ঢাকা, শনিবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বিস্ময়কর এক সংগ্রহশালা

প্রকাশিত : ২৩:০৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

কুড়িগ্রাম গিয়েছিলাম কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানের শুটিংয়ের জন্য। জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে টানা দু’দিন চষে বেড়াচ্ছি। চিলমারি বন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রামে। পরিবর্তনগুলো দেখছি আর মন ভরে যাচ্ছে। এই কি সেই কুড়িগ্রাম? একসময় এই কুড়িগ্রামকে নিয়েই দারিদ্র্যের কত গল্প? এসব এলাকা থেকেই এসেছিল দারিদ্র্যের এক অন্যরকম বিশেষণ ‘মঙ্গা’। যদিও সরকারি হিসাবে কুড়িগ্রামই বাংলাদেশের দরিদ্রতম জেলা।

এ জেলার দারিদ্র্যের হার ৭০.৮ শতাংশ। তারপরও যত দেখছি ভালো লাগছে। মানুষ পাল্টে গেছে। রাস্তাঘাট, সেতু সব পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে মানুষের জীবনধারা। ত্রিশ বছর আগে কুড়িগ্রামের যুগিরভিটা গ্রামে রূপচান বেগমের বাড়িতে গিয়ে অভাব দারিদ্র্যের গল্প শুনেছিলাম।

এতদিন পর সেই রূপচানের মুখেই শুনলাম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার গল্প। রূপচানের মতো অনেকেই সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। কুড়িগ্রাম এসে আব্বাসউদ্দিনের গানের কথা মনে পড়ে। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই ... কত রব আমি পন্থের পানে চাহিয়া রে...’। মনে হতো, এ গান পল্লীর দরিদ্র গৃহবধূর।

এবার মনে হল এই প্রতীক্ষার দিন শেষ হচ্ছে। মানুষ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যা হোক, এই যে পরিবর্তন, এর পেছনের কারণগুলো কী? তাও খুঁজতে ইচ্ছা করে। এখানে উন্নয়ন বা পরিবর্তনের জন্য মানুষ শপথ নিয়েছিলেন বেশ আগে। সময় আর সুযোগ ছিল না, তাই আটকে ছিল অনেক কিছু। এখন দিন বদলেছে।

গ্রামের কাঁচা রাস্তাগুলো পাকা হয়ে গেছে। সাঁকোর জায়গায় সেতু হয়েছে। গরুর গাড়ির বদলে এখন গ্রামের ভেতরের পিচঢালা রাস্তায় ইঞ্জিনের রিকশা চলে।

চিলমারি বন্দরে বসে সাধারণ মানুষের নানা গল্প শুনছি। আগে জমজমাট বন্দর ছিল। বন্দরের সেই জাঁকজমক দেখা মানুষগুলোর বেশির ভাগই এখন আর বেঁচে নেই। তবে এ চিলমারি বন্দরের অনেক স্মৃতি অনেকের মনে আছে।

এখানে একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন। স্বাধীনতার পর পর। খুব সংক্ষিপ্ত সফরে এসে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন। অনেকের কাছেই জানতে ইচ্ছা হল বঙ্গবন্ধু সেদিন কী বলেছিলেন? সে কথা তেমন মনে নেই কারোর। তবে এক দোকানদার বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি দেখার অভিজ্ঞতা বললেন বেশ গর্বের সঙ্গে।

আমার সহকর্মী আদিত্য শাহীন জানাল, তার সঙ্গে জানাশোনা আছে কুড়িগ্রামের প্রগতিশীল সংগঠক, আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকনের। তার কাছে জিজ্ঞাসা করে দেখা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রসঙ্গে।

লিংকন জানালেন, ১৯৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কুড়িগ্রামে এসে জনতার উদ্দেশে দেয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ তার কাছে আছে। তবে ভিডিও নয়, অডিও। সেই ভিডিও হয়তো কারও কাছেই নেই। যা হোক, অডিও আছে জেনেই বেশ কৌতূহল হল। জানিয়ে দিলাম সন্ধ্যার পর আপনার বাসায় আসব ভাষণটি শুনতে।

সব কাজ শেষ করে অনেকটা পরিশ্রান্ত হয়েই সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম কুড়িগ্রাম শহরের বেপারিপাড়ায় অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকনের বাসভবনে। শুনেছিলাম, তিনি নাকি একটি জাদুঘর করেছেন। বাইরে তার সাইনবোর্ডও পাওয়া গেল ‘উত্তরবঙ্গ মিউজিয়াম’। কিন্তু ছিমছাম দোতলা একটি বাড়ি।

লিংকন রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছিলেন। অনেকটা জড়িয়ে ধরে আমাদের নিয়ে গেলেন তার বাসায়। দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলাম। এটি বাসা নাকি জাদুঘর। চারদিকেই রাশি রাশি সংগ্রহ। ছবি আর ছবি। নানা উপকরণ অতি যত্নে রাখা। বোঝা গেল, এটিই উত্তরবঙ্গ জাদুঘর। তাহলে লিংকন সাহেবের বাসা কোনটি?

বললেন, এটিই বাসা, এটিই জাদুঘর। আরেকটু যোগ করে জানালেন, একবার দৈনিক সমকাল পত্রিকায় এ বাড়িটি নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘রাতে বসতবাড়ি, দিনে জাদুঘর’।

ড্রইংরুমের পাশের কক্ষে সংরক্ষিত একটি কফিন দেখে লিংকনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কার কফিন? বললেন, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কফিন। মনে পড়ল, এই তো সেদিনের কথা। ২৮ সেপ্টেম্বর চ্যানেল আই’র চেতনা চত্বরে জানাজার পর হক চাচার (সৈয়দ শামসুল হক) কফিনটি বয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম কুড়িগ্রামের উদ্দেশে। স্মৃতিনিদর্শন বলে কথা। তাই সবই আছে পরম যত্নে। লিংকন বললেন, সৈয়দ শামসুল হক একাধিকবার এ জাদুঘরে এসেছিলেন। তিনি উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি নির্দশন সংগ্রহের এ উদ্যোগে শুধু সাধুবাদ জানাননি, নানামুখী সহযোগিতা করারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আমি ঘুরছি আর অবাক হচ্ছি।

বহু দুষ্প্রাপ্য দলিল সংগ্রহ করেছেন লিংকন। উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের এত প্রামাণিক তথ্য-উপাত্ত ও দলিল আর কারও কাছে নেই। এখানে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা ও নানা প্রমাণপত্র। বিশেষ করে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী থেকে এখন যারা ছদ্মবেশ ধারণ করে পুরনো পরিচয় মুছে ফেলার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, তাদের নানা প্রমাণাদি রয়েছে। রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী। যেগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি করা এবং বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। দোতলার একটি কক্ষে অসংখ্য বই। দলিলের পর দলিল স্তরে স্তরে সাজানো। আরেক কক্ষে কিছু অডিও ভিজুয়াল উপকরণ।

এর মধ্য থেকেই বের করে কম্পিউটারে চালিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ ভাষণের অডিও তার সংগ্রহে। সেখান থেকে আমরা শুনছি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কৃষি নিয়ে কী কথা আছে, তা খোঁজার জন্য আমি কান পেতে আছি। পাওয়াও গেল নিমিষে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামীণ জীবনের কথা তুলে ধরছেন। ‘কোথায় আমার চাষের লাঙ্গল, মাংসের গরু?’ বলছেন, ‘এখনও একটি শ্রেণী আছে যারা লুট করতে চায়।’

বলছেন, মানুষকে ভালোবাসতে হবে। আমাদের দেশ এত ছোট নয়, আমার মানুষ একতাবদ্ধ, আপনারা ন্যায়ের পথে চলবেন, দেশকে ভালোবাসবেন।’ এক বসায় বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ভাষণের আংশিক শুনলাম। নীলফামারীতে ভাষণটি দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘বাংলার মানুষকে অবশ্যই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। হতে পারবে। মনে রাখতে হবে, শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ জন লোক গ্রামে বাস করে। গ্রাম যদি ধ্বংস হয়ে যায়, শহরও ধ্বংস হয়ে যাবে।’ বঙ্গবন্ধু এক জায়গায় বলছেন, ‘পলিমাটির এই বাংলা, চৈত্রে এই মাটি অস্ত্রে পরিণত হয়।’ একের পর এক অনেক ভাষণ শুনলাম। প্রতিটি বাক্যই অনবদ্য।

পুরো বাড়িই জাদুঘর। এর মধ্যেই ঘর-সংসার। এ এক বিরল উদাহরণ। লিংকন বললেন, আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না। আমরা যখন থাকব না, তখন শুধু জাদুঘরটি থাকবে। উত্তরবঙ্গের বহু স্মৃতি নিদর্শনের এক সংগ্রহশালা হয়ে টিকে থাকবে। এতেই আমাদের প্রশান্তি।

একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকনের পরিবারের রয়েছে অসামান্য অবদান। সেই চেতনা থেকে শিক্ষাজীবন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিদর্শন সংগ্রহের প্রতি ঝোঁক জন্মে তার। পরে যখন নিজে আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার কাজে হাত দেন, তখন একের পর এক জমা হতে থাকে উত্তর জনপদের আকর ইতিহাস আর দলিল। বিশেষ করে বিলুপ্ত ছিটমহলের বিপুল পরিমাণ তথ্য জমা হতে থাকে তার কাছে।

যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলের জনজীবনের নানা বিষয়। এতসব স্মৃতি নিদর্শন সংগ্রহে একই রকমভাবে নিয়োজিত হয়েছেন লিংকনের স্ত্রী বাংলার অধ্যাপক নাজমুন্নাহার সুইটি। রাতে চায়ের টেবিলে দু’জনের সঙ্গেই কথা হল। দু’জনেরই চিন্তা-চেতনা, উদ্দেশ্য ও প্রয়াস একই রকম। এ দম্পতির একটি মাত্র সন্তান শাশ্বত গৌরব সিদ্ধার্থ ঢাকায় পড়াশোনা করে। তাই বাসাটিকে তারা পুরোপুরি নিবেদন করতে পেরেছেন জাদুঘর হিসেবে। এ অনেক বড় এক কাজ।

লিংকন বললেন, ২০১২ সাল থেকে একটু একটু করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে এই জাদুঘর। কিন্তু যথাযথ নিরাপত্তা ও নিয়মানুযায়ী এগুলোকে সন্নিবেশিত করা যায়নি। এর জন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। বিজ্ঞানসম্মতভাবে দলিলগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। লিংকন জানালেন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এলে তার বাড়িসংলগ্ন একটি উপযুক্ত আয়তনের জমিও রয়েছে। জমিটি তিনি জাদুঘরের জন্য দিতে রাজি।

চলছে মহান বিজয়ের মাস। মুক্তিসংগ্রামের চেতনা আর ইতিহাসের অনেক ক্ষেত্র নিয়েই এখন কাজ হচ্ছে। দিনের পর দিন উঠে আসছে অনেক স্মৃতি। এ সময়ে কুড়িগ্রামের এ উত্তরবঙ্গ জাদুঘরটি আধুনিক নির্মাণশৈলী দিয়ে গড়ে তোলা হলে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম একটি সংগ্রহশালা। আর এক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা হিসেবে এক দৃষ্টান্ত হয়ে রইবেন।

শাইখ সিরাজ: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি