ঢাকা, শুক্রবার   ২৫ জুলাই ২০২৫

কাজই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়: ভ্যালেরি টেইলর

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:৫৮, ৪ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ০০:০৪, ৫ এপ্রিল ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

কাজই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। আমাদের কাজের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে সুস্থ করে তোলার পর পক্ষাঘাতগ্রস্তদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া। যাতে তারা স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারেন।

সম্প্রতি কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনার ৭২তম আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন সেন্টার ফর দ্যা রিহাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড (সিআরপি) বা পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি টেইলর।

‘মানবতার সেবাই আমার জীবন, আমার লক্ষ্য’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি শুনিয়েছেন সিআরপির মতো একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার গল্প। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও প্রথিতযশা মনোচিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উত্তরা শাখার মোমেন্টিয়ার শামসুন্নাহার হুদা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভ্যালেরি টেইলর বলেন, ১৯৭৯ সালে চারজন রোগী নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিত্যক্ত সিমেন্ট গোডাউনে। কিছুদিন পরেই শুরু হয় আমাদের যাযাবর জীবন। একাধিক বার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে ওই সময়। হাসপাতালের বেড, জিনিসপত্র, রোগী এসব নিয়ে বার বার জায়গা বদলানোটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং।

কিন্তু প্রতিবার এসব করতে গিয়ে আমরা একটু একটু করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। এর ফলে লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে আরো দৃঢ় হয় যে, সিআরপি-কে আমরা প্রতিষ্ঠিত করবই। অবশেষে ১১ বছর পর ১৯৯০ সালে আমরা সাভারে একটা স্থায়ী জায়গা পেলাম। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হলো সিআরপি’র কেন্দ্রীয় অফিস। বর্তমানে রাজধানীর মিরপুর, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের ১২টি জেলা শহরে সিআরপি’র শাখা রয়েছে।

সিআরপির কাজ প্রসঙ্গে ভ্যালেরি বলেন, আমাদের কাজের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সুস্থ করে তোলার পর পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া। যাতে তারা স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারেন। কারণ কেউ তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না।

তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় যাদের বাকি জীবন হুইল চেয়ারে কাটাতে হয়, তারা খুব হতাশ হয়ে যায় যে, বাকি জীবন আমি কীভাবে পার করব। তাই এদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তাদেরকে আমরা বলি, এসো, বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখাতে সাহায্য করো। আর অক্ষর জ্ঞান শূন্য হলে বিভিন্ন জিনিস তৈরির কাজ শেখাই। তারা সেসব কাজ করে এবং জীবনের অর্থ আবার নতুন করে খুঁজে পায়। আসলে কাজই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। যাদের কাজ থাকে না, তারা হতাশ হয়ে পড়ে।

তিনি আরো বলেন, সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ পেলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীরাও সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করতে পারেন। সিআরপিতে এমন অনেকেই সুস্থ হয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। কেউ রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করছেন, কেউ অসুস্থদের থেরাপি দিচ্ছেন, কেউ মানসিকভাবে অন্যদের সাহস যোগাচ্ছেন। যেহেতু তারা নিজেরা এখানে এসে সুস্থ হয়েছেন, তাই এখানকার রোগীদের দুঃখ তারা যথার্থভাবে অনুভব করতে পারেন। তাই তাদের কথাতেই রোগীরা সুস্থতার বিশ্বাস ফিরে পায় ১০ গুণ বেশি।

অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে শামসুন্নাহার হুদা বলেন, সিআরপিতে যেয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি সমমর্মিতার বহু জীবনমুখী উদাহরণ। রিকাশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, ড্রাইভার, রাজমিস্ত্রীদের মতো হতদরিদ্র মানুষ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে সিআরপিতে আসে। বেশিরভাগ সময়ই যাদেরকে বড় বড় হাসপাতালগুলো ভর্তি করাতে চায় না। নিরুপায় এই রোগীদের ভ্যালেরি ঠাঁই দেন তার প্রতিষ্ঠানে। ধৈর্য, মমতা, যত্ন নিয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলা হয়। এরপর স্বাবলম্বী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবস্থা করা হয় তাদের পুনর্বাসনের। এটাই প্রকৃত সমমর্মিতা, যে নৈতিক শিক্ষায় গত দু-যুগেরও বেশি সময় ধরে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আমাদের উদ্বুদ্ধ করে আসছে।

সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি ও কোয়ান্টাম পরিবারের অকৃত্রিম শুভানুধ্যায়ী আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ভ্যালেরি টেইলর আমাদের দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তখন থেকে তার পূর্ণ মনোযোগ ও সর্বশক্তি দিয়ে তিনি এদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের সুস্থতা ও পুনর্বাসনের জন্যে যেভাবে কাজ করেছেন, তা অতুলনীয়। বাংলাদেশের মানুষকে ভালবেসে তার এই ত্যাগের জন্যে আমরা তার প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে আসেন ভ্যালেরি টেইলর। তখন তিনি ২৫ বছর বয়সী একজন তরুণ ফিজিওথেরাপিস্ট। মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত ও পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীদের সেবায় এদেশে তখন কোনো সুচিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের দুর্দশা দেখে সেবাব্রতী ব্রিটিশ তরুণী ভ্যালেরি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বাংলাদেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। সেই থেকে তার মানবতার সেবায় কাজ শুরু।

১৯৭১ সালে দেশের প্রথম প্রশিক্ষিত ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। এরপর প্রায় অর্ধশতাব্দীর প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন সেন্টার ফর দ্যা রিহাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড (সিআরপি) বা পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র। এটি আজ বিশ্বজুড়ে পরিচিত একটি আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

(চলতি বছরের (২০১৮) ৮ জানুয়ারি কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনায় ভ্যালেরি টেইলর তার এ মতামত তুলে ধরেন)।

আর/টিকে


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি