ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

বৃষ্টি ও জ্যোৎস্নার জন্য ভালোবাসা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:১৯, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গত কয়েক মাস ধরে দিনরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার এ্যান্ড রোবোটিক্স ডিপার্টমেন্টের ল্যাবরেটরিতে খাটাখাটুনি করছি আমরা চারজন। আমি, নিহাল, রুবিনা এবং রাতুল। আমাদের চারজনের টিমে রুবিনা একমাত্র মেয়ে। আমি বাদে প্রত্যেকেই তারা স্ব স্ব ডিপার্টমেন্টে সর্বোচ্চ সিজিপিএ প্রাপ্ত এবং রোবটিক্সের উপর তাদের কাজের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। রাতুল তো বায়ো-রোবটিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ এ বিশ্ব সেরাদের একজন। আমি এখনো অবাক হয়ে ভাবি কিভাবে আমি এই বিশাল বিশাল মেধাবীদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। যাইহোক একটা অপ্রয়োজনীয় তথ্য সবাইকে জানিয়ে রাখি, আমরা কেউই বিবাহিত নয়। কারণ দেশের সেন্ট্রাল কম্পিউটার থেকে আমাদের জন্য এখনো কোনো সঙ্গী ঠিক করে দেওয়া হয়নি।

কাজের মধ্যে সবাই ডুবে আছি ক্ষুধার্ত হাঙরের মত। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। ঘুমানোর সময় নেই। আদৌ আমরা ঘুমাচ্ছি কিনা টের পাচ্ছি না । কারন টিমের সবাই একটা ঘোরের মধ্যে আছি। কর্মক্ষমতা ঠিক রাখতে সেজন্য আমাদেরকে বিশেষ ধরনের পুষ্টি ট্যাবলেট খেতে হচ্ছে । তবে তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আসলে এই মুহূর্তে আমাদের কোন কিছুতেই আপত্তি নেই। আমাদের লক্ষ্য এখন একটাই-দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রজেক্টটি শেষ করা।

আমরা কাজ করছি রোবট রিবো-৭ কে নিয়ে । বিরো-৭ তৃতীয় প্রজন্মের শেষ মাত্রার রোবট। বায়োনিক হিউম্যানয়েড রোবট । দেখতে অবিকল মানুষের মত। সব ধরনের জটিল গাণিতিক হিসেব-নিকেষ ও বিশ্লেষণে পারদর্শী। সাধারনত জটিল ও তথ্যবহুল গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় রিবো-৭ ব্যবহার করা হয়। শহরের মানুষ গৃহস্থালী ও সাধারন কাজে প্রথম প্রজন্মের রোবট ব্যবহার করে । দ্বিতীয় প্রজন্মের রোবট ব্যবহৃত হয় সব ধরনের জটিল ও ঝুকিপূর্ণ কাজে।

তৃতীয় প্রজন্মের রিবো-৭ কে আপগ্রেড করা আমাদের প্রজেক্ট। আমাদের মূল কাজ রিবো-৭ কে সংখ্যা ও গাণিতিক বিশ্লেষণী ক্ষমতার পাশাপাশি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে হাইপোথেটিক্যাল বা বিমূর্ত প্রশ্নের ব্যাখ্যা দানের জন্য প্রোগ্রামিং করা। পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণের অস্তিত্বের ফিলোসফিক্যাল প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান করা। মানুষ কেন আসল, মৃত্যু কেন, মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যাবে, সৃষ্টিকর্তা কি আদৌ আছেন- এসব প্রশ্নের একটা বৈজ্ঞানিক সমাধান পাওয়ার জন্য পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানীরা গত কয়েকশ বছর ধরে উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা যদি পঞ্চম প্রজন্মের একটা প্রোগ্রামিং কোড তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণের বিকাশ নিয়ে যে প্রচলিত দ্বন্দ রয়েছে, তা নিরসন করা সম্ভব হবে। বিগ ব্যাং, ডারইউনের বিবর্তনবাদ কিংবা আধুনিককালের অন্যান্য তত্ত্বসমূহের বিতর্কের মীমাংসা হবে। আমরা রেলিজিয়াস গ্রন্থগুলোর সত্যতা নিরূপন করতে পারব- ঈশ্বরকে চূড়ান্তভাবে ধরতে পারব, নয়তো ছুড়ে ফেলে দিতে পারব। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যে প্রশ্নগুলো নিয়ে পীড়িতে হয়েছে- কার ঈশ্বর কত বেশী ক্ষমতাবান তাই নিয়ে রক্তক্ষয়ী ক্রুসেডে লিপ্ত হয়েছে, তার চূড়ান্ত উত্তর আমরা দিতে পারব। রিবো ৭ তখন পৃথিবী মানুষের দার্শনিক ও ধর্মীয় চেতনার জগৎ পাল্টে দিবে। আমরা হব সেই পরিবর্তনের প্রথম বিজ্ঞানী- এই শতাব্দীর প্রথম সারির মহাপুরুষ।

পৃথিবীতে বড় ধরনের একটা পরিবর্তনের কি এক ঘোরলাগা মোহে আমরা কাজ করে চলেছি। অমানুষিক একটা নেশা আমাদের পেয়ে বসেছে। আমরা সফল হলে ঐশ্বরিক অস্তিত্বের সত্যতা নিরূপণ করতে করব- একধাপে রোবটিক্স প্রজন্মকে পঞ্চম মাত্রায় নিয়ে যাব। সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের চিনবে। তরুণ মন একটু স্বপ্নেই বিচলিত হয়ে ওঠে, আর আমাদের সামনে এত বড় কিছু করার সুযোগ। আমাদের সবার রক্তে এখন আদিম উন্মদনা। কিছু একটা না হয়েই পারে না।

(২)
চতুর্থ মাসের মাথায় আমরা হাইপোথেটিক্যাল বা বিমূর্ত বিষয় বুঝতে সক্ষম এমন একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সমর্থ হলাম। রাতুল প্রোগ্রাম কোড লিখল। এর সমন্বয়ে রিবোর কপোট্রন তৈরি হল। এবার যাচাই করার পালা। প্রথমে আমরা রিবোর কপোট্রনে রেলিজিয়াস গ্রন্থগুলো আপলোড দিয়ে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলাম। রিবো এমনভাবে আমাদের সাথে কথা বলা শুরু করল যেন সে একজন ধার্মিক মহাপুরুষ। আপলোড করা গ্রন্থগুলো থেকে রেফারেন্স দিয়ে দিয়ে সে আমাদের বোঝাতে লাগল ঈ্শ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়ার কোন অবকাশ নেই এবং ঈশ্বর কত মহান। এবার আমরা পৃথিবীর সেন্ট্রাল ডাটাবেসে নাস্তিস্ক্যবাদসহ সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যত থিওরি বা তথ্য আছে, সব তার মেমোরিতে আপলোড করলাম। মজার ব্যাপার হল রিবো এবার নিরপেক্ষভাবে কথা বলা শুরু করল। সে আমাদের জানাল যে, ঈশ্বরের থাকা-না থাকা নিয়ে দুটি মত প্রচলিত আছে- তার দুদিকেই তথ্য প্রমাণসহ ব্যাখ্যা দিতে লাগল ।

“এতে তো কাজ হবে না।” খেপে উঠল রাতুল। “স্টুপিড রোবটটা দেখি শুধু আমাদের দেওয়া তথ্যগুলোই সাজিয়ে গুছিয়ে আমাদের সামনে হাজির করছে। সিদ্ধান্ত তো দিচ্ছে না।”

আমি অবশ্য নিরাশ হলাম না। বুঝতে পারলাম আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। গাণিতিক সূত্রের বাইরে গিয়ে রিবো যে বিমূর্ত ধারণাগুলো বুঝতে পারছে ও অন্তত সেগুলো প্রদত্ত ডাটাবেস ঘেটেঘুটে আমাদের জানাচ্ছে, এটাই বা কম কিসের। আমরা অগ্রগতির দিকে এগোচ্ছি ধরে নিয়ে সবকিছু আবার প্রথম থেকে যাচাই বাছাই করতে শুরু করলাম।

সপ্তাহ খানেক কেটে গেল। আমরা সমস্যার কিছুই ধরতে পারছি না ভেবে অসহায় অনুভব করতে শুরু করলাম। রুবিনা একবার মুখফুটে বলেই ফেলল- “এরকম রোবট আদৌ তৈরি করা সম্ভব কিনা!”

কিছুটা হতাশ হয়েই একদিন আমরা সবাই আড্ডা দিতে বসেছি। এটা সেটা নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে আমি ল্যাবরেটরির নতুন নিযুক্ত সিকিউরিটি- ইন- চার্জ লোকটির বিষয় তুললাম। “লোকটিকে আমার ভালো মনে হয়না ।” আমি বললাম। নিহাল আমার সাথে একমত হল- “ঠিক বলেছিস, আমারও তাই মনে হয়। দেখিস না ব্যাটা কেমন ড্যাব ড্যাব করে রুবিনার দিকে চেয়ে থাকে।” রুবিনা বলল, “সত্যিই তাই। আমি তোদেরকে কথাটি বলব বলব ভাবছিলাম।” রাতুল মাথা ঝাকাল। আমরা বুঝলাম রাতুলও ভাবছে- লোকটি সুবিধের নয়। আমাদের সাবধানে থাকতে হবে।
হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা ধারণা খেলে গেল । আমার মনে হল আমি বুঝি আমাদের সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছি। রিবো বিমূর্ত প্রশ্ন বুঝতে পারছে কিন্তু কেন সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না- এই সমস্যার সমাধান ।

আমি চোখ পাকিয়ে সবাইকে জিগগাসা করলাম- আচ্ছা বলত, লোকটি ভাল কি মন্দ?- এটি কি বিমূর্ত প্রশ্ন। সবাই স্বীকার করল- হ্যা, এটি একটি বিমূর্ত প্রশ্ন। তখন আমি বললাম, “তাহলে আমরা এই বিমূর্ত প্রশ্নের সমাধান করেছি, কি বলিস । কারণ আমরা সবাই একমত হয়েছি লোকটি মন্দ। এখন ভেবে দেখার বিষয় আমরা কিভাবে এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারলাম। এমনকি আমরা লোকটিকে চিনি না। আমদেরও কাছে তার সম্পর্কে কোন তথ্যও নেই।” সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি সেটা জানার আগ্রহ সবার চোখেমুখে।

আমি বলতে থাকলাম “তারপরও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি তার কারণ আমাদের মস্তিষ্ক অনুভূতিসম্পন্ন। আমরা কারো চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি সে কেমন। আমরা সবাই জানি, আমদের সারা দেহে দুই ধরনের নার্ভ আছে যা মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত। সেনসরি নার্ভস আর মটর নার্ভস। মটর নার্ভস দেহে জৈবিক কাজ যেমন হাত পা নাড়ানো আর সেনসরি নার্ভস কোন অনুভূতি যেমন আমদের হাতে যদি পিপড়া কামড়ায় সে অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌছে দেয়। এ দুটি কাজ একসাথে হয় বলেই আমরা কোন না দেখা বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারি। আর রিবোর কপোট্রনে রয়েছে শুধু মটর ফাংশন। রিবোর কপোট্রনে যদি আমরা অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারি তাহলে হয়ত রিবো বিমূর্ত প্রশ্নগুলোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষমতা লাভ করবে।” আমি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলাম।

সবাই আমার যুক্তি একবাক্যে মেনে নিল। এখন তবে কাজে নেমে পড়ার পালা। তবে সমস্যা আরো আছে। দেশে প্রচলিত আইনে এখনো রোবটে মানবিক আবেগ-অনুভূতি সৃষ্টি করার গবেষণা নিষিদ্ধ। এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক আছে বিজ্ঞানীদের মাঝে। দ্বিতীয় সমস্যা মানুষের মধ্যে অনেক ধরনের অনুভূতি আছে- রাগ, দুঃখ, ভালো লাগা, হতাশা, যৌনতা প্রভৃতি। আমরা কোনটি বেছে নিব, নাকি সবগুলো একসাথে সৃষ্টি করার চেষ্টা করব।

প্রথম সমস্যা মিটে গেল সহজেই। আমরা সবাই চরম গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম । আমরা তরুণ- আমরা যদি আইন না ভাঙি, তাহলে পৃথিবীতে পরিবর্তন আসবে কিভাবে! এই মন্ত্রকে আমাদের ভিশন বানিয়ে নিলাম।

দ্বিতীয় সমস্যার নিয়ে জটিলতা তৈরি হল। রুবিনার মতে যৌনতা কোনভাবেই দেওয়া চলবে না। রাগ, হতাশা ধ্বংসকারী আবেগ । তা দিয়ে বিপদের আশঙ্কা আছে। ভালো লাগা অনুভূতি সৃষ্টিই সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু তারও মাত্রাভেদ আছে। অল্প ভাললাগা থেকে তীব্র ভালো লাগা।

আমাদের মতবিরোধ যুক্তিতর্ক চলল দুদিন ধরে।

 
সবসময় নতুন নতুন আইডিয়া আমার মাথায়। সেজন্যই হয়ত একাডেমিক ফলাফলে সবার থেকে পিছিয়ে থাকলেও আমাকে এই প্রজেক্টে নেওয়া হয়েছে। আমি প্রস্তাব দিলাম- প্রেমানুভূতি সৃষ্টি হবে সবথেকে কার্যকর। সবাই আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল । আমি নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে বারবার এগোচ্ছি। ওরা জানে না যে নিষিদ্ধ বিষয়ে আমার আগ্রহ সবথেকে বেশি। আমি সবাইকে ব্যাপারটা বুঝানোর জন্য প্রাচীনকালে কিভাবে একটা ছেলে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ত, ছেলেটি কিভাবে মেয়েটির জন্য ফুল হাতে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকত, মেয়েটিকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য কত না ত্যাগ স্বীকার করত সবিস্তার বললাম। এও বললাম, সেই যুগে ছেলে মেয়েরা এমনকি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলত। আমি এত সুন্দর করে প্রাচীনকালের প্রেমের মাহাত্ম্য তুলে ধরলাম, আমার মনে হল, রুবিনা বুঝি একটু নরম হল। আমি মওকা পেয়ে আরো এগিয়ে নিলাম আমার বক্তব্য। ওদেরকে জানালাম, প্রাচীন মনীষীরা বলেছেন, প্রেম হচ্ছে একজন যুবক ছেলে ও যুবতী মেয়ের মধ্যকার তীব্র ভাল লাগার অনুভূতি আর এ আবেগের থেকে তীব্র আবেগ আর হয়না। তারা প্রেমকে স্বর্গীয় বা হেভেনলি বলেছেন তা জানিয়ে রাখতেও ভুললাম না। আমরা যদি কাক্সিক্ষত ফল পেতে চাই, তবে রিবোর কপোট্রনে অবশ্যই সবথেকে তীব্র যে অনুভূতি সেটি সঞ্চার করতে হবে। আর প্রেমানুভূতির চেয়ে আর ভাল বিকল্প কি হতে পারে! এই বলে আমি থামলাম। আমি লক্ষ করলাম সবাই আমার মতকে দেরিতে হলেও মেনে নিয়েছে।

আমি অবশ্য আর এগাতে চাচ্ছিলাম না। নিহাল ব্যাপারটিকে আরো এগিয়ে দিল। “প্রাচীন কিছু মনীষী তো এও বলেছেন, প্রেম হচ্ছে নারী পুরুষের মধ্যকার এক জৈবিক তাড়না- ও ছাড়া সেখানে কোন প্রেম থাকতে পারে না। সুতারাং যৌন অনুভূতিও দিতে হয়। না হলে যে প্রেমানুভূতি তীব্র হয় না?” নিহাল ব্যাখ্যা করল।

শেষমেষ অনেক তর্ক-বিতর্কের পর রুবিনার মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও আমরা রিবোর কপোট্রনে যৌনতাসহ কার্যকর তীব্র প্রেমের অনুভূতি সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের বয়সটা তো খেয়াল করতে হবে, নাকি?

(৩)
রাতুল খেটেখুটে কয়েকদিনের মধ্যে প্রেমের অনুভূতি তৈরি করতে পারে এমন একটা প্রোগ্রাম দাড় করিয়ে ফেলল। তবে এজন্য তাকে যে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হল তার সাক্ষী শুধু আমরা এই চারজন। সমস্ত মুখ রক্তাভ হয়ে গেছে। ঘুমহীন চোখের নিচে কালি পড়েছে । শুধুমাত্র একটা অদ্ভুত তাড়না যেন তাকে জাগিয়ে রেখেছে।

তবে এর মধ্যে আমাদের হাসি ঠাট্টা ঠিকই সমান তালে চলেছে।
নিহাল রাতুলকে টিপ্পনি কেটে বলেছে-
“এরে রাতুল, তুই কি কোনদিন প্রেমে পড়েছিস? না পড়লে প্রেমের অনুভূতি বুঝবি কেমনে রে?”
আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাতুল ফিসফিসিয়ে বলেছে- “কি বলিস! আমারতো সেই প্রাইমারি লেভেলে ক্লাসের একটা মেয়েকে ভালো লাগত, বোধ হয় আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম । তখন তো বুঝিনি, তবে মনে হয় ওতেই কাজ চালিয়ে নিতে পারব ।”
রুবিনা ওর ডান কানটি মুটিয়ে দিয়ে বলেছে- “তাই না! মিনমিনা শয়তান।”

কৈশোবের ক্ষণিকের সে অনুভূতি দিয়ে কাজ অবশ্য হয়নি। রাতুল কে দেখলাম দেশের মূল তথ্যভান্ডার থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ দাশ সহ সব আদিকালের কবিদের প্রেমের কবিতা ও সাহিত্য ডাওনলোড করে পড়তে। বিশ্বসাহিত্য থেকে রোমান্টিক কবি জন কীটস, রবাটর্ ফ্রস্ট, পারস্যের কবি রুমি, ওমর খৈয়াম, রোমান্টিসিজম আন্দোলনের পুরোধা কবি পার্সি বিশি শেলী ও গ্যাটে সহ সব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের লেখনীগুলোকে বিশ্লেষণ করতে যাতে প্রেমের একটা সুন্দর সম্পূণর্ সরূপ পাওয়া যায়। বাদ গেলোনা বৈষ্ণব পদাবলী, রাধা-কৃষ্ণ, লাইলী-মজনু, বেহুলা-লখিন্দর, কালকেতু-ফুল্লরা, চাদ সওদাগরের অমর প্রেম কাহিণীসমূহ থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে। খুব প্রাচীন এক সাধু বাৎসায়নের লেখনীর কথা আমি রাতুলকে মনে করিয়ে দিলাম।

আমি, নিহাল এবং রুবিনা লেগে আছি বিরো-৭ এর হার্ডওয়ার ঠিক করতে। প্রেমের মত মানবিক অনুভূতি দিতে হলে অবশ্যই এর কপোট্রনের বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় আবেশে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রসেসরকে যা সিলিকন দিয়ে তৈরি পাল্টাতে হবে আরো নরম সিলিকনে। ফটোসেলের টিউবগুলোতে আলোক তরঙ্গে আনতে হবে সঠিক মাত্রার তরঙ্গদৈর্ঘ্য। এর মানে পুরো নিউরাল নেটওয়ার্ক আবান নতুন করে সাজাতে হবে।

দু সপ্তাহ লাগল সবকিছু ঠিকঠাক করতে। রাতুল রিবোর কপোট্রনে তার প্রোগাম আপলোড করা শুর করল। আমরা সবাই দাড়িয়ে আছি দুরু দুরু বুক নিয়ে- সবাই সবার উত্তেজনাটা টের পাচ্ছি। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না । যেন একটু এদিক ওদিক তাকালেই কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাবে। আমরা কোন রিস্ক নিচ্ছি না। সবাই জানি, একটু পরেই পৃথিবীকে আমরা দিতে যাচ্ছি সর্বপ্রথম মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন যান্ত্রিক রোবট। মানব সভ্যতার ইতিহাস আবার নতুন করে লেখা শুরু হবে।

প্রতি সেকেন্ড পার হচ্ছে আর মনে হচ্ছে যেন একযুগ পেরিয়ে আসছি। প্রায় পাঁচ মিনিট পর হঠাৎ দেখি বিরো তার ফটোসেলের চোখ দিয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। রুবিনার দিকে চোখ পড়তেই রিবো স্থির হয়ে গেল। আর একদৃষ্টিতে রুবিনার দিকে চেয়ে রইল। তার ফটোসেলের চোখের আলোক তরঙ্গে নরম কোমল একটা তরঙ্গ খেলা করছে। সেখানে বিস্ময় আর ভালো লাগার আর্তি ফুঠে উঠেছে। আমরা সবাই বরফের মত জমে আছি। চরম অনিশ্চয়তা ঘিরে থাকা মানুষের মত এখনো বুঝে উঠতে পারিনি যে রিবোর কি হয়েছে।

আমরা সফল হয়েছি-বুঝতে পারলাম ঠিক তখন, যখন রাতুল চিৎকার করে বলে উঠল- “ইউরেকা!! ইউরেকা!! আমাদের রিবো প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়েছে।”

প্রাচীনকালের গ্রীকদেশের বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস নাকি তার সূত্রের সমাধান পাওয়া মাত্রই নগ্ন হয়েই রাস্তায় ইউরেকা!! ইউরেকা!! বলে দৌড় দিয়েছিল। আমরা কি করব কেউই বুঝতে পারছি না। তবে খানিকের মধ্যে আমরা নিজেদের সামলে নিলাম। এখন যাচাই করতে হবে আসলেই রিবো প্রেমিক হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা। রুবিনা প্রথম এগিয়ে এল। তার চোখেমুখে খটকালাগা ভাব। সেটা না লুকিয়েই সে রাতুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল- “এই রাতুল, রিবো তাহলে কার প্রেমে পড়ল রে? আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন?”

রিবো এখনো রুবিনার দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা সবাই চমকে উঠলাম। আমি স্পষ্টই টের পেলাম সেখানে শ্রীকৃষ্ণের বাশির সুর খেলা করছে। রাধা যেন তার সমুখে। রাতুল মিটিমিটি হাসছে। আমাদের আর কারো বুঝতে অসুবিধা হল না কি হয়েছে। রিবো সত্যিই প্রেমে পড়েছে। রুবিনার প্রেমে।

“আমি প্রোগ্রমিং করার সময়ই রুবিনার ছবিসহ ওর ব্যক্তিগত ডাটাবেস থেকে সব তথ্য আপলোড করে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি যে রিবো ওকে দেখামত্রই প্রেমে পড়ে যাবে। আমাদের হাতে সময় কই যে রিবোকে প্রেমে পড়া শেখাতে আর একটা মেয়ে রিবো তৈরি করব। আমি দুঃখিত রুবিনা।” রাতুল দুঃখ প্রকাশ করলেও কারোরই মনে হল না সে আসলেই দুঃখিত, বরং রাতুলের দুচোখে কৌতুক খেলা করছে।

রুবিনা খেপে যাওয়ার আগেই আমরা সবাই ওকে ঘিরে ধরলাম। “রুবিনা, প্লিজ সেন্টিসমন্টাল হইস না। তুই এখন আমদের প্রজেক্টের স্বার্থে, এই সমগ্র মানব জাতির স্বার্থে অভিনয় করবি যে তুইও রিবোকে ভালবাসিস। ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস।” আমি করজোড়ে অনুরোধ করলাম । কিন্তু আমিও কেন জানি ব্যাপারটা নিয়ে কৌতুকবোধ করছি।

“না হলে জানিসতো কি হবে!” নিহাল আমার সাহায্যে এগিয়ে এল। “প্রমিথিউসের মত রিভলবার দিয়ে নিজের কপোট্রন উড়িয়ে দেবে। রিবোর আত্মত্যাগ তোর কি তখন ভাল লাগবে । আমরা তখন তোকেও হারাব, রিবোকেও হারাব” । নিহালের চোখেও কৌতুক। রিবো আর রুবিনার প্রেমকাহিনী নিয়ে হঠাৎ যেন সবাই আমরা কৌতুক বোধ করা শুরু করে দিয়েছি।

কয়েকশবছর আগে লেখা হলেও জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনের এই গল্প আমরা সবাই জানি। এক খেয়ালী বিজ্ঞানী প্রথম মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন রোবট তৈরি করেছিল। নাম দিয়েছিল প্রমিথিউস। কিন্তু বিজ্ঞানীকে অবাক করে দিয়ে রোবটটি তার স্ত্রী বুলার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রমিথিউস যেদিন বুঝতে পারল- সে শুধু নিছক যন্ত্র, বুলাকে সে কোনদিন পেতে পারে না, সেইদিন সে তার  স্রষ্টা বিজ্ঞানীর রিভলবার দিয়ে কপোট্রনে গুলি করে নিজেকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে রুবিনা অবশ্য তার বিস্ময় আর ঘোর লাগা কাটিয়ে আমদের সাথে যোগ দিল। সেও ব্যাপারটা নিয়ে একটু একটু মজা পাওয়া শুরু করেছে। আমরা সবাই ঠিক করলাম রুবিনার সাথে রিবোর একটা কথোপকন ভিডিও করে রাখব।

রুবিনা কাছে এগিয়ে যেতেই রিবোর মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা গেল।
“রিবো, আমি কে?” রুবিনা আস্তে করে বলল ।
“তুমি কে আমাকে বলতে হবে!” ঠিক মানুষের মত অভিমান রিবোর কন্ঠে। আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। রাতুল সুন্দর একটা ভিডিও নিতে ব্যসÍ।

“তবু বল। তোমার মুখে আমার নাম শুনতে ভাল লাগে।”
“তুমি আমার রুবি। তোমার নাম অবশ্য রুবিনা প্রেসিত । আমি আদর করে তোমাকে রুবি বলে ডাকি।”

এই বলে রিবো মিষ্টি করে ডাকতে থাকে- “রুবি, রুবি, এই রুবি।” সেই ডাকে কোন যান্ত্রিক ভাব নেই। আর সেই ডাক এত মিষ্টি লাগল যে আমরা সবাই অভিভূত হয়ে পড়লাম।

“আমাকে ভালবাস?”
“খুব ভালবাসি। জানো, প্রথম যেদিন তোমার সাথে সমুদ্র সৈকতে দেখা হয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম বুঝি অপূর্ব সুন্দরী কোন মৎস্যকন্যা সমুদ্রকূলে হেটে বেড়াচ্ছে। আমি সেদিন থেকে যেন তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। ইচ্ছে করে শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে থেকে সময় কাটিয়ে দিই।”

রুবিনার মনের মধ্যে এখন কি হচ্ছে আমি জানি না। আমি নিজে হঠাৎ করে চরম আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। মনে হল, আমি রুবিনার জায়গায় থাকলে এই যান্ত্রিক রবোটটির সাথেই আমার সারা জীবন কাটিয়ে দিতাম। রুবিনার দিকে এই প্রথম আমি অন্যচোখে তাকালাম। ও সত্যিই অসাধারন সুন্দরী একটা মেয়ে অনুভব করলাম।

রিবোকে তৈরি করা হয়েছে ছমাস আগে ঢাকা রবোটিক্স এর ফ্যাক্টরিতে। তার সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার প্রশ্নেই ওঠেনা-রুবিনার সাথে দেখা হওয়া তো দুরে থাক। তাহলে রাতুল নিশ্চয় রিবোর মেমোরি সেলে এসব স্মৃতি প্রোগ্রাম করে দিয়েছে। আমি ভাবলাম।

“তুমি কি চিরকাল আমাকে ভালবাসবে?”
“হ্যা।”

অন্যসময় হলে রিবো চিরকাল মানে কতদিন কত ঘন্টা মিনিট আর কত সেকেন্ড এসব হিসেব করতে শুরু করে দিত। আমরা বুঝতে পারলাম রিবো আসলেই প্রেমে পড়েছে আর আমরা পৃথিবীতে প্রথম সত্যিকারের মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।

(৪)
রিবোর কপোট্রন মানুষের মস্তিষ্কের আদলে বিশেষভাবে আমরা তৈরি করেছি। আমাদের মস্তিষ্কের মত করে কপোট্রনে একটা ফ্রন্টাল লব তৈরি করে সেখানে প্রোগ্রাম করা প্রেম নামক এক বিশেষ মানবিক অনুভূতি যান্ত্রিকভাবে সেট করা হয়েছে। এটি এখন কপোট্রনের বাকি অংশ প্যারাইটাল লবের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে সব ধরনের যুক্তি ও গানিতিক বিশ্লেষণ করার কথা । এখন আমাদের কাজ রিবোকে বিমূর্ত প্রশ্নের সমাধানের জন্য প্রস্তুত করা। তবে আজ আর না। এই প্রথম আমাদের মনে হল আমাদের ঘুম পেয়েছে। একটু আরাম করে ঘুমানোর দরকার।

একে একে আমরা রিবোর কাছে বিদায় নিলাম। রুবিনা যখন বিদায় নিতে গেল, হঠাৎ করে রিবো কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে উঠল। সবাই ল্যাবরেটরি থেকে বের হয়ে গেলে রিবোকে জানালার পাশে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। নীল আকাশ। একটুও মেঘ নেই। নিশ্চয় আজ রাতে জ্যোৎন্সা উঠবে। আমার মনে হল রিবো বোধহয় সারারাত এই জ্যোৎন্সালোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটিয়ে দেবে। জ্যোৎন্সা কি রিবো জানে না। তার কাছে এই অপূর্ব সুন্দর আকাশটাকে নিশ্চয় খুব বিষণ্ণ মনে হবে। খুব বিষণ্ণ।

রাতে ঘুমালাম মড়ার মত। ঘুম ভাঙল রাতুলের ভাঙা গলার ডাকাডাকিতে। ব্যাটা একেবারে হলোগ্রাফিক টেলিফোনে আমার রুমে হাজির হয়েছে।

“এ উঠ, তাড়াতাড়ি উঠ। একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।” হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে রাতুলের ভয় পাওয়া চেহারা । রিবো কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলল কে জানে? রোবটের মধ্যে মানবিক অনুভূতি দেওয়ার এখনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। জানাজানি হয়ে গেলে জেল পুলিশ করতে হবে। ভয়ের একটা শীতল অনুভূতি আমার শীরদাড়া বেয়ে নেমে গেল। গত দুমাসের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ক্লান্তি আর বিস্ময়কর সফলতার উত্তেজনা আমাকে বিছানার সাথে মিশিয়ে দিয়েছে যেন। শরীরটাকে তবু অনেক কষ্ট করে টেনে তুলে ঘুমের পোশাক পরেই ল্যাবরেটরি দিকে ছুটলাম।

পৌছে দেখি সবাই আমার আগেই সেখানে হাজির। কি হয়েছে বুঝতে সময় লাগল না। রিবোর কপোট্রনের ফ্রন্টাল লবটি শুধু কাজ করছে । বাকিটা পুরো অন্ধকার । রাতুল সকালে এসে মেইন প্রোগ্রামিং কম্পিউটারের সাথে রিবোকে জুড়ে দিয়েছে পৃথিবীর সেন্ট্রাল নলেজ ডাটাবেস তেকে আরো অনেক তথ্য আপলোড করার জন্য। কিন্তু রিবো কিছুতেই কোন তথ্য নিচ্ছে না। তার গাণিতিক যুক্তিপূর্ণ অংশটি পুরো অকেজো হয়ে পড়েছে । রিবোর কপোট্রনের ফ্রন্টাল লব যেখানে আমরা খেয়ালের বশে রুবিনার জন্য আবেগ তৈরি করে দয়েছি, কপোট্রনের সেই অংশটুকু দিয়ে রিবো এখন শুধু ডাটাবেসে রুবিনাকে খুজে বেড়াচ্ছে।

আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে রিবোকে জিজ্ঞাসা করলাম, রিবো বলত ১ আর ২ যোগ করলে কত হয়। রিবো কিছু না বলে হা করে তাকিয়ে থাকল । তার চোখ দুটি রুবিনার দিকে নিবদ্ধ করা।

আকাশ ভেঙে পড়ল আমাদের মাথার উপর। আমাদের লক্ষ্য ছিল রোবটের মধ্যে অনুভূতির সৃষ্টি করে তাকে বিমূর্ত প্রশ্ন ও তত্তে¡র ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সক্ষম করে তোলা। আর এ দেখি এখন ১ আর ২ যোগ করতে পারে না। শুধু প্রেমের আবেগ সম্পন্ন রোবট দিয়ে আমরা কি করব? আমাদের স্পনসর কোম্পানি এক টাকাও দেবে না এর জন্য। পৃথিবীতে কোন কার্যকর ক্ষমতা ছাড়া প্রেমানুভূতির কোন দাম নেই আমদের সময়ে।

আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে প্রফেসর ড. গোলাম দস্তগীর স্যারকে জানাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি আমাদের এই প্রজেক্টের সুপারভাইজার। আমরা ব্যাপারটি এতদিন তার কাছ থেকে গোপন করে গেছি, এ ভেবে যে প্রেম আবেগের মত একটা ছেলেমানুষি অনুভূতি দিতে তিনি রাজি হবেন না। আর তারূণ্যের বাধভাঙা উচ্ছ¡াসে আমরা এতদিন এইসব করে এসেছি। আমরা ভেবেছিলাম আমরা যদি রিবোকে দার্শনিক করে তুলতে পারি, তাহলে তার মধ্যে কিসের অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়েছে তা গৌণ হয়ে পড়বে।

ড. গোলাম দস্তগীর খুব হাসিখুশি মানুষ নয়, তবে তিনি খুব সুন্দর করে আমাদের বয়সী মানুষের সাথে মিশে যান। আমার মনে হয় স্যার আমাদের চোখের দিকে তাকালেই আমরা কি চাই কি ভাবছি সব বুঝতে পারেন। একা মানুষ তিনি। বিয়ে করে সংসার পাতেননি দেশে কে কার সাথে বিয়েথা করবে তা সেন্ট্রাল কম্পিউটার ঠিক করে দেয়। সেখানে সবার ডাটাবেস করা আছে। কম্পিউটার তা বিশ্লেষণ করে বলে দেয় কার সাথে কার বেশি মিল আছে । তাকেই তখন বিয়ে করতে হয়। দেশের মানুষের মধ্যে সুষম সহাবস্থান তৈরি এর উদ্দেশ্য। ব্যাপারটি সম্পূর্ণ যান্ত্রিক হওয়ায় স্যারের তা পছন্দ হয়নি । এ কারণে তিনি সংসার পাতেননি। এটা সবাই জানে। কিন্তু আসল কারণটা আমরা চারজন জানি শুধু। স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার এক বান্ধবীর প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু সেন্ট্রাল কম্পিউটার তার জন্য অন্য মেয়ে ঠিক করেছিল। স্যার তার বান্ধবীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কোন অজানা এক গ্রহে। মেয়েটি খুব কেদেছিল কিন্তু এত ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে যেতে চায়নি। দেশের আইন অবমাননা করার জন্য অবশ্য স্যারকে অনেক সমম্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল । কোন সাধারণ মানুষ হলে হয়ত তাকে চরম শাস্তির সম্মুখীন হতে হত । কিন্তু দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রোবট বিজ্ঞানী হওয়ায় তাকে ক্ষমা করা হয়েছিল। রিবো-৭ তৈরিতে তার ভূমিকা দেশের সব মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।

স্যার প্রথমে আমাদের সমস্যাটি মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর মেইন প্রোগ্রামিং কম্পিউটারের সামনে বসে যাচাই করে দেখলেন। তারপর যা ঘটল তার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। স্যার আমদের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। আমরা তো ভেবেছিলাম বোধহয় তিান আমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেবেন অথবা কিছু না হলেও এই প্রজেক্ট থেকে বের করে দেবেন।

“তোমরা তো একটা অসাধ্য সাধন করে ফেলেছ!” স্যার প্রথমে আমদের উচ্চকিত প্রশংসা করে আশ্বস্ত করলেন। তারপর ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করলেন।

“তোমরা কি কেউ কখনো কোন যুবতী সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছ?” আমার হঠাৎ মনে হল স্যারের উপর তারূণ্য ভর করেছে। তবে কেউ আমরা তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলাম না। কারণ সবাই জানি, এখন আর কেউ প্রেম করেনা, প্রয়োজনও হয়না । সেন্ট্রাল কম্পিউটার সব জোড়া ঠিক করে দেয়- বংশবৃদ্ধি আর সুষম সহাবস্থান ছাড়া যার আর কোন উদ্দেশ্য নেই।

“আমি জানি পড়নি।” স্যার নিজেই উত্তর দিয়ে আবার শুরু করলেন। “তাই তোমরা বোঝনি । বোঝার কথাও নয়। প্রেম এমন একটা সর্বময়ী অনুভূতি যা এই যান্ত্রিক রোবটের কপোট্রন ধারণ করতে পারে না। প্রেম তো শুধু মানুষের মস্তিষ্কের বিষয় নয়- এ অনুভূতি থাকে মানুষের হৃদয় নামক একটা স্থানে। মেডিকেলের ভাষায় যার নাম হার্ট। সে জিনিস তোমরা কিভাবে যন্ত্রে লাগাবে? প্রেম একটা সর্বগ্রাসী আবেগ- কোন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, সেই অনুভূতি তখন তার সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর রোবট সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন এউ সর্বভূক আবেশকে সামলাবে কি করে?”

আমরা এই প্রথম সবাই বুঝতে পারলাম কেন রিবোর কপোট্রনের প্যারাইটাল লব অকেজো হয়ে পড়েছে। আমরা তার ফ্রন্টাল লবে প্রেমানুভূতি সৃষ্টি করেছি বটে কিন্তু সেখান থেকে যে মাত্রায় বায়ো- চৌম্বকীয় আবেশ তৈরি হয়েছে, তা রিবোর পুরো কপোট্রনকে আবেশিত করে ফেলেছে। রিবো কপোট্রনের অন্য সব গাণিতিক প্রোগ্রামিং কোড তাই মুছে গেছে।

আমরা সবাই রুবিনার দিকে ফিরে তাকালাম । কৌতুকতা আমাদের চোখেমুখে। যুবতী মেয়ের প্রতি প্রেম কি ধ্বংসকারী জিনিষ! মনে মনে ভেবে শিউরে উঠলাম।

আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে নিহাল বলল-
“ভাগ্যিস, আমরা কেউই রুবিনার প্রেমে পড়িনি! তাহলে কি যে হত। শালার মাথামুথা সব বøাঙ্ক (খালি) হয়ে যেত ।”

সবাই আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম । রুবিনা কটমট করে আমাদের দিকে তাকাল। আমি আবার রুবিনাকে দেখলাম। মেয়েটি সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী। গায়ে কাঁপুনি ধরা সুন্দরী। মাথামুথা বøাঙ্ক হওয়ার ভয় সত্তে¦ও কেন জানি মনের মধ্যে রুবিনার জন্য চিনচিনে ব্যথা লাগা শুরু হল। ব্যথা তবে আমার মস্তিষ্কে মধুর আবেশ টের পেলাম।

সিরিয়াস রাতুল আমাদের হাসিতে যোগ না দিয়ে স্যারকে জিজ্ঞাসা করল- “এখন আমরা কি করব স্যার? তাহলে কি অনুভূতি সৃষ্টি করার ব্যাপারটি বাদ দিয়ে দেব?

স্যার হাসিহাসি মুখে বললেন, “না না, তা কেন? বরং চেষ্টা করে দেখ যুবতী মেয়ের প্রতি প্রেমানুভূতি ছাড়াও মানুষের আরো অনেক ভালো লাগার অনুভূতি আছে, সেগুলো রিবোর মধ্যে সৃষ্টি করা যায় কিনা। এই যেমন ধর, সবুজ প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা; বৃষ্টি ও জ্যোৎন্সার জন্য ভালোবাসা। বৃষ্টি ও জ্যোন্সার মত এত সুন্দর কিছু পৃথিবীতে আর কি কিছু আছে?”

আমি দেখলাম স্যার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। আর রাতুল ত্রস্তভাবে প্রোগ্রামিং কম্পিউটারের দিকে এগোল। তাকে এখন নতুন করে বৃষ্টি ও জ্যোৎন্সার জন্য ভালবাসা সৃষ্টি করে এমন একটা প্রোগ্রাম লিখতে হবে।

লেখক পরিচিতি

ইটিভি অনলাইনের জন্য সায়েন্স-ফিকশন এই গল্পটি লিখেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক মোস্তফা হাসান। আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করার পাশাপাশি নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেন মোস্তফা হাসান। ছোট গল্পের পাশাপাশি নিয়মিত কাব্য চর্চাও করেন তিনি।

//এস এইচ এস//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি