবনে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান।

গণহত্যা দিবস উপলক্ষে গতকাল পিরোজপুর জেলা প্রশাসন আয়োজিত আলোচনা সভায় রাজধানীর বেইলি রোডের সরকারি বাসভবন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন গতকাল রাত ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে মোমবাতি প্রজ্বালন করে। জাপানের টোকিও এবং ভিয়েতনামের হ্যানয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস গতকাল গণহত্যা দিবস পালন করেছে। কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন গণহত্যা দিবসে প্রামাণ্যচিত্র, তথ্যচিত্র প্রদর্শন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। উপ-হাইকমিশনের সম্মেলন কক্ষে ২৫ মার্চ রাতের বীভৎস হত্যাকাণ্ডে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

গণহত্যার দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে একযোগে ভার্চুয়ালি প্রদীপ প্রজ্বালন করেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও। গতকাল রাত ১২টা ১ মিনিটে ভার্চুয়াল প্রদীপ প্রজ্বালন কর্মসূচির আহ্বান জানিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) এবং অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজ। একাত্তরের গণহত্যার ৫০তম বছরের এই আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে শামিল হন অসংখ্য মানুষ।

২৫ মার্চ রাতে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি কোনো স্থাপনায় কোনো আলোকসজ্জা করা হয়নি। তবে স্বাধীনতা দিবসে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা করা যাবে।

যথাযোগ্য মর্যাদা এবং ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাইকমিশন এবং দূতাবাসেও গণহত্যা দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি