ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

চুল কাটায় নিষেধাজ্ঞা!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:১৪, ২৫ আগস্ট ২০১৯

‘চুল’ মানুষের সৌন্দর্যের প্রতীক। কালে কালে এই চুলের স্টাইলে এসেছে পরিবর্তন। শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও এখন চুল নিয়ে বেশ চিন্তিত। উন্নত বিশ্বের তারকাদের চুলের স্টাইলে ভিন্নতা দেখা যায়। যে প্রভাব পড়ছে দেশের তরুণদের মধ্যে। তারা উন্নত বিশ্বের তারকাদের মত করে নিজেদের চুলের স্টাইলে আনছে পরিবর্তন। সেই সুযোগে দেশের পার্লর ও সেলুনগুলোতে তরুণদের ফ্যাশনেবল চুল কাটা ও দাড়ি গোঁফ কামানোর প্রচলন গড়ে উঠেছে। ফ্যাশন সচেতনরা এটাকে ভালোভাবে দেখলেও দেশের প্রশাসন এটি নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠছেন। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে এবিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সেলুন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকও করা হয়েছে। যেখানে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তরুণদের চুলের স্টাইলে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। কিশোর অপরাধ ও বখাটেপনা দূর করতে ছাত্র ও তরুণদের চুলে নজর দিবে প্রশাসন। কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল, সিলেট, ঢাকার সাভার, মাগুরা, ঝালকাঠি সহ আরও কয়েকটি জেলায় পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নরসুন্দরদের নিয়ে এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

পর পর এমন কয়েকটি ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, চুল ছাঁটা নিয়ন্ত্রণ করলেই কি সমাজ থেকে বখাটেপনা দূর হয়ে যাবে? এ ধরণের নিয়ন্ত্রণ আরোপের এখতিয়ার কি পুলিশ বা প্রশাসনের আছে?
সবশেষ বাঘা উপজেলার নির্দেশনাটি ইউএনও-এর পক্ষ থেকে দেয়া হলেও বাকি সব নির্দেশনা আসে পুলিশের থেকে।

এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক সোহেল রানা গণমাধ্যমকে জানান যে, সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রচার মাধ্যমে তিনি এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হতে দেখেছেন। সেখানে পুলিশের পক্ষ থেকে চুল-দাড়ি-গোঁফ ছাঁটার ব্যাপারে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে কোন ধরণের নির্দেশনা দেয়া হয়নি এবং এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়ার এখতিয়ার পুলিশের নেই বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘কে কিভাবে চুল কাটবে এটা সম্পূর্ণ ওই ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। এ নিয়ে পুলিশ কিছু বলতে পারবেনা করতেও পারবেনা। যে নির্দেশনা এসেছে, সেগুলো কারও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়ে থাকতে পারে। আমরা তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।’

ইভ টিজিং প্রতিরোধে ফ্যাশনেবল চুল-দাড়ি-গোঁফ ছাটার ওপর নির্দেশনা প্রথম এসেছিল গত মার্চে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায়। সেখানে স্টাইল করে চুল-দাড়ি কাটার ক্ষেত্রে জরিমানার বিধান রেখে নোটিশের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শীল সমিতি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হেয়ার স্টাইলের কোনও ক্যাটালগ দোকানে প্রদর্শনও করা যাবে না।
এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে উপজেলা শীল সমিতি পরে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

অন্যদিকে জেলার সখিপুরে, স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রদের এ ধরণের স্টাইলে চুল কাটা এবং চুলে রঙ না করার জন্য শীল সমিতির নেতাদের থানায় ডেকে সতর্ক করে পুলিশ।

একইভাবে সিলেটের কানাইঘাট বাজারের সেলুন ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক বৈঠকে এ ধরণের নির্দেশনা দেয় পুলিশ। কেউ এটি অমান্য করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়।

এছাড়া ঝালকাঠি, ঢাকার সাভার এবং মাগুরা জেলা পুলিশও সেলুন মালিকদের বখাটে স্টাইলে চুল কাটা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে মাগুরায় মাইকিংও করা হয়।
আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা যখন বিভিন্ন মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঠিক তখন শুধু চুল-দাড়ির স্টাইলে নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়টি আসলেও কতোটা আইনসঙ্গত, এমন প্রশ্ন উঠেছে অনেকের মনে।

এ বিষয়ে আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন মনে করেন এ ধরণের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, বেআইনী।

তিনি জানান, কারও ব্যক্তিগত চুল ও দাড়ির ছাঁটে কোন ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারির কথা আইনে বলা নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে, আইনে, বিধি-বিধান কোন কিছুতেই ব্যক্তির বেশ ভূষার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়ে কিছু বলা নেই। পুলিশ, প্রশাসনের কাউকে এমন অধিকার দেয়া হয়নি। এটা যার যার স্বাধীনতা। এখানে বাধা দিতে গেলে সেটি হবে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। বরং ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে আইন আছে।’

সমাজ থেকে বখাটেপনা দূর করতে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার পাশাপাশি, নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে জনসচেতনতা বাড়ানো, তরুণদের সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করা, যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের এক অধ্যাপক বলেন, ‘কোন ছেলে বা মেয়ের বয়স যদি ১৮ বছরের নীচে হয়, বা তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী অথবা কর্মচারি হন তাহলে তার চুলের ছাঁট বা পোশাক আশাক সেই প্রতিষ্ঠানের কোড অব কন্ডাক্ট অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এখানে পুলিশ বা প্রশাসনের কিছু করার এখতিয়ার নেই।’

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত এ ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে তরুণদের স্টাইলিশ চুল কাটার বিষয়ে যে কথিত নির্দেশ জারি করা হয়েছিল তা তুলে নিতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, হেয়ার স্টাইলের উপর তরুণদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না। তরুণ সমাজ বিপথগামী হলে সেখান থেকে তাদের সরিয়ে আনতে পরিবার, শিক্ষক ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি