ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

পরিচ্ছন্নতাতেই সম্ভব ডেঙ্গু প্রতিরোধ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:৪৪, ৫ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ২১:৪৬, ৫ আগস্ট ২০২১

ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। বর্ষার এই সময়ে ডেঙ্গু জ্বর বাড়তে থাকে। ফলে রক্ত উপাদান প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে যায়। আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে হাসপাতালে রীতিমতো শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি! অথচ বাড়িঘরে যেখানে-সেখানে পানি জমতে না দিয়ে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করলেই এই ব্যাধির প্রকোপ বাংলাদেশে কমানো সম্ভব। এ-সংক্রান্ত সার্বিক পরিচ্ছন্নতাই পারে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে।

লক্ষণ:
ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য সব সাধারণ জ্বরের (যেমন, টাইফয়েড) সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের মূল পার্থক্য হলো প্রথমদিন থেকেই জ্বর অনেক বেশি থাকে (১০২-১০৫ ডিগ্রি) ফারেনহাইট। জ্বরের সঙ্গে মাংসপেশি ব্যথা, শরীরের গিঁটে ব্যথা, চোখের পেছনে ও মাথায় ব্যথা, শারীরিক অবসাদ, বমি আর শরীরের কিছু অংশে বিশেষত চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা—এ লক্ষণগুলো দেখা যায়।

ডেঙ্গু জীবাণুবাহী মশা কামড়ানোর ৫/৭ দিনের মধ্যে সাধারণত মানবদেহে এ রোগের উপসর্গ দেখা যায়। কিছু কিছু ডেঙ্গু রোগী কোনো উপসর্গ ছাড়া সম্পূর্ণ সুস্থও হয়ে ওঠেন।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রকার:
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সেইসাথে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকে। বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে, মনে হয় বুঝি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।

জ্বর হওয়ার ৪র্থ বা ৫ম দিনে সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ। যা অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমিও হতে পারে। এসময় রোগীর মধ্যে ক্লান্তিবোধ এবং খাওয়ায় অরুচি দেখা যায়। সাধারণত ৪/৫ দিন পর জ্বর থেকে রোগী সেরে ওঠেন তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সেরে ওঠার ২/৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ বলে।

ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ডেঙ্গুর জটিল অবস্থা। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি এসময় শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত হয়। যেমন : চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে, নারীদের অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্তপাত ইত্যাদি।

এই রোগের বেলায় কখনো কখনো বুকে ও পেটে পানি চলে আসে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস ও কিডনি আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর নামক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলো ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো : রক্তচাপ হঠাৎ কমে যায়। নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। হাত পা ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রস্রাব কমে যায়। এ-ক্ষেত্রে হঠাৎ করে রোগী অচেতন হয়ে যেতে পারেন। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

চিকিৎসা:
চিকিৎসকরা বলে থাকেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যান। এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে, যাতে ডেঙ্গু জ্বর-পরবর্তী কোনো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি না হয়। সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।

যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। খেতে না পারলে শিরাপথে স্যালাইন প্রয়োগ করার দরকার হতে পারে। জ্বর কমানোর জন্যে শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ সেবন না করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। কেননা এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে। জ্বর কমানোর জন্যে ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছতে হবে। নিজেরা অনুমান করে বা ডাক্তার নন এমন কোনো ব্যক্তির পরামর্শে কোনো চিকিৎসা নেয়া একদমই অনুচিত। ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার দরকার। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে পরামর্শ দেবেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ডেঙ্গু এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন টেস্ট করলে এক থেকে দুদিনেই বোঝা যায়। সুতরাং কারো সন্দেহ হলে এই পরীক্ষাটা সহজেই করে নিতে পারে। কারো এটি অবহেলা করা উচিত নয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয়ার ৪ থেকে ৫ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগে রক্তের সিবিসি, প্লাটিলেট টেস্ট করা উচিত নয়। যদি দুই দিনের জ্বরে টেস্ট করেন তো রিপোর্ট স্বাভাবিক আসতে পারে। তাতে রোগী মনে করেন, আমি তো ভালোই আছি। চিকিৎসক যদি খেয়াল না করেন, তিনি মনে করতে পারেন সবকিছু ঠিক রয়েছে। আসলে কিন্তু তা নয়। ৪/৫ দিন পর প্লাটিলেট কমে। সে-সময় টেস্ট করলে রোগী বুঝবেন প্লাটিলেট কমছে কিনা। ৫ দিন পর ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমতে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড বলে। এই অবস্থাটি কিন্তু জটিল। কারণ জ্বর চলে গেল এবং রোগী মনে করলেন, আমি তো ভালো আছি। যত অঘটন ঘটে, সেগুলো কিন্তু এসময়।’

প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনো আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন : নাক বা দাঁতের মাড়িতে রক্তপাত, প্রস্রাব অথবা মলের সঙ্গে রক্তপাত, ক্ষতস্থান না শুকানো এবং সেখান থেকে রক্তক্ষরণ, মাত্রাতিরিক্ত র‍্যাশ ইত্যাদি প্লাটিলেট কমে যাওয়ার উপসর্গ। এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই হাসপাতালে নেয়া উচিত।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আ ফ ম হেলালউদ্দিন গণমাধ্যমে বলেন, ‘অনেক বমি হওয়া ও বমির জন্যে কিছু খেতে না পারা, অস্থিরতা ও অস্বাভাবিক আচরণ, তীব্র পেটব্যথা ইত্যাদির মতো উপসর্গ দেখা গেলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। এ-ছাড়া শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, বয়োবৃদ্ধ এবং ডায়াবেটিস রোগ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ রয়েছে—এমন রোগীদের শুরু থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হতে পারে। অনেকেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে এর তীব্রতা বেশি। পরে জ্বর সারতে না সারতেই অনেকে দ্রুত ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের জটিলতায় পড়ছেন। তাই জ্বর সেরে যাওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে।’

প্লাটিলেট যদি ৫ হাজারের কম হয় তখন ব্রেন, কিডনি, হার্টের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে অনেকটাই আশার কথা যে, এমন রোগীর সংখ্যা খুবই সামান্য। বারডেম হাসপাতালের মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমউদ্দিন গণমাধ্যমকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমার সঙ্গে অন্য অনেক (অন্তত আরো ১১টি) কারণে রক্তক্ষরণ হয়। বরং প্রথম থেকে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এবং সঠিক পরিমাপে তরল পদার্থ রোগীকে দিতে পারলে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা বাসাতেই সম্ভব। তাছাড়া রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে পারলে ডেঙ্গু সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।’

রক্ত ও রক্ত উপাদান কোথায় পাওয়া যায়:
ঢাকার শান্তিনগরস্থ কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের ব্লাড ব্যাংক দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর রক্তের স্যাম্পল ও হাসপাতাল থেকে দেয়া রিকুইজিশন স্লিপ নিয়ে এখানে এলে রক্ত ও রক্ত উপাদান, বিশেষত প্লাটিলেট পাওয়া যেতে পারে।

প্রতিকার:
ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে স্ত্রী এডিস মশা। এই মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকা এবং এর নিধন ও বংশবিস্তার রোধ করতে পারাই আসল সমাধান। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘প্রথম কথা হলো, নিজের নিরাপত্তা। মশা যেন কামড় না দেয়, এ বিষয়ে খেয়াল করতে হবে। এজন্যে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ মশা কিন্তু দিনে কামড়ায়। রাতে কামড়াতে পারে যদি উজ্জ্বল আলো থাকে। সুতরাং এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্যে দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে নেবেন, ঘরে মশানিরোধক স্প্রে করে নিতে পারেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘অনেক শিশুরা হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যায়। শিশুদের ফুলপ্যান্ট পরাতে হবে যেন মশা পায়ে কামড়াতে না পারে। এগুলো হলো ব্যক্তিগত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। আর দ্বিতীয় হলো, আপনার ঘর। এটিকে কিন্তু নিজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। স্বচ্ছ বা পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গু বেশি হয়। তাই খেয়াল করতে হবে, ৩ থেকে ৫ দিন যেন কোনো জমা পানি না থাকে। এমনকি বাথরুমে বালতিতে যে পানি থাকে, সেটিও ৩ থেকে ৫ দিনের বেশি রাখা যাবে না। পাত্র কিন্তু ঘষে পরিষ্কার করলে ভালো হয়। ছাদে ও বারান্দায় যারা গাছের চাষ করেন, তারা খেয়াল রাখবেন সেখানে যেন পানি জমে না থাকে।’

আর এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করার কাজটি আমরা প্রত্যেকেই করতে পারি। বাড়ির ভেতরে ও চারপাশ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে। ব্যস, শুধু এই সচেতনতা থাকলেই এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ হয়ে যাবে। এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন : কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ, মুখ খোলা পানির ট্যাংক ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে এবং পানি যেন জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

এসি
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি