ঢাকা, সোমবার   ০৭ জুলাই ২০২৫

বৈশাখী আমেজে চাঙ্গা অর্থনীতি

প্রকাশিত : ২২:১৬, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। এই উৎসব ঘিরে আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বৈশাখকে ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক, রকমারি বাঙালি খাবার, কার্ড ও মোবাইলে শুভেচ্ছা জানানো, মেলা এবং হালখাতার মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে উত্সব। ফ্যাশন হাউজগুলোতে চলছে বাহারি রঙ ও ডিজাইনের বাঙালি পোশাক ক্রয়ের ধূম।

বাংলার গ্রামীণ এই উত্সবের শুরুটা বেশ প্রাচীন। ১৫৮৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে বাংলা সন গণনা শুরু। সম্রাট আকবরের সময় এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল। চৈত্রমাসের শেষ দিন ভূস্বামীরা খাজনা পরিশোধ করে নতুন বছরের প্রথম দিন আয়োজন করতেন উত্সবের। এটিই বৈশাখী উত্সব বা বৈশাখী মেলা হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। বৈশাখী মেলায় স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সবরকম হস্তশিল্পজাত ও মৃতশিল্পজাত সামগ্রী বিকিকিনি চলছে বছরের পর বছর ধরে।

সময়ের পরিক্রমায় রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে বৈশাখী মেলার সেরকম আয়োজন না হলেও বৈশাখী সামগ্রীর কদর একটুও কমেনি। আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ সনকে বরণ করে নিতে উত্সবে মাতবে দেশ। এখন অনেকটা ধুমধাম করেই মানুষ পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াটা এর অন্যতম কারণ। ফলে বৈশাখী উত্সব ঘিরে আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয়। বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ে। চাঙ্গা হয়ে ওঠে অর্থনীতি। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তাদের এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ও ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবস্থায় অর্থের পর্যাপ্ত যোগান রাখে। প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের পরিবার পরিজনদের কাছে বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠায়। মোবাইল ব্যাংকিং ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও আর্থিক লেনদেন বাড়ে।

বৈশাখী উত্সব উপলক্ষে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজের আউটলেটে ও শপিং মল বিশেষ ছাড়ের অফার দিয়েছে। কেউ কেউ বিভিন্ন হারে ক্যাশব্যাকের লোভনীয় অফার ঘোষণা করেছে। কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকও গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে তাদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটার ওপর বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও ক্যাশব্যাক অফার দিয়েছে। নামিদামি হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাবারে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান’ অফারও দিয়েছে কিছু ব্যাংক। বৈশাখী উত্সবকে ঘিরে প্রতিবছর বাংলাদেশে অর্থনীতিতে আলাদা জোয়ার সৃষ্টি হয়।

এই উত্সবে প্রতিবছর কী পরিমাণ আর্থিক লেনদেন হয় বা এ সময় বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ কত এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারি বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই নেই। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বৈশাখী উত্সবে বাণিজ্যের পরিমাণ কমবেশি ৩০ হাজার কোটি টাকা।

তিন বছর আগে সরকার চাকরিজীবীদের জন্য বৈশাখী বোনাস ঘোষণা করায় উত্সবে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। উত্সবের কারণে খরচের চাহিদা যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বোনাস দেওয়ায় বাজারে টাকার জোগানও বেড়েছে। ফলে বৈশাখকে কেন্দ্র করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক, রকমারি বাঙালি খাবার, কার্ড ও মোবাইলে শুভেচ্ছা জানানো, মেলা এবং হালখাতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে উত্সব। ফ্যাশন হাউজগুলোতে চলছে বাহারি রঙ ও ডিজাইনের বাঙালি পোশাকের সমারোহ। নতুন নতুন পোশাক কিনতে ফ্যাশন হাউজগুলোতে প্রতিদিনই ক্রেতাদের ভিড়। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে নামিদামি শপিংমল পর্যন্ত সবখানেই বৈশাখী উত্সবের কেনাকাটার ধুম চলছে।

এই উত্সবের মূল আকর্ষণ পান্তা-ইলিশ। বর্তমানে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে মজুদ করা আগে ধরা ইলিশ বাজারজাত শুরু করেছে ব্যবসায়ীরা। তাজা ইলিশের দামও থাকছে বেশ চড়া। পিছিয়ে নেই নিত্যপণ্য, ফুল, মৃতশিল্প এবং গহনা ব্যবসায়ীরা। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই বৈশাখী উত্সবকে ঘিরে জমজমাট আয়োজন চলছে।

সবকিছু মিলিয়ে বৈশাখী উত্সবকে ঘিরে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন গতি এসেছে। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় উত্সব ঘিরে অর্থনীতি গতি পেয়েছে। অর্থনীতিতে এর একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ, এতে দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়।

চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঠিক রাখতে পারলে এই বৈশাখী উত্সবের পুরোটাই ইতিবাচক হতে পারে। অন্যান্য উত্সবের সঙ্গে বৈশাখের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত ঈদ, কোরবানি, পূজা এবং বড়দিনের উত্সব নির্দিষ্ট ধর্মের লোকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু বৈশাখী উত্সব হলো— ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালির সর্বজনীন উত্সব। অন্যান্য উত্সবে বিদেশি পণ্যের ব্যবহার বেশি হলেও বৈশাখী উত্সবে দেশীয় পণ্যেরই প্রাধান্য থাকে। বৈশাখে ৯০ শতাংশই দেশীয় পণ্য ব্যবহার হয়। এছাড়া বৈশাখ শুধু ঘরোয়া উত্সব নয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ এমনকি পাঁচ তারকা হোটেলে জমজমাট আয়োজন থাকে। এছাড়া ঈদে মানুষ গ্রামে চলে যায়। কিন্তু বৈশাখে যে যেখানেই থাকুক না কেন সেখানেই উত্সব পালন করে। ফলে এ উত্সব এককেন্দ্রিক নয়।

এক সময় বৈশাখী উত্সব ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। গত এক যুগে তা ব্যাপকভাবে বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। নববর্ষের উত্সবে লম্বা একটানা বেশ ক’দিন ছুটি পাওয়ায় অনেকেই পর্যটন স্পটগুলোতে যাবার আয়োজন করেছেন। ফলে দেশে পর্যটন স্পটগুলোতে ভিড় জমবে ধারণা করা যায়। ফলশ্রুতিতে সেখানেও ভালো ব্যবসা হবে হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে। এভাবে গোটা অর্থনীতিতে বৈশাখী উত্সবের হাওয়া দারুণ চাঙ্গা ভাব সৃষ্টি করেছে নিঃসন্দেহে বলা যায়।

জানা গেছে, দেশের মানুষের পোশাকের জোগান দেওয়ার জন্য পুরান ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, কালীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র-মাঝারি কারখানা গড়ে উঠেছে। এ ধরনের ছয় হাজার কারখানার সংগঠন অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি। সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন মালিক বলেন, পোশাকের ব্যবসা উৎসবকেন্দ্রিক। ঈদ ও পূজার পর বড় উৎসব এখন বৈশাখ। ১০-১৫ বছর আগে বৈশাখী পোশাক টুকটাক বিক্রি শুরু হয়। এখন সেটি বহুগুণ বেড়ে গেছে। কেরানীগঞ্জ, কালীগঞ্জের মতো পাইকারি বাজার থেকে বৈশাখের পোশাক কিনে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে এবার পোশাকের ব্যবসা ২০ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের ফ্যাশন হাউস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতি (এফইএবি বা ফ্যাশন উদ্যোগ) ফ্যাশন হাউসগুলোর বিক্রিবাট্টা নিয়ে জরিপ করছে সমিতি। সেই জরিপের প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, ফ্যাশন হাউসগুলোতে সারা বছর প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয়। এর মধ্যে অর্ধেকই রোজার ঈদে। ২৫-২৮ শতাংশ পয়লা বৈশাখে।

জানতে চাইলে ফ্যাশন উদ্যোগের নির্বাহী পরিষদের সদস্য আজহারুল হক গত শুক্রবার বলেন, বৈশাখের বেচাবিক্রি হয় মূলত শেষের তিন-চার দিন। এখন পর্যন্ত যেটুকু হিসাব তার ভিত্তিতে বললে গতবারের চেয়ে বেচাবিক্রি ১০-১৫ শতাংশ বেশি হয়েছে।

পয়লা বৈশাখের সঙ্গে হালখাতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। হালখাতায় ক্রেতা ও গ্রাহকদের মিষ্টি-নিমকি খাওয়ান ব্যবসায়ীরা। আধুনিক যুগে হালখাতা উৎসবের জৌলুশ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। তারপরও মিষ্টি খাওয়ানোর প্রচলনটা অনেকেই ধরে রেখেছেন। সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের গ্রাহকদের নববর্ষের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে মিষ্টিকে রাখছে সবার ওপরে। ফলে পয়লা বৈশাখে মিষ্টির দোকানের ব্যবসা অন্য সময়ের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে সারা বছরে যে পরিমাণ মিষ্টি বিক্রি হয়, তার ২০-২৫ শতাংশ পয়লা বৈশাখে হয়ে থাকে।

প্রাণ গ্রুপের মিষ্টির ব্র্যান্ড মিঠাই বৈশাখ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, জুয়েলারি, ইলেকট্রনিকসহ ৫০টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০-৩৫ টন মিষ্টি ক্রয়াদেশ পায়। সেই চাহিদা মেটাতে ৯ এপ্রিল থেকে তাদের কল্যাণপুরের কারখানায় প্রতিদিন ১০-১২ টন মিষ্টি উৎপাদন হচ্ছিল। যদিও সাধারণ সময়ে দিনে ৩ টন মিষ্টি উৎপাদন করে মিঠাই।

জানতে চাইলে মিঠাইয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) অনিমেষ সাহা বলেন, গত বৈশাখে আমরা ২৫টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ টন মিষ্টির ক্রয়াদেশ পেয়েছিলাম। তবে গতবারের চেয়ে এবার মিষ্টির ক্রয়াদেশ তিন গুণ বেড়েছে।’

এদিকে বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ না থাকলেও ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ফলে নগরবাসীর মধ্যে ইলিশ কেনার একধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। বাড়তি ইলিশের জোগান দিতে দেড়-দুই মাস আগে থেকে মাছ মজুত করেন ব্যবসায়ীরা। তারপরও মাছটির দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বর্ষবরণে ইলিশ খাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় দুই বছর ধরে পয়লা বৈশাখে ইলিশ কেনার প্রতি মানুষের ঝোঁক কিছুটা হলেও কমেছে।

ঢাকার কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী শুক্কুর আলী গতকাল ৭০০-৭৫০ গ্রাম ওজনের পদ্মার এক হালি ইলিশ ৩ হাজার টাকা এবং ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের পদ্মার ইলিশ ৫ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেন। বেশ কয়েক দিন আগের হিমায়িত ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি করছেন ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। তিনি বলেন, ব্যবসা খুবই ভালো। তবে আগের মতো কাড়াকাড়ি নেই।

পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বৈশাখী ছুটি কাটাতে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও সিলেটে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন অনেকে। কেউবা যান বিদেশে। তবে বাড়তি ছুটি না থাকায় এবার ঘুরতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কিছুটা কম—এমনটাই জানালেন ট্যুর অপারেটর মালিকদের সংগঠন টোয়াবের পরিচালক সৈয়দ সাফাত উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বৈশাখে ঘুরতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অন্যবারের চেয়ে কম। কারণ বাড়তি ছুটি নেই। বাচ্চাদের স্কুলও খোলা। তারপরও বালি ও শ্রীলঙ্কা যাচ্ছে কিছু মানুষ। সেখানে অফ সিজন চলছে, খরচ কম।

আরকে//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি