ঢাকা, রবিবার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪

‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’

গানটি রচনার পেছনের ইতিহাস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৪৬, ১৮ এপ্রিল ২০২৩ | আপডেট: ১৫:৪৭, ১৮ এপ্রিল ২০২৩

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটিকে দেশে ঈদুল ফিতরের জাতীয় সঙ্গীত বলা হয়। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই শহর কিংবা গ্রাম সব খানে বেজে ওঠে গানটি। গানের সঙ্গে বাঁধ ভাঙে ঈদের খুশি।

কিন্তু কবে, কখন, কীভাবে দেশে ঈদ আনন্দের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠলো এ গানটি, তা হয়তো অনেকেরই অজানা? 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গানটি লিখেছিলেন ১৯৩১ সালে জনপ্রিয় শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমেদের অনুরোধে। নজরুল তখন শ্যামাসংগীত লিখতেন। শ্যামাসংগীতের জন্য রীতিমতো খ্যাতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এক রাতে রেকর্ডিং শেষে কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তাকে থামালেন শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। কবির কাছে একটা আবদার ছিল তার। না শোনা পর্যন্ত নজরুলকে যেতে দেবেন না। আব্বাসউদ্দীন কবি নজরুলকে সম্মান করতেন। 

বাবার স্মৃতিকথা থেকে গানটি সম্পর্কে গল্প করেছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। 

তার ভাষ্য, ‘আব্বা নজরুলকে বলতেন কাজী দা। তিনি একদিন বললেন, কাজী দা এই যে পেয়ারু কাওয়াল ঈদের সময় কত সুন্দর গান রচনা করে আর এইচএমভি থেকে যখন গ্রামোফোন বের হয়, হাজার হাজার কপি মুসলমানরা কিনে নেয়। তুমি এরকম একটা গান লেখো না?’

বলে রাখা ভালো, আব্বাসউদ্দীন বয়সে একটু ছোট হলেও দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতোই ছিল। আব্বাসউদ্দীন আহমেদ তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘তখনকার সময়কার রেকর্ড কোম্পানি এইচএমভির কর্মকর্তা ভগবতী ব্যানার্জী তখন বলেছিলেন, ‘(মুস্তাফা জামান আব্বাসীর ভাষায়) আব্বাস সাহেব মুসলমানদের পয়সা নেই। তারা রেকর্ড কিনতেও পারবে না। পুজোর সময় গান বিক্রি হয়। ঈদের সময় কোনো গান বিক্রি হবে না। তবে নাছোড়বান্দা আব্বাসউদ্দীন রাজি করিয়েছিলেন এইচএমভি কোম্পানির ভগবতী ব্যানার্জীকে।’

তার ভাষ্য, ‘নজরুল আব্বাকে বললো পান নিয়ে আসো আর চা। আব্বা অনেকগুলো পান নিয়ে এলো। আর বললো চা আসছে।’

নজরুল একটা কাগজ নিয়ে এই গানটি লিখলেন। তারপর বললেন, সুরটা এখনই করি না পরে করবো?’

আব্বাসউদ্দীন বললেন, ‘কাজী দা আপনার মনের যে অনুভূতিটা, যেটা গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন এখন না করলে সেই মজাটা হবে না।’ 

এটা সেই ইতিহাস। তখনকার সময়ে অমুসলিম শিল্পী সতীনাথ মুখার্জীসহ আরও অনেকের কণ্ঠে শোনা গেছে গানটি। এছাড়া আব্বাসউদ্দীনের ছেলে ও মেয়ে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসি রহমানও গানটি জনপ্রিয় করেছেন। এই গানটিকে ধীরে ধীরে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার। 

মুস্তাফা জামান আব্বাসী মতে, ‘গানটি জনপ্রিয় করেছে বাংলার মুসলমান।’ তিনি বলছেন, ‘১৯৫৯ সালে মারা গেছেন আব্বাসউদ্দীন। তার পরে এতো বছর গানটি কারা গাইলো? আমরাইতো গাইলাম। আব্দুল আলিম, আব্দুল হালিম চৌধুরী, বেদার উদ্দিন আহমেদ, সোহরাব হোসেন, এদের নাম আমরা ভুলে যাবো কেন?’

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘গানটিতে ধর্মীও ভাবধারা আর ঈদের খুশি খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই গানটি দিয়েই বাংলায় মুসলিমদের মধ্যে সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা শুরু, শোনা ও চর্চার শুরু। নজরুলই তার সূচনা করেছেন।’

মোটকথা, গানটি বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ। 

১৯৩১ সালে গানটি লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় প্রথম রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামোফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গান ছিল কবির ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।’ হিজ মাস্টার্স কোম্পানির রেক রেকর্ড নম্বর এন‌- ৪১১১। গানটির প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ।

গানের কথা
এখানে ১৯৩১ সালে প্রকাশকালে যেই বানানরীতিতে গানটি লিখা হয়েছিল, সেই বানানরীতিতেই গানটির কথা তুলে ধরা হয়েছে। পুরাতন বানানরীতির কয়েকটি শব্দ আধুনিক বাংলা বানানরীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ,
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে,
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী,
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ,
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।

ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

তোরে মারল' ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা,
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।”

সূত্র: বিবিসি বাংলা, ইউকিপিডিয়া
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি