ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৮ জুলাই ২০২৫

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কেনো এতো জরুরি

প্রকাশিত : ২২:৫৪, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কোনো জাতির অবশ্য পালনীয় দুটি বিষয়। এ দুটি নাগরিক নিবন্ধনের সঠিকতার ওপর অনেক সামাজিক সূচকের সত্যতা নির্ভরশীল।

এই উপমহাদেশে ১৪৫ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৩ সালে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন জারি হলেও অদ্যাবধি সব মানুষের জন্ম নিবন্ধন করা সম্ভব হয়নি। আইনটিকে সময়োপযোগী করার জন্য ২০০৪ সালে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন জারি করে পুরনো আইন বাতিল করা হয়। নতুন আইনটি ২০০৬ সাল থেকে কার্যকর হয়। ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য ‘রেজিস্ট্রার জেনারেল’-এর পদ সৃজনসহ জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে এগুলোর নাগরিক নিবন্ধনে বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়। এরই মধ্যে রেজিস্ট্রার জেনারেলের পদ সৃজনসহ অফিস স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে বাংলাদেশ আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে পারেনি।

বাংলাদেশে পাঁচটি স্তরে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সম্পন্ন হয়। স্তরগুলো হলো—ইউনিয়ন পরিষদ, ক্যান্টনমেন্ট, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন এবং রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। আইনানুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান বা মেয়র (কাউন্সিলর/স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে অর্পিত), ক্যান্টনমেন্ট নির্বাহী কর্মকর্তা, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনপ্রধান এবং রেজিস্ট্রার জেনারেল জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন হয় ইউনিয়ন পরিষদে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনেক কার‌্যাবলি তৃণমূল পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে থাকে। ফলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে ইউনিয়ন পরিষদ কখনো কখনো পুরো শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না।

বাংলাদেশে আইনানুযায়ী জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ শিশুর জন্ম নিবন্ধন হয়। নিবন্ধিত এই শিশুদেরও স্কুলে ভর্তির সময় জন্ম তারিখ পরিবর্তিত হয়। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়স ছয় বছর নির্ধারিত হওয়ায় ছয় বছরের অধিক বয়স্ক শিশুদের বয়স হ্রাস করে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। বয়স পরিবর্তনের এই প্রবণতা এখানেই শেষ নয়। পঞ্চম শ্রেণি, অষ্টম শ্রেণি এবং নবম শ্রেণিতে বোর্ড রেজিস্ট্রেশনের সময় বয়স হ্রাসের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ঢাকাসহ দেশের নামিদামি স্কুলগুলোতে লটারিতে নাম আসার জন্য ভর্তীচ্ছু একই শিশুর অনুকূলে নাম ও জন্ম তারিখের হেরফের করে একাধিক আবেদন দাখিল করা হয়। লটারিতে নাম এলে সে অনুযায়ী সব কিছু ঠিকঠাক করা হয়।

বাংলাদেশে সব মানুষের জন্ম অদ্যাবধি নিবন্ধন করা সম্ভব না হলেও এরই মধ্যে ১৬ কোটির বেশি মানুষের জন্ম নিবন্ধন জন্ম ও মৃত্যুর তথ্যভিত্তিক ডাটাবেইসে সংরক্ষিত আছে এবং প্রতি মুহূর্তে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী ইচ্ছামতো জন্ম নিবন্ধন করা সম্ভব হওয়ায় এবং অনেক ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির একাধিক তারিখে জন্ম নিবন্ধন করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ১৬ কোটি মানুষের দেশে একসময় ২৫ বা ৩০ কোটি জন্ম নিবন্ধন হয়ে যেতে পারে। যা দেশকে এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। অবশ্য এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এরই মধ্যে ডি-ডুপ্লিকেশনের কার্যক্রম রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে হাতে নেওয়া হয়েছে। কাজটি কঠিন হলেও সফলতা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করা যায় না।

অন্যদিকে বাংলাদেশে মৃত্যু নিবন্ধন অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিবছর দেশে ৯ লাখ মানুষের মৃত্যু হলেও আইনানুযায়ী ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু নিবন্ধন ১ শতাংশের নিম্নে। পেনশন, উত্তরাধিকার ইত্যাদি ছাড়া কেউ তার মৃত আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু নিবন্ধন করতে চায় না। বাংলাদেশে লাশ দাফন বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য অনুমতি বা মৃত্যু রেজিস্ট্রেশন সনদের প্রয়োজন হয় না।

জন্ম ও মৃত্যুবিষয়ক নাগরিক নিবন্ধন কোনো দেশের অত্যাবশ্যকীয় পরিসংখ্যানের অংশ। অত্যাবশ্যকীয় এই পরিসংখ্যান ছাড়া জনকল্যাণমুখী কার্যকর আইন, বিধি ও নীতিমালা করা অসম্ভব।

বাংলাদেশে মানুষের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও জীবনধারণের অনেক সূচকের উন্নতি হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও হাসপাতালে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা ছিল মোট জন্মের মাত্র ১৭ শতাংশ। বর্তমানে হাসপাতালে জন্ম বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশের বেশি। এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশে যদি সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রধানকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে জন্ম নেওয়া শিশুর জন্ম নিবন্ধনের ক্ষমতা অর্পণ করা যায়, তাহলে এখনই তাঁরা মোট জন্ম নেওয়া শিশুর ৪২ শতাংশের নিবন্ধন জন্মের মাত্র তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে করে রেজিস্ট্রার জেনারেলের এসংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারেন। একইভাবে উন্নত দেশের মতো হাসপাতালে মৃত ব্যক্তির মৃত্যু নিবন্ধন করে মাত্র তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে তথ্যাদি রেজিস্ট্রার জেনারেলের তথ্যভাণ্ডারে প্রেরণ করে আইনানুযায়ী মৃত্যু নিবন্ধন সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব।

সম্প্রতি ২০১৭-১৮ সালে সরকার বিধি জারি করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম সহজীকরণ করেছে। জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে এগুলোর নিবন্ধন সম্পূর্ণ বিনা খরচে করার বিধান জারি হয়েছে। উন্নত দেশে সব জন্ম ও মৃত্যু হাসপাতালকেন্দ্রিক হয়। তাই উন্নত দেশগুলো এগুলোর রেজিস্ট্রেশন হাসপাতালে সম্পন্ন করে মানুষকে দ্রুত ও মানসম্মত সেবা প্রদান করছে। বাংলাদেশও মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০২১ সালে আমরা এ সম্মান অর্জন করব। ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা এশিয়ার উন্নত দেশে উপনীত হব। এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে জন্ম ও মৃত্যু বৃদ্ধি পাবে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের একটি স্তর বৃদ্ধি করে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষমতা অর্পণ করে আইনানুযায়ী জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করা যেতে পারে।

লেখক : সাবেক অতিরিক্ত সচিব, কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, সিআরভিএস ডাটা ফর হেলথ


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি