সবুজ পর্যটক টেকসই পর্যটন শিল্প
প্রকাশিত : ১৯:২০, ৫ অক্টোবর ২০২৫

এক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর আমরা পর্যটননগরী কক্সবাজারে যাই। সর্বপ্রথম কক্সবাজারে গিয়েছিলাম ২০০৭ সালে বিভাগীয় শিক্ষা সফরে। প্রথমবার ও শেষবারের ভ্রমণের মধ্যে দেড়যুগের ব্যবধানে আরও ৫/৬ বার বিভিন্ন কারণে কক্সবাজার ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। সবচেয়ে বিবর্ণ কক্সবাজার চোখে পড়েছে শেষবারের ভ্রমণে। একদিকে সাগরের ঢেউ খেলা লোনাজল আরেকদিকে সারি সারি বিশাল বিশাল বিল্ডিং। পাহাড়ঘেষা সাগরপাড়ে ঝাউবন এবং বিভিন্ন লতাপাতার সবুজ আস্তরণ থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। আর বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম সৈকতে বিচরণ করতো ছোটবড় লাল কাকড়া। সফেদ ঢেউয়ের সঙ্গে সৈকতে আছড়ে পড়তো শামুক, ঝিনুক, মাছসহ নানা সামদ্রিক প্রাণী। পাহাড় আর সাগরের প্রেমের মিতালী যখন ছিল তখন হয়তো প্রাকৃতিক এই মনরোম দৃশ্যই ছিল। প্রেমিক পাহাড়ের কাছে হাসিমুখে উপহার হিসেবে লাল কাকড়া, মুক্তা ভরা ঝিনুক, ছোট ছোট মাছ ও জলজ প্রাণী হাসির ঢেউয়ে ভাসিয়ে তীরে পাঠাতো সাগর। ঝাউবনের ছায়ায় সবুজ গালিচায় প্রেমিকার পাঠানো ভালোবাসার উপহার পাদদেশে সযত্নে আগলে রাখতো পাহাড়। কিন্তু এই প্রেমের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে তীর ঘেষে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেলের দেওয়াল।
পাহাড় আর সাগরের ভালোবাসা যেন শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের ক্রীতদাস তাতারী ও বাদী মেহেরজানের ভালোবাসার করুন পরিণতি। মেহেরজানের ভালোবাসায় সিক্ত গোলাম তাতারী হৃদয় উৎসারিত হাসি মাতিয়ে তুলেছিলে বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশীদের বাগান। সেই হাসি পাগল করে উপন্যাসের খল চরিত্র স্বৈরাচারী শাসক হারুনুর রশীদের হৃদয়ও। হাসির প্রতি তীব্র ভালোবাসা অন্যায় নয় বরং সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু হাসির প্রতি তীব্র ভালোবাসা বাদশাকে করে তোলে স্বৈরাচারী। ক্রীতদাস তাতারীর সৌন্দর্য মণ্ডিত হাসিতে নিজের জীবনকে ধন্য করতে বন্দি করা হয় তাতারীকে। বাদী মেহেরজান হয়ে যান বেগম। কিন্তু তাতারীর মুখে হাসি ফোটেনি আর কোনদিন। বিদ্রুপের হাসি উপহার দিয়ে জীবন ত্যাগ করে সেই গোলাম তাতারী। কক্সবাজার যদি উপন্যাস হয় সেই উপন্যাসের বাদশাহ হারুনুর রশীদ আমরা সবাই। সমুদ্রের ঢেউ আর অপরুপ সৌন্দর্য আমরা উপভোগ করতে চাই বাদশা হারুনুর রশীদের মত গলাটিপে। বড় বড় দালান উঠিয়ে কাচে ঘেরা এসি রুমের বাতাসে বসে উপভোগ করছি সফেদ ঢেউ। কিন্তু কানে বাজে না সাগরের কলতান। সাদা ঢেউ আছড়ে পড়লেও সেটি হাসির নয়। প্রেমিক পাহাড়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে দালানগুলো। উপহার গ্রহণের জন্য ছায়া বিছিয়ে সবুজ গুল্ম ও ঘাসের আস্তরণ বিছিয়ে অপেক্ষাও করছে না পাহাড়। তাই সাগর তীরে কাকড়া ও মাছের পরিবর্তে ভেসে আসে প্লাস্টিকের বোতল আর চিপসের প্যাকেট। মাঝেমধ্যে প্রাণহীন তিমি/ডলফিন পাঠিয়ে বেদনার তীব্র আর্তনাদ প্রকাশ করে সাগর। সঙ্গীহীন ও সৌন্দর্যহীন কক্সবাজার হয়তো একদিন খলিফা হারুনুর রশীদের গোলাম তাতারীর মত তিলে তিলে মৃত্যুতেই পতিত হবে আমাদের সর্বগ্রাসী আচরণের কারণে।
কক্সবাজার আমাদের গর্বের প্রাকৃতিক সম্পদ। জগৎ জুড়ে এর নাম আছে। বিশ্বের দীর্ঘতম ১০ সমুদ্র সৈকতের তালিকায় বাংলাদেশের কক্সবাজারের অবস্থান তৃতীয়। ১৫০ মাইল দৈর্ঘ্যরে ব্রাজিলের সমুদ্র সৈকত প্রাইয়া দো ক্যাসিনো সর্ববৃহৎ আর ৭৫ মাইল দৈর্ঘ্যের কক্সবাজার বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। তবে নামের সঙ্গে ডাক আনার কাজটি আমরা করতে পারিনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণের মাধ্যমে ভ্রমণপযোগী করতে না পারায় বিশ্ব পর্যটকদের কাছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কোন আবেদন নেই। প্রতিবেশি দুটি দেশের সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ছোট। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে বাণিজ্যিক সাজ্জসজ্জা আরও আকর্ষণীয় এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। ফলে দেশ দুটিতে পর্যটন অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অনলাইনভিত্তিক ভ্রমণ পর্যালোচনা প্লাটফর্ম ‘ট্রিপ অ্যাডভাইজার’ সম্প্রতি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় ১০টি সমুদ্র সৈকতের তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই তালিকায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার স্থানই পায়নি। তালিকায় প্রথম স্থানে আছে গ্রিসের এলাফোনিসি বিচ এবং দ্বিতীয় স্থানে আছে থাইল্যান্ডের বানানা বিচ। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত নিয়ে বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণ খুবই সীমিত। এর প্রমাণ মেলে দুদিনের ভ্রমণে একজন বিদেশিও আমাদের নজরে পড়েনি।
শুরুতেই উল্লেখ করেছি এবারের কক্সবাজার ভ্রমণের উদ্দেশ্য নীল অর্থনীতি ও পর্যটন বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া। অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত দুুদিনব্যাপী এ প্রশিক্ষণে আমরা ৬০ জন অংশ নিই। এবার আমরা ঢাকা থেকে ট্রেনে রওয়ানা করি। কিছুটা বিলম্বে ট্রেন ছেড়ে যাওয়া পুরোপুরি বিরক্ত তৈরি না করলেও খটকা লাগে। আগের মতই ট্রেনের যাচ্ছেতাই অবস্থা এখনও বিরাজমান। মন্থর গতির দীর্ঘসময়ের যাত্রা অনেকের কাছে বিরক্তি তৈরি করে। ২১ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টার মধ্যে আমরা দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছে যাই। পর্যটন নিয়ে পরিকল্পনার অভাব স্টেশন থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে অটোওয়ালাদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির মাধ্যমে শুরু হয় ভ্রমণ পর্ব। বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য অটোই একমাত্র ভরসা। পর্যটক দেখলেই তারা ভাড়া হাঁকে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত। খাদ্যপণ্য ও ভ্রমণে ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রীর দাম তুলনামূলক অনেক বেশি। সবচেয়ে মারাত্মক দিক হলে মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি। এমনকি ভেজাল ও নকল আচার, শুটকী ও চকলেট যেন সমুদ্র সৈকতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। নকল শামুকের তৈরি গহনার মেলা যেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। পুরো কক্সবাজার জুড়ে সবচেয়ে বেশি হাহাকার বিনোদন ব্যবস্থার। সময় কাটানোর মত জলভিত্তিক বা স্থলভিত্তিক কোন ধরনের গেমিংজোন নেই কক্সবাজারে।
তবে প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্যের নীলাভূমি অব্যবস্থাপনায় ম্লান হলেও ফুরিয়ে যায়নি। বিপন্ন কক্সবাজারকে প্রাণবন্ত আকর্ষণীয় ও পর্যটকবান্ধব করে গড়ে তোলার উপায় বাতলে দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না। প্রশিক্ষণে উপস্থাপন করা প্রেজেন্টেশনে তিনি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে গলাটিপে হত্যা না করেও সম্পদশালী কক্সবাজার গড়ে তোলার কিছু কৌশল উল্লেখ করেন। সেই উপায়ের নাম ‘সাসটেইনেবল টুরিজম’ বা টেকসই পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা। এখানে উল্লেখ করতে চাই, গত ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল ‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’। পর্যটন দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘টেকসই উন্নয়নে পর্যটন’। এই টেকসই পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার দায়িত্ব ভ্রমণপিপাসু হিসেবে আমাদের নিজেদেরই। এজন্য আমাদের হতে হবে ‘গ্রিন ট্যুরিস্ট’ বা সবুজ পর্যটক। সবুজ ভ্রমণকারী হতে ১১টি গুণের তরিকা বাতলে দেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না। এই কৌশলগুলো হচ্ছে- পুন:ব্যবহারযোগ্য পানির পাত্র ব্যবহার, পুন:ব্যবহার যোগ্য ব্যাগ ব্যবহার, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়া, খাবার গ্রহণে প্লাস্টিকের নল (স্ট্র) ব্যবহার পরিত্যাগ করা, পানি সাশ্রয়ী হওয়া, নিজেকে উপযোগী হিসেবে প্রমাণ করা, খাবারে প্লাস্টিক বাসন ব্যবহার না করা, পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহার করা, স্থানীয় শুভেচ্ছা স্মারক বিনিময় করা, দায়িত্বশীল ভ্রমণকারী হওয়া এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রাখা।
এই গুণাগুন অর্জনের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অনেক কর্মকাণ্ড সীমিত করা সম্ভব। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর উপকরণের ব্যবহার বন্ধ বা সীমিত করা সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় যে কাজটি করতে হবে স্থানীয়দেরকে পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা। সহযোগীতামূলক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের বাড়ী-ঘরগুলোকে পর্যটকদের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহারে বৈশ্বিক কৌশলগুলোকে রপ্ত করাতে হবে। আবাসন সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের চাহিদা অনেক বাড়বে। এতিহ্যবাহী পণ্য সামগ্রীর বিক্রি বাড়বে। এতে একদিকে তারা যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে অন্যদিকে পর্যটকরা সাশ্রয়ীভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। এভাবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে টেকসই পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। আর সবার আগে আমাদেরকে নিজেদেরকে সবুজ পর্যটক হওয়ার জন্য উদ্যোগৗ হতে হবে।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিকেশন বিভাগ, এনআরবিসি ব্যাংক
ইমেইল : harunjubd@gmail.com
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।