ঢাকা, শনিবার   ১৪ জুন ২০২৫

বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ চে গুয়েভারার জন্মদিন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:১১, ১৪ জুন ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আজ ১৪ জুন, বিশ্বজুড়ে বিপ্লবপ্রেমীদের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার দিন। কারণ, এদিন জন্মেছিলেন ইতিহাসের কিংবদন্তি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। তাঁকে বলা হয় বিপ্লবের প্রতীক, এক অনন্ত অনুপ্রেরণা, যিনি শুধু বন্দুক নয়, বই হাতে নিয়েও লড়েছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ চে গুয়েভারার জন্মদিন।

চে গুয়েভারার জন্ম ১৯২৮ সালের এই দিনে আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে। ডাক্তারি পেশা দিয়ে জীবন শুরু করলেও জীবনের বড় সময়টাই তিনি ব্যয় করেছেন গরিব-শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেন দারিদ্র্য, বৈষম্য আর বঞ্চনার নির্মম বাস্তবতা। তখন থেকেই সমাজ পরিবর্তনের সংকল্প গড়ে ওঠে তাঁর ভেতর।

পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি মার্ক্স, লেনিন, নেহরু, ক্যামাসসহ অনেক চিন্তাবিদের বই পড়েন। নিজের আদর্শগত অবস্থান গড়ে তোলেন সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে। গুয়েতেমালায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন, আর সেখান থেকেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি অনুকরণীয় এক বিপ্লবীতে পরিণত হন।
 
চে গুয়েভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বলিভিয়ায় থাকার সময় তিনি সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার শহর লা হিগুয়েরাতে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তার মৃত্যদণ্ড কার্যকর করে। মৃত্যুর পর তিনি সমাজতন্ত্র অনুসারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হন। 

তার মৃত্যুর ৫০ বছর পরও টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। আবার গেরিলা যোদ্ধার পোশাকে ১৯৬০ সালের ৫ মার্চ 'গেরিলেরো হেরোইকো' নামে আলবের্তো কোর্দার তোলা চে'র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটিকে 'বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফ' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
 
খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায় ও দরিদ্রদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে উঠবার কারণে খুব অল্প বয়সেই রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন চে। সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা চে'র পরিবারে ছিল তিন হাজারেরও বেশি বই। যা চে-কে করে তোলে সমাজসচেতন। সে সময় তিনি কার্ল মার্ক্স, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সরগারির বইয়ের পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু, আলবার্ট ক্যামাস, ভ্লাদিমির লেনিন, রবার্ট ফ্রস্টের বইও পড়েছেন। কোনো ধর্মে বিশ্বাসী না হয়ে এভাবেই নিজেকে একজন সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন।
 
যুবক বয়সে মেডিসিন বিষয়ে পড়ার সময় চে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। যা তাকে অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ এনে দেয়। চে বুঝতে পারেন ধনী-গরিবের এই ব্যবধান ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য বিপ্লব ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তখন থেকেই তিনি মার্ক্সবাদ নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এবং সচক্ষে এর বাস্তব প্রয়োগ দেখার জন্য গুয়েতেমালা ভ্রমণ করেন।
 
এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়েতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে'র বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তাঁর সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাঁদের 'ছাব্বিশে জুলাই' আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। খুব অল্পদিনেই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। 

সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
 
কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্ব পর্যটন করেন। এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান। এর ফলে এই বাহিনী পিগ উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন নিবন্ধ ও বই রচনা করেন। গেরিলা যুদ্ধের ওপর তিনি একটি ম্যানুয়াল রচনা করেন। পরে ১৯৬৫ সালে চে মেক্সিকো ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছা ছিল কঙ্গো-কিনশাসা ও বলিভিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। 

বলিভিয়ায় থাকার সময় তিনি সিআইএর মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট বলিভিয়ার তৎকালীন সামরিক জান্তা বারিয়েন্তোসের স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চে সহযোদ্ধাদের নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। সামরিক জান্তার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় চে গুরুতর আহত হয়ে ধরা পড়েন। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার শহর লা হিগুয়েরাতে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তার মৃত্যদণ্ড কার্যকর করে। শেষ হয়ে একটি ইতিহাস কিংবা আরেকটি ইতিহাসের জন্ম হয়।


এমবি//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি