ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ধ্বংসের পথে সোনাবাড়ীয়ার মঠ মন্দির

কলারোয়া (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৩:৩২, ২৫ অক্টোবর ২০২১

প্রকৃতির সঙ্গে পুরাকীর্তি যাদের সমানভাবে আকর্ষণ করে তাদের আসতেই হবে সাতক্ষীরার কলারোয়ার সীমান্ত জনপদ সোনাবাড়িয়া গ্রামে। প্রাচীনকালের নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গোটা সোনাবাড়িয়া এলাকা জুড়ে। এমনই এক পুরাকীর্তির নাম মঠবাড়ি মন্দির গুচ্ছ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটিও হতে পারে দেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। 

কলারোয়া উপজেলা সদর থেকে ৯.৬ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়িয়া গ্রাম। আর এই গ্রামের বুকচিরে রয়েছে প্রত্নস্থলটির অবস্থান। প্রায় ৪শ’ বছরের পুরানো ৬০ ফুট উঁচু টেরাকোটা ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এই মঠ-মন্দির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ঐতিহাসিক মঠ-মন্দিরটি এখনই সংরক্ষণ করা না গেলে নষ্ট হয়ে যাবে জাতীয় সম্পদ।

২০১০ সালের জানুয়ারীতে এই মঠ দেখতে সোনাবাড়িয়া ঘুরে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ক লেখক মো. মোশারফ হোসেন। সঙ্গে ছিলেন খুলনা জাদুঘরের একটি টিম। সে সময় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কতৃক মঠ সংরক্ষণে এগিয়ে আসার আশ্বাস পাওয়া গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। 

এসময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেনের লেখা পুরাতত্ত্বজরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, এ মন্দির ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দূর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করে ছিলেন। যেটি সতীশ চন্দ্র মিত্রের বইয়ের লেখায় ও প্রকাশ করা হয়েছে। এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় এর ত্রিতলবিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির। এটিই এলাকায় ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত লাভ করেছে। এর সঙ্গে লাগোয়া রয়েছে দূর্গা মন্দির ও শিবমন্দির। এই মন্দির গুচ্ছের দক্ষিণে একটি অসম বাহুবিশিষ্ট চৌকো দিঘি আছে। 

শ্যামসুন্দর মঠ মন্দিরটি একটি পিরামিড আকৃতি ধারণ করে আছে। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরের নিচের তলার ভিতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে একটি মন্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে প্রকাষ্ঠ রয়েছে। কিন্তু পূর্বাংশের কোঠাটির পিছনে রয়েছে একটি অলিন্দ, যেখানে দ্বিতল ভবনে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পূর্ব ও পশ্চীম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশ্যে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল। দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণমুখী কোঠা।

ত্রিতল ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়া মাটির ফলক রয়েছে।

মোশারফ হোসেনের ওই জরিপকৃত বইতে আরো বলা হয়েছে, শ্যামসুন্দর মঠের প্রত্যেক তলার ছাদপ্রান্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধ্বমুখী গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রত্ন রয়েছে। এটি তাই ‘নবরত্ন স্মৃতি মন্দির’। নবরত্ন বা শ্যামসুন্দর মঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি দক্ষিণমুখী মন্দির আছে। এটি ‘দুর্গা মন্দির’ নামে পরিচিত। শ্যামসুন্দর মন্দিরের গা ঘেঁষে পূর্বমুখী মন্দিরটিতে একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। এর ওপর একটি ভাষ্য ফলক পাঠোদ্ধার অনুপযোগী অবস্থায় সংস্থাপিত আছে। এর ছাদ চৌচালা, কার্ণিশ ধনুক কারে বাঁকা এবং কোণগুলো কৌণিক। এটি ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ নামে পরিচিত। মন্দির গুচ্ছের সব কটি ইমারতে ২২.৮৫ সেমি. ২০.৩১ সেমি. ২.৫৩ সেমি. (৯ ইি. ৮ ইি. ১ ইি.) পরিমাপের ইট ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। বর্তমানে এ মন্দির গুচ্ছ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মঠের পাশে আরও ৮টি (মতান্তরে ১০টি) মন্দির ছিল। 

অনেকের মতে, রামকৃষ্ণ পরমহংস এক সময় মন্দিরগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন। জানা যায়, মঠ মন্দির গুচ্ছের অল্প দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে তার পাকাঘাটে ব্যবহৃত ইটের সাথে ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ এর ইটের মিল পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা হয় পুকুরটি একই সময় কালের নিদর্শন। 

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের জানুয়ারীতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কতৃক মঠ সংরক্ষণে এগিয়ে আসার আশ্বাস পাওয়া গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপরে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও মঠ রায় কোন সরকারি বা বেসরকারি কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ক্রমান্বয়ে কালের আঁচড়ে বিনষ্ট হচ্ছে সুরম্য ভবনটি। শতশত বছরের ধর্মীয় স্মৃতি চিহ্নটি রায় স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক পুকুরটি বিষমবাহুর আকার ধারণ করেছে। এই মঠ মন্দির অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকায় এলাকায় চলে বিকেল ও সন্ধ্যায় ফেনসিডিল ও গাজা সেবনকারীদের আড্ডা। সেই সঙ্গে চলছে মঠ মন্দির জমি দখলের মহা উৎসব। 

এলাকার হিন্দু সম্প্রাদায়ের লোকজন মঠ মন্দিরটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণের দাবী জানায়। 
এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি