স্ব-উদ্যোগ, স্ব-পরিকল্পনা ও স্ব-অর্থায়নে সমৃদ্ধ জাতি
প্রকাশিত : ২০:৫২, ৯ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ২০:৫৫, ৯ মার্চ ২০২১
এনবিআর এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
গ্রামের দরিদ্র কৃষক রহিম মিয়া। সেই গ্রামেরই দুই ধনী ব্যক্তি চৌধুরী সাহেব ও মৃধা সাহেব। তাদের মধ্যে কিছুটা রেষারেষি আছে। গ্রামে প্রভাব ধরে রাখার জন্যে দু-পক্ষেরই লোক দরকার। তাই তারা দুজনেই চেষ্টা করে রহিমকে হাতে রাখার। ফলে রহিম প্রয়োজনের সময় দুজনের কাছ থেকেই টাকাপয়সা পায়। এবং এটা শোধও করতে হয় না।
হঠাৎ মৃধা সাহেব মারা গেলেন। এর কিছুদিন পর রহিম গেল চৌধুরী সাহেবের কাছে। একজোড়া গরু কেনার জন্যে টাকা ধার চাইতে। চৌধুরী সাহেব ভেবে দেখলেন, যেহেতু মৃধা সাহেব এখন নেই, রহিমকে হাতে রাখার আর প্রয়োজন কী! চৌধুরী সাহেব বললেন, রহিম, তোকে ধার তো দিতে পারছি না। তবে আমার মেয়েজামাই যে ব্যাংকে চাকরি করে, সেখান থেকে তুই ঋণ নিতে পারবি।
রহিম ব্যাংকে গেল ঋণ নিতে। মেয়েজামাই বলল, জমির দলিল বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে যান। পাঁচ বছরের মধ্যে শোধ করলেই হবে। অগত্যা রহিম তার পাঁচ কাঠা জমি বন্ধক রেখে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিল। ঋণ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। মাঝপথে রহিমের নেশাখোর ছেলে জোর করে বাবার কাছ থেকে এক হাজার টাকা ছিনিয়ে নিল। একটু পর পাওনাদারের সাথে দেখা। ‘রহিম, তুই নাকি টাকা পেয়েছিস। আমার মেয়ের বিয়ে, কিছু অন্তত ফেরত দে।’ রহিম পাঁচ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হলো। ১৪ হাজার টাকা নিয়ে রহিম কোনোরকমে বাড়ি ফিরল। তার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলল, ছয় মাস আগে মেয়ের বিয়ে দিলাম। জামাইটাকে দাওয়াত দিতে পারি নি। তুমি তো ব্যাংক থেকে টাকা পেয়েছ। যাও, বাজার করে আনো। রহিমের আরো দুই হাজার টাকা খরচ হলো। থাকল বাকি ১২ হাজার টাকা।
পরদিন সে দুটো গরু কিনতে পারল না। কিনল একটা। চাষের সময় সেটাকেই জোয়ালের একপাশে দেয়, আরেক পাশটা নেয় নিজের কাঁধে। ফলে ভালোমতো চাষও করতে পারল না। ওদিকে পাঁচ বছর পর ব্যাংকে ২০ হাজার টাকার ঋণ সুদে-আসলে দাঁড়াল ৬০ হাজার টাকা।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর ৪৪টা দরিদ্র দেশের অবস্থাও রহিম মিয়ার মতো। আশির দশকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল পরস্পরের শত্রু। তাদের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। তখন সাহায্যগ্রহীতা দরিদ্র দেশের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭। এদেরকে হাতে রাখার জন্যে দুই দেশই খুব সহজ শর্তে ঋণ দিত; কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খান খান। আমেরিকা হয়ে উঠল সর্বেসর্বা। বস্তুত তখন থেকেই বিদেশি সাহায্যের ব্যাপারে সুর পাল্টে গেল আমেরিকার।
চৌধুরী সাহেব যেমন রহিম মিয়াকে তার জামাইয়ের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বলেছিল, আমেরিকাও তেমনি সাহায্যপ্রত্যাশী দেশগুলোকে বলল বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে। দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য না দিয়ে আমেরিকা সেই টাকা দিয়ে বিশ্বব্যাংকের শেয়ার কিনে রাখল। বিশ্বব্যাংকে যে দেশের শেয়ার যত বেশি, সে-দেশ থেকে কর্মচারীও তত বেশি। সুতরাং বিশ্বব্যাংক যে ঋণ দেয় তা মূলত আমেরিকার পরামর্শেই দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, বিদেশিরা সাহায্য দেয় কেন? এক সমীক্ষায় দেখেছি, বিদেশিরা যদি ১০০ ডলার দেয়, তার মধ্যে আমার দেশের অর্থনীতি পায় মাত্র ২০ ডলার। বাকি ৮০ ডলারের মধ্যে ৩৫ ডলার নিয়ে যায় বিদেশি কনসালটেন্ট, যারা ঋণদানকারী দেশেরই অবসরপ্রাপ্ত লোক। ১৫ ডলার যায় ‘প্রকল্প-পরিচালক’ নামে যে কর্মকর্তা-শ্রেণি তৈরি করা হয়, তাদের এসি রুম, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদির ব্যয় মেটাতে। এ-ছাড়াও আরো ১৫ ডলার যায় টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হারের তারতম্য হওয়ায়। বাকি ১৫ ডলার যায় ঋণদানকারী দেশের কাছ থেকে চড়াদামে কাঁচামাল কেনার পেছনে। দরাদরি বা অন্য দেশ থেকে কেনার কোনো সুযোগ এখানে থাকে না। কারণ চুক্তির শর্ত অনুসারে তার কাছ থেকেই আমাকে কিনতে হবে। আসলে ঋণগ্রস্তের কোনো স্বাধীনতা থাকে না।
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জন্ম। যুগে যুগে মোগল-ইংরেজ সবাই এখানে এসেছে, কারণ ভারতবর্ষের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দুটো অঞ্চলের একটি হলো বাংলা। যখনই নিজের উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও অধিকারের প্রতি এদেশের মানুষ অসচেতন হয়েছে তখনই অন্যেরা ঢুকে পড়েছে। হাজার বছর পরাধীন থাকার পর ১৯৭১ সালে বহু মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি স্বাধীনভাবে পথচলার অধিকার, রাষ্ট্রীয় সীমানা ও সার্বভৌমত্ব।
দেশ পুনর্গঠনের জন্যে একসময় বিদেশি সাহায্য নিতে হয়েছে। এখন তো ঋণশোধ করার পালা। কিন্তু আমাদের বার্ষিক বাজেটের ১৬% যায় বৈদেশিক ঋণের সুদ শোধ করতে। কোনো দেশের বার্ষিক সুদের পরিমাণ যদি ৪৮ হাজার কোটি টাকা হয়, তাহলে সেই দেশের মোট ঋণের পরিমাণ কত! একটি হিসাব মতে, আমাদের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যেকের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৮ হাজার টাকা। আজ চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে ছোট্ট শিশুটি জন্মেছে কিংবা নীলফামারীর ৮০ বছরের যে বৃদ্ধ রমিজুদ্দিন মারা গেছে, দুজনেই ২৮ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত। বৈদেশিক সাহায্য এভাবেই গোটা জাতিকে ঋণগ্রস্ত ও পরনির্ভর করে তুলেছে।
ছোটবেলায় দেখেছি নদীতে হঠাৎ আসা জোয়ারে বাঁধ ভেঙে গেছে, গ্রামের মোড়লের ডাকে সবাই কোদাল নিয়ে নেমে পড়েছে ঠিক করতে। রাস্তায় গর্ত হলে এলাকাবাসী নিজেরাই ঠিক করে ফেলত। আশির দশকে এসে দেখা গেল, বাড়ির সামনে গর্ত হলেও কেউ কিছু করছে না। সবাই আশায় আছে কখন এলজিইডি এসে ওটা ঠিক করে দেবে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে একটা উদ্যম ছিল, বিদেশি সাহায্য তা নষ্ট করে দিল।
ঋণ আজ নানাভাবে আমাদের আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস, আত্মশক্তি ও স্ব-উদ্যোগের ক্ষতি করছে। সমাজে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিতে যদি বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, স্বনির্ভরভাবে তা আমাদের সমাধান করতে হবে। কিন্তু নিজের উদ্যোগ না থাকলে আমরা অন্যের দ্বারস্থ হয়ে পড়ব। সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হতে চাইলে স্ব-উদ্যোগ, স্ব-পরিকল্পনা ও স্ব-অর্থায়ন এজন্যেই এত গুরুত্বপূর্ণ।
লিখাটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদের ৩ নভেম্বর ২০১৬ সালের মুক্ত আলোচনা থেকে সংগৃহীত।
এসি
আরও পড়ুন










