ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

প্রিয়া সাহার বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার ঝড়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:২৭, ২০ জুলাই ২০১৯

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নির্যাতিত হচ্ছে বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ তুলছেন প্রিয়া সাহা নামে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংগঠনের এক নেত্রী। যার ভিডিও প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বইছে সমালোচনার ঝড়। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ২৭ জন ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরা সবাই গত ১৬ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আয়োজনে 'সেকেন্ড মিনিস্টারিয়াল টু এ্যাডভান্স রিলিজিয়াস ফ্রিডম' নামক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। 

সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এতে পাঁচ জন বাংলাদেশী এবং দু'জন রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীর একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রিয়া সাহা।

সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে থেকে '৩৭ মিলিয়ন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান নিখোঁজ হয়েছে (তার ভাষায়)'। তার নিজের বাড়িঘরও আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু এর কোন বিচার হয় নি। ট্রাম্পকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সাহায্য করেন। যাতে তারা দেশে থাকতে পারে।

প্রিয়া সাহার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথোপকথনের ভিডিওটি অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় এক দিনের মধ্যেই। পড়তে থাকে অসংখ্য মন্তব্য। ফেসবুকসহ নানা প্ল্যাটফর্মে শুরু হয় বিতর্ক। এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন সরকারের মন্ত্রীরাও।

এদিকে, প্রিয়া সাহার অভিযোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার শনিবার বলেছে, এসব অভিযোগ ভয়ংকর মিথ্যা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, এসব সাজানো গল্পের পেছনে অশুভ উদ্দেশ্য রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, এসব অভিযোগ কেন আনা হয়েছে, প্রিয়া সাহা দেশে ফিরলে তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক ওবায়দুল কাদের প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে 'দেশদ্রোহী বক্তব্য দেবার' অভিযোগ করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কথা বলেন।

কী বলেছিলেন প্রিয়া সাহা?
প্রিয়া সাহার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর সন্ত্রাসী হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া নিউজিল্যান্ডের মুসলিম ফরিদ উদ্দিন। এরপর পাকিস্তানের নিপীড়িত খ্রীস্টানদের বিষয়ে কথা বলেন আরেকজন। তারপর কথা বলেন প্রিয়া সাহা।

তিনি ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে বলেন, 'স্যার, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এখানে ৩৭ মিলিয়ন (তিন কোটি ৭০ লাখ) হিন্দু বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়ে গেছে। দয়া করে আমাদের, বাংলাদেশী মানুষদের, সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। সে দেশে এখনো ১৮ মিলিয়ন (১ কোটি ৮০ লাখ) সংখ্যালঘু আছেন। আমার অনুরোধ হচ্ছে, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ছেড়ে যেতে চাই না। শুধু আমাদের দেশে থাকতে সাহায্য করুন।'

প্রিয়া সাহা আরো বলেন, 'আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা আমাদের জমি নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এর কোন জাজমেন্ট (বিচার) হয় নি।'

এ সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে প্রশ্ন করেন "বাড়ি ও জমি কে নিয়েছে?" অবশ্য এর আগেই প্রিয়া সাহার সঙ্গে হাত মেলান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

জবাবে প্রিয়া সাহা একটু কথা গুলিয়ে ফেললেও পর মুহূর্তেই বলেন, 'মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী। তারা সবসময়ই রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে। সব সময়।' এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উপস্থিত অন্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন।

উল্লেখ্য, সরকারি সূত্র মতে, বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন ৯ শতাংশের মতো।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, প্রিয়া সাহা যা বলেছেন এগুলো তার ব্যক্তিগত মত, সংগঠনের নয়।

তিনি বলেন, যে 'ডিজঅ্যাপিয়ার' কথাটির সঙ্গে তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যাটা প্রিয়া সাহা বলেছেন, সেটা সত্য নয়। তবে, দেশভাগের পর এখানে সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা ছিল ২৯.৭ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ সালে সেটা এসে দাঁড়ায় ৯.৭ শতাংশে।"

"এটাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন 'মিসিং পিপল' মানে হারিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী। কিন্তু 'ডিজঅ্যাপিয়ার্ড' মানে নিখোঁজ বা গুম। এখন এই শব্দ দিয়ে প্রিয়া কী বলতে চেয়েছেন, সেটা তিনিই জানেন"- বলেন দাশগুপ্ত।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন, প্রিয়া সাহা এখন নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেন। তবে একাধিকবার ফোন করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয় নি।

'পরিসংখ্যানগত বাস্তবতা'
অবশ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের 'উধাও' হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সমালোচনা হলেও, বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দুদের একটি বড় অংশ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, সেটা একটা বাস্তবতা।

তারা বলছেন, ১৯৪৭ সালের পর ২০১১ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা যে ১৮ শতাংশ কমে গেছে বাংলাদেশে সেটি পরিসংখ্যানগত বাস্তবতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ঈশানী চক্রবর্তী বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষের দেশত্যাগ করা নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশত্যাগ বিভিন্ন সময় ঘটেছে, এটা মিথ্যা নয়।

তিনি বলেন, "বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সেরকম কোন গবেষণা নেই। কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নানা সময়ে দেশত্যাগ করেছেন সেটা তো বাস্তবতা।"

ঈশানী চক্রবর্তী আরও বলেন, "মূলত দুটি কারণে এই দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। প্রথম কারণ অর্থনৈতিক, সেটা বুঝতে কোন পরিসংখ্যান লাগে না। আর দ্বিতীয় কারণ অনিশ্চয়তা, যেটা সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে সব সময়ই থাকে।" 

ঈশানী চক্রবর্তী বলেন, এই অনিশ্চয়তার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে দেশের এ পর্যন্ত কোন সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার হয়নি। সেক্ষেত্রে এ অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য সরকারের আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। 

এনএস/আরকে


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি