ঢাকা, বুধবার   ১৬ জুলাই ২০২৫

বিদেশগামী শ্রমিকদের পদে পদে হয়রানি [ভিডিও]

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:৫৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের অর্থনীতির চাকা অনেকটা সচল থাকলেও, পদে পদে হয়রনি, প্রতারণা, দালালদের দৌরাত্ব আর ভোগান্তি যেন নিত্যসঙ্গী।

শ্রমিকদের বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল চেক-আপ বাধ্যতামূলক। দেশে সরকারি- বেসরকারি, নামী-দামী বা বিশ্বমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা বিভিন্ন মেডিকেল সেন্টার থাকলেও, হাতে গোনা কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করানো হয় বিদেশ গমনেচ্ছুদের মেডিকেল টেস্ট। এ’সব মেডিকেল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার একটি সিন্ডিকেটের হাতে থাকায় ভোগান্তির অন্ত নেই সেবা প্রার্থীদের। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রুভড মেডিকেল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন-গামকা ও অন্যান্য মেডিকেল সেন্টরাগুলোতে দুর্দশা এবং শ্রমিক ভোগান্তির কোনো শেষ নেই।

সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতারসহ মধ্যপ্রাচের লাখ লাখ শ্রমিক প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাঠাচ্ছেন। গেলো অর্থ বছরে ১ হাজার ৫শ’ কোটি ডলারের বেশি পাঠিয়েছেন শ্রমিকরা।

কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠিয়ে যে শ্রমিকরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন, পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয় তাদের। জনশক্তি রপ্তানি খাতে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিটি ধাপে ভোগান্তি যেন নিত্যসঙ্গী বাংলাদেশী শ্রমিকদের।

মধ্যপ্রাচ্যে গমনেচ্ছুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারগুলোর সমন্বয়কারি সংস্থা হল গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রুভড মেডিকেল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন-গামকা।

তবে মেডিকেল প্রত্যাশীরা এর নাম দিয়েছে গরীর মারার কারখানা। গামকা সিন্ডিকেট ও দালালদের দৌরাত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও, অবস্থার উন্নতি হয়নি।

দরিদ্র গ্রামীণ সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে গামকা। গামকার ভেতরে বাইরে রয়েছে শত শত দালাল। ছবি তোলার নামে ইচ্ছামত টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।

ডাক্তার, নার্স বা টেকনিশিয়ান ছাড়াই বিদেশ গমনেচ্ছুদের মেডিকেল করার নামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মেডিকেল সেন্টার নামধারী একশ্রেনীর প্রতিষ্ঠান।

মেডিকেল ফিটনেস কার্ড সংগ্রহের প্রতিটি ধাপে ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হয়ে যাত্রীদের। সাধারণ মেডিকেল পরীক্ষায় এক হাজার টাকা খরচ হলেও গামকায় নেয়া হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। এছাড়া দালালদের দৌরাত্বতো আছেই।

সৌদি আরব, কাতার, ওমানসহ ৫টি দেশে যাওয়ার জন্য গামকায় মেডিকেল ফিটনেস কার্ডের স্লিপ নেয়ার জন্য শত শত মানুষের দীর্ঘলাইন থাকে সবসময়ই। ভোর থেকে শুরু হয় লাইনে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা। ফিটনেস কার্ড পাওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মানুষ কাক ডাকা ভোরে লাইনে এসে দাঁড়ায় গামকা অফিসের সামনে।

কবির হোসেন দেড় যুগের বেশি সময় সৌদি আরবে থাকেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন ভিসা নিতে হচ্ছে তাকে। তাই মেডিকেল করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। ভোর থেকে দাঁড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে মেলেনি স্লিপ।

শুধু করিব হোসেন নয়, শত শত মানুষের অভিযোগ গামকার বিরুদ্ধে। সিন্ডিকেটের কারণে অসহায় তারা। গামকার বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও দালালদের দৌরাত্বের কথা জানান ভুক্তভোগীরা। বলেন, কোন কারণ ছাড়াই শুধু স্লিপ নেয়ার জন্য দিতে হয় ৫শ’ টাকা।

এ’সব অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে একুশের অনুসন্ধানে।

অনেক রিকশা চালকও জড়িয়ে পড়েছে দালালিতে। একুশের অনুসন্ধানী টিম এর প্রমাণ পেয়েছে। ক্যামেরা দেখা মাত্র তারা দায়িত্ব নেয় শৃংখলা রক্ষার।

এই রিক্সা চালকরাই গ্রামের সহজ সরল মানুষদের নিয়ে যায় দালালদের কাছে। ফটোকপি ও ছবি তোলার নামে হাতিয়ে নেয় টাকা।

গামকা অফিসের পাশেই সেলিম ফটো স্টুডিও। রিক্সা চালকরা এখানে নিয়ে যায় বিদেশগামীদের। এখান থেকে ছবি তুললে নেয়া হয় বাড়তি টাকা।

একুশের অনুসন্ধানী টিম সেলিম স্টুডিওতে গেলে মালিক পালিয়ে যায়। তবে, দালালি ও রিক্সা চালকদের কমিশনের বিষয়টি অস্বীকার করার চেষ্টা করে দুই দালাল।

কিন্তু ক্যামেরা ছাড়া অকপটে স্বীকার করে দালালীর কথা, যা ধরা পড়ে গোপন ক্যামেরায়।

দালালীর টাকা ভাগ বন্টনের বিষয়টি স্বীকার করে কয়েকজন রিক্সা চালক। আর কিছু দালাল নিজেদের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে।

শুধু সেলিমের স্টুডিওই নয়, আশপাশে আরো স্টুডিও ফাঁদ পেতে থাকে বিদেশগামীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য।

বিদেশ গমনেচ্ছুদের জন্য নির্ধারিত মেডিকেল সেন্টারগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে অসহায় সাধারণ মানুষ। টাকা হলে পেয়ে যান কাংখিত ফিটনেস কার্ড আর না হলে মেলে না। এমনই খামখেয়ালিপনা করে মেডিকেল সেন্টারগুলো।

স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারগুলোর সমন্বয়কারি সংস্থা হল গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রুভড মেডিকেল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন- গামকা। দেশে মানসম্মত সরকারি- বেসরকারি অনেক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও বিদেশ গমনেচ্ছুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়েছে মাত্র ৪৬টিকে। প্রতিজনের কাছ থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে আদায় করা হয় ৫ হাজার ৮শ’ ৫০ টাকা করে।

রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, এক্স-রে সহ কয়েকটি পরীক্ষার জন্য এই টাকা আদায় করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরীক্ষাগুলো বাইরের কোন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে করালে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা লাগার কথা। কিন্তু, অনেক বেশি টাকা নিচ্ছে গামকার মেডিকেল সেন্টারগুলো। আর টাকা না দিলে অনফিট করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ি প্রতিটি সেন্টারে পুরুষ-মহিলা ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোন মেডিকেল সেন্টারেই মহিলা ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান পাওয়া যায়নি।

আল ফালাহ মেডি-কম ক্লিনিক। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত এই সেন্টারটির বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ। এখানে অতিরিক্ত টাকা ছাড়া মেলে না ফিটনেস কার্ড।

সেবা প্রার্থীদের এমন অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মহিলাদের পরীক্ষা- নিরীক্ষা করছেন পুরুষরা চিকিৎসকরা।

তবে মানুষের অভিযোগ ও নিয়ম নীতির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন কর্মরত ডাক্তার ও মালিক।

আই আই আর ও মেডিকেল সেন্টার। সৌদি দূতাবাসের নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে এটি। কিন্তু, এখানেও স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়মিত বিদেশ গমনেচ্ছুদের পাঠানো হয় গামকার পক্ষ থেকে। এখান থেকে যারা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান, বিপাকে পড়তে হয় তাদের।

নিষিদ্ধ তালিকায় থাকার কথা স্বীকার করেছে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিরাও।

রাজধানীর একটি ক্লাবে বসে কথা হয় আই আই আর ও এর মালিকের সঙ্গে। নিষিদ্ধ তালিকায় থাকার পরও কেন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছেন, জানতে চাইলে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

এস. কে. এন. হেলথ সার্ভিস। রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত এই সেন্টারটির বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। নেই নারী ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান। এছাড়া, নির্ধারিত সময়ে ফিটনেস কার্ড না দেয়ায় বিপাকে পড়তে হয় অনেককে।

সেবাপ্রার্থীদের এ’সব অভিযোগের সদুত্তর দিতে পারেননি এর কর্মকর্তারা।

এবার নজর দিব মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেডিকেল সেন্টারগুলোর দিকে। রাজধানীর ফকিরাপুল, পল্টন, আরামবাগসহ আশপাশে রয়েছে অসংখ্য মেডিকেল সেন্টার নামধারী অর্থ উপার্জনের প্রতিষ্ঠান। কোন ডাক্তার বা টেকনিশিয়ান ছাড়াই এখান থেকে দেয়া হয় রিপোর্ট।

ইউরো-বাংলা ডায়াগনেস্টিক সেন্টার। বাহারী নাম হলেও কাজ পুরোই উল্টো। একজনকে দেখা যায় পরীক্ষার জন্য রক্ত নিতে। কিন্তু, ক্যামেরা দেখা মাত্র তিনি কাজ বন্ধ করে দেন। বর্ষা নামের এই নারী কোন ধরণের শিক্ষা ছাড়াই পরীক্ষা করেন রোগীদের।

ল্যাব ছাড়াই দেয়া হয় রিপোর্ট। একটি এক্স-রে মেশিন থাকলেও, কবে এটি চালু করা হয়েছিলো সেটি হয়ত জানা নেই কারোরই। রিসিপশনিস্ট শারমিন আক্তারই সব। তার হাতেই তৈরি হয় রিপোর্ট।

ডাক্তারদের সিল তৈরি করে রমরমা ব্যবসার কথা। হ্যাঁ, ফকিরাপুলের অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারদের সীল ব্যবহার করে ইচ্ছামত মেডিকেল রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে। আর গামকার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে খোদ বায়রারও।

ফকিরাপুলের ইউনিক ডায়াগনষ্টিক এন্ড স্পেশালাইজড সেন্টার। ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, দুই- তিনজন নারী ছাড়া আর কেউ নেই। মিলিনা, একাধারে রিসিপশনে কাজ করেন; সাথে সামলান টেকনিশিয়ানের দায়িত্বও। কয়েকজন ডাক্তারের নাম থাকলেও পাওয়া যায়নি কাউকেই।

রিপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে সিল দেয়া, মিলিনা সবই দেখালেন। একটি ফরমে সব ধরণের পরীক্ষা নিরিক্ষার নাম দেয়া থাকে; শুধু সিল মেরে, তাতে টিক দিয়ে দেন। বিনিময়ে আদায় করেন টাকা।

পাশেই রয়েছে আল হামাদ মেডিকেল সেন্টার। একটু বড় আকারের এই সেন্টারটিতে মেডিকেল ফিও অনেক বেশি। সেখানেও দেখা যায় অনেক ডাক্তারের সিল রয়েছে। কর্মকর্তা- কর্মচারিরা ইচ্ছামত সিল মেরে দিয়ে দেন রিপোর্ট।

সিল থাকলেও, ডাক্তার নেই কেন- এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলেনি তাদের কাছ থেকে।

এরপর একুশের অনুসন্ধানী টিম যায় অন্য একটি সেন্টারে। সেখানকার চিত্রও একই রকম। ফিটনেস কার্ডে শুধু ডাক্তারের সিল দিয়েই আদায় করা হয় টাকা।

ফকিরাপুলে অর্ধশত মেডিকেল সেন্টার এমন প্রতারণার ব্যবসায় জড়িত। কোন ধরণের পরীক্ষা নিরিক্ষা ছাড়াই মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট দিচ্ছে তারা।

গামকার বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতির সাথে। তিনিও স্বীকার করেন সীমাবদ্ধতার কথা। দালালদের দৌরাত্বে নিজেদের অসহায়ত্বের কথাও জানান তিনি।

আর, গামকার কার্যক্রমে অনেকটা নাখোশ বায়রা। বায়রায় মহাসচিব জানালেন, অনেক নিয়মই মানছেনা গামকা।

মেডিকেল ফিসহ অতিরিক্ত টাকা আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য না দিয়ে ইচ্ছা মত কার্যক্রম চালায় গামকা।

মেডিকেল ভোগান্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ে গেলে সচিব দায়িত্ব দেন অতিরিক্ত সচিবকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় বসিয়ে রেখে অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলামও কথা বলতে রাজি হননি।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি