ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দুই বছর

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ১২:৩১, ২৫ আগস্ট ২০১৯

জ্বলছে নিজ ঘর বাড়ি, জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম, কুণ্ডলি পাকিয়ে কালো ধোঁয়া যেন পুরো পৃথিবীর আকাশকেই ঢেকে ফেলেছে। ৩০ উর্ধ্ব আব্দুল আলীমের পরিবারের এগারো জনের মধ্যে নয় জনকেই মেরে ফেলা হয়েছে। বেঁচে আছেন তারা দুই ভাই। বেঁচে থাকলেও তারা নেই এক সঙ্গে, ছোট ভাইটা কোথায় আছে তা জানেন না তিনি। এক পাশে সীমান্ত অন্যপাশে নিশ্চিত মৃত্যু। তারপরও বাঁচার তাগিদে ছুটে চলা অজানা পথে, অপরিচিত অঙ্গনে, ভিন দেশে। আলীমের মতোই এমন গল্প প্রায় সব রোহিঙ্গাদের।

নিজের মা-বাবা, স্ত্রী, এক ছেলে, তিন বোন, দুই ভাইকে হারিয়েছেন আব্দুল আলীম। তিন বোনের মধ্যে দুই জনকেই নিজের চোখের সামেন ধর্ষণের শিকার হতে দেখেছেন। পৈশাচিকতার শেষে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। ছোট ভাইয়ের হাত ধরে বাংলাদেশের দিকে ছুটেছিলেন তিনি। তার মতই হাজার হাজার মানুষের ঢলের মধ্যে কখন যেন হাত থেকে ফসকে গেছে ছোট্ট ভাইটি। আজ দুই বছর পরও আতঙ্কে আছেন আলীম। মাঝে মধ্যে এখনও আঁতকে ওঠেন তিনি।

আজ ২৫ আগস্ট। এ দিনই মানবতার বিরুদ্ধাচারণ করে কলঙ্কজনক এক অধ্যায়ের সূচনা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার দুই বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন শুরু করে। ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।

জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার নানা উদ্যোগের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের আলোচনায় সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে যে কয়বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে প্রতিবারই রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।

রোহিঙ্গারা জানান, নিশ্চিত মৃত্যুর চেয়ে এমন মানবেতর জীবনযাপন করাই ভালো। নিজ দেশে ফেরত গেলে তাদের আবারও নির্যাতন করা হবে, মেরে ফেলা হবে এমন আতঙ্ক তাঁড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের।

এদিকে রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগের দুই বছর বছর পূর্তিতে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ২২টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কুতুপালং ডি-৪ নামক স্থানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে সমাবেশ করা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং ‘ভয়েজ অব রোহিঙ্গা’ সংগঠনের নেতা মাস্টার নুরুল কবির। এ সমাবেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ ১০টি কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এতে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার সমাবেশ ঘটানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন আয়োজকরা। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দারা মিয়ানমানের সেনা নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং দায়ীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন।

এর আগে ব্যাপক প্রস্তুতি ও উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনাগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত গত ২২ আগস্ট তাদের দেশে প্রত্যাবাসন কর্মসূচীর বাস্তবায়ন করা যায়নি। গত বছরের নভেম্বর মাসে একই রকমের একটি প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণেই ভেস্তে যায়। গত বৃহস্পতিবার প্রত্যাবসনের জন্য টেকনাফের নোয়াপাড়ার ২৬ নং ক্যাম্পের কাছে প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো বাস ও ট্রাক।

রোহিঙ্গাদের সংকট দিন দিন বাড়বে বলে মনে করছেন মানবধিকারকর্মী, শরণার্থী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য যে অর্থ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে আসছে তা ধীরে ধীরে কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা জানায়, আন্তর্জাতিক মহলের অগ্রহ কমে যাচ্ছে বিধায় রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থও কম আসছে। এতে করে আগামীতে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা খরচ করতে পারবে না। বাংলাদেশ সরকারের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১৫০টি সংস্থা রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য নিয়ে কাজ করছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য চেয়েছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও বাংলাদেশে সরকার। কিন্তু এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আগের বছরেও প্রতিশ্রুত সাহায্যের সবটুকু পাওয়া যায়নি। ঐ সাহায্য পেলে তার বড় অংশ খরচ হবে রোহিঙ্গাদের খাবারের জন্য বলে জানা যায়।

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নিজেদের তহবিল থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা শরণার্থীদের জন্য খরচ করেছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আবদুল মোমেনের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে। রোহিঙ্গারা সুখে বেশি দিন থাকবেন না বলে মন্তব্য করেছেন মন্ত্রী। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘প্রথম দিকে সাহায্য নিয়ে যেভাবে তারা অগ্রসর হয়েছিলেন, সে সাহায্যের মাত্রা কমে যাচ্ছে। আগামীতে আরো কমবে। আমরা ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা নিজেদের পকেট থেকে দিচ্ছি। এখন তো তারা খুব সুখে আছে। কিন্তু সুখে খুব বেশি দিন থাকবেন না। রোহিঙ্গাদের জন্য একদিকে বৈদেশিক সাহায্য কমছে’

উল্লেখ্য, নতুন ও পুরনো মিলিয়ে মিয়ানমারের ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস এখন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। সীমান্তবর্তী এই দুই উপজেলার ২৮টি পাহাড়ের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের দুই লাখেরও বেশি ঝুপড়িতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। এর প্রভাব পড়েছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারেই। ওই অঞ্চলের উন্নয়ন হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপত্তা ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে দুই উপজেলার বাসিন্দারা।

গত জুলাই মাসে বেসরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য ৩ শতাংশ বেড়েছে। প্রায় আড়াই হাজার পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এর বাইরে আরো এক হাজার ৩০০ পরিবার ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সেখানে ৪৬৪ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

এমএস/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি