ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪

নুসরাত হত্যায় যেভাবে দায়িত্ব পালন করেন ১৬ আসামি

প্রকাশিত : ১০:৫০, ২৯ মে ২০১৯

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাসহ ১৬ জনকে আসামি করে মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এতে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) প্রদানের সুপারিশ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বুধবার ফেনীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। ঘটনার ১ মাস ২১ দিনের মাথায় মামলাটির চার্জশিট দেয়া হচ্ছে।

মঙ্গলবার ঢাকায় পিবিআই সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এসব তথ্য জানান। তিনি আরও বলেন, চার্জশিটে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার এই বহিষ্কৃত অধ্যক্ষকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে।

বাকি আসামিরা হলেন- সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম (৫০), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন (১৯), হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), আফছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মণি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আবদুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), মোহাম্মদ শমীম (২০) ও মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।

নুসরাত হত্যায় আসামিদের কার কী ভূমিকা ছিল তা তুলে ধরা হলো-

১. সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা

তিনি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও পিবিআইয়ের ভাষায়, ‘তার চেয়ে বেশি’ করেছেন। নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ, তাতে কাজ না হওয়ায় ভয়-ভীতি দেখানো এবং পরে নুসরাতকে হত্যার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগ আনা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে।

২. নূর উদ্দিন

নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নূর উদ্দিনের। পিবিআই বলছে, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার আগে রেকি করা ছিল তার দায়িত্ব। আর ভবনের ছাদে আগুন দেওয়ার সময় নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকি করা ছিল তার দায়িত্ব।

৩. শাহাদাত হোসেন শামীম

নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন শামীম। সেজন্য ছিল তার ক্ষোভ। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে কার কী ভূমিকা হবে সেই পরিকল্পনা সাজান শামীম। কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তিনি তার বোরখা ও কেরোসিন কেনার ব্যবস্থা করেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় তিনি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেন। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাসটি উদ্ধার করে পিবিআই।

৪. সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম

অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা গ্রেপ্তার হলে ২৮ মার্চ তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ। বোরখা ও কেরোসিন কেনার জন্য তিনিই ১০ হাজার টাকা দেন। পিবিআই বলছে, পুরো ঘটনার আগাগোড়াই তিনি জানতেন।

৫. সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের

পিবিআই বলছে, বোরখা ও হাতমোজা পরে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন জোবায়ের। নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে দুই ভাগ করে পা বাঁধা এবং কেরোসিন ঢালার পর ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানোর কাজটি তিনিই করেন।

৬. জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ

পিবিআই বলছে, বোরখা পরে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন জাবেদ। পা বাঁধা হলে পলিথিন থেকে কেরোসিন গ্লাসে ঢেলে তিনি নুসরাতের গায়ে ছিটিয়ে দেন। সব কাজ শেষে বোরখা খুলে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান।

৭. হাফেজ আব্দুল কাদের

নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু কাদের সেদিন মাদ্রাসার মূল ফটকে পাহারায় ছিলেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হলে দুই মিনিট পরে তিনিই ফেন করে নোমানকে বলেন, তার বোন গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

৮. আবছার উদ্দিন

ঘটনার সময় তিনি গেইটে ছিলেন পাহারায়। মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়াও তার দায়িত্ব ছিল বলে পিবিআইয়ের ভাষ্য।

৯. কামরুন নাহার মনি

আসামি শামীমের দূর সম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনি ২ হাজার টাকা নিয়ে দুটি বোরখা ও হাতমোজা কেনেন। পিবিআই বলছে, হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি অংশ নেন। ছাদের ওপর নুসরাতের হাত বাঁধা হলে তাকে শুইয়ে ফেলে বুকের ওপর চেপে ধরেন মনি। আগুন দেওয়া হলে নিচে নেমে এসে আলিম পরীক্ষায় বসেন।

১০. উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা

অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি সেদিন নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যান। পরে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। তাতে রাজি না হওয়ার নুসরাতের ওড়না দিয়ে তার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেন। নুসরাতকে ছাদে শুইয়ে চেপে ধরেন পা। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয়ে গেলে পপিও নিচে নেমে পরীক্ষার হলে বসেন।

১১. আব্দুর রহিম শরীফ

ঘটনার সময় তিনি মাদ্রাসার ফটকে পাহারায় ছিলেন। পরে তিনি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালান।

১২. ইফতেখার উদ্দিন রানা

মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।

১৩. ইমরান হোসেন ওরফে মামুন

মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।

১৪. মোহাম্মদ শামীম

সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন। কেউ যেন ওই সময় ছাদে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা ছিল তার দায়িত্ব।

১৫. মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহুল আমীন

পিবিআই বলছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন শুরু থেকেই এ হত্যা পরিকল্পনায় ছিলেন। ঘটনার পর পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাতেও তার ভূমিকা ছিল বলে পিবিআইয়ের ভাষ্য।

১৬. মহিউদ্দিন শাকিল

ঘটনার সময় সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন।

এই ১৬ আসামির মধ্যে নুসরাতের তিন সহপাঠী কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন ছাড়াও শাহাদাত হোসেন ও জোবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন বলে উঠে এসেছে আসামিদের জবানবন্দি ও পিবিআইয়ের তদন্তে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে আসামিরা কাজ করেছে। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর তার তিন সহপাঠী পরীক্ষার হলে ঢুকে আলিম পরীক্ষাও দিয়েছে।

প্রসঙ্গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। বোরকা পরিহিত কয়েকজন কৌশলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন রাফির বড়ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান অগ্নিদগ্ধ রাফি। এর আগে ২৭ মার্চ রাফিকে নিজ কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পর দিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

এ পর্যন্ত রাফি হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ২২ জনের মধ্যে সিরাজউদ্দৌলাসহ ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি