ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

তারকালাপে বেলাল খান

‘চলচ্চিত্রে গান করতেই বেশি আনন্দ’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:১৮, ২৭ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৩:২০, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

বর্তমান সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী বেলাল খান। ‘পাগল তোর জন্যে রে পাগল এ মন’ গানটি দিয়ে সবার হৃদয়ে স্থান করে নেন এই শিল্পী। ‘প্রেমের জন্য পৃথিবী’ সিনেমায় তার ও ন্যান্সির যৌথ কন্ঠে গাওয়া এ গানটি বেলাল খানের ক্যারিয়ারে একটি ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছে বলা চলে। এটি এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে।

এরপর অসংখ্য গানে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই গানের জন্য পেয়েছেন সেরা সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কিন্তু আজকের বেলাল খান হয়ে ওঠার পেছনের গল্পটা হয়তো অনেকেরই অজানা। গান ও সুরের সঙ্গে তার যে সেতুবন্ধন রচনা হয়েছে সেই গল্পটি একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে জানালেন বেলাল খান নিজেই। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- সোহাগ আশরাফ

একুশে টিভি অনলাইন : বেলাল ভাই কেমন আছেন?

বেলাল খান : ধন্যবাদ। ভালো আছি।

একুশে টিভি অনলাইন : শুরুতেই জানতে চাইবো আপনার গানের যাত্রাটা কবে থেকে?

বেলাল খান : ছেলেবেলা থেকেই এই স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছি। ফাইনালি ব্যাপক পরিসরে কাজ করার সুযোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। ২০০৩ সালের কথা। মূলত: তখন থেকেই মিউজিক নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

একুশে টিভি অনলাইন : আপনার শৈশব কেটেছে কোথায়? সেই শৈশবের গল্পটা শুনতে চাই।

বেলাল খান : আমার শৈশবটা কেটেছে টাঙ্গাইল জেলার সখীপুরের নলুয়া গ্রামে। আমার বাবা লুৎফর রহমান খান, মা বেদেনা রহমান। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে আমি বড়। বাবা দেশের বাইরে থাকতেন। সেই হিসেবে আমার উপরই পরিবারের দায়িত্বটা এসে পড়ে। এক সঙ্গে ছোট ভাই বোন, মায়ের দেখভাল, অন্যদিকে লেখাপড়া করা, দুটোই সামলাতে হতো সমান তালে। এর মধ্যে যে গান নিয়ে লেগে থাকা কিংবা তালিম নেওয়া ওই রকম কোনো সুযোগ-ই ছিলো না।

আপনি হয়তো জানেন, গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে নানাবিধ ক্রাইসিস লেগেই থাকে। যেখানে সাধারণ চাহিদাগুলোই পূরণ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে, সেখানে গানের কথা পরিবারের কাউকে বলার সুযোগ হয়নি। তবে গানের প্রতি আমার আগ্রহ ছিলো ছোটবেলা থেকেই। বিয়ের অনুষ্ঠান বা কোনো বাড়িতে গান বাজতে শুনলেই আমি ঠায় দাঁড়িয়ে যেতাম। কেউ যদি আমাকে গিফট দিতে চাইতো আমি বলতাম আমাকে একটা ক্যাসেট কিনে দেন। যখন গ্রামের স্কুল কলেজগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো আমি দর্শক সাড়ির সামনে গিয়ে বসতাম। এ জন্য বকাবকিও শুনতে হতো।

আরেকটা কথা বলি- আমার মামা আবু বক্কর সিদ্দিকী। বাংলাদেশ বেতারের ফোক শিল্পী। মামা যেদিন বিটিভিতে গান গাইতেন সেদিন গ্রামে মাইকিং করা হতো। উনি যখন গ্রামে যেতেন তখন আশেপাশের মানুষ তাকে ঘিরে রাখতেন। এই যে তাকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ, আগ্রহ এটা দেখে আমার মধ্যেও একটা ক্রিয়া কাজ করতো। তাকে গ্রামের মানুষ যে সম্মান দিচ্ছে তা দেখে আমার ইচ্ছে হতো আমাকেও এমন হতে হবে। সেজন্য বলতে পারি- অলিখিত ভাবে তার প্রভাব আমার উপর পড়েছে।

এভাবেই শৈশবটা কেটে যায়। এরপর এসএসসি শেষ করেই আমি ঢাকায় চলে আসি। ২০০২ সালের কথা। ঢাকায় রেখে লেখাপড়ার খরচ বহন করার মত পরিবেশ তখনও আমার পরিবারের হয়নি। কিন্তু আমি বুঝলাম যে গান নিয়ে আমাকে যদি কিছু করতেই হয় তবে ঢাকায় থাকা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নাই। এইতো।      

একুশে টিভি অনলাইন : ঢাকায় এসেই কি আপনি সুযোগ পেয়ে গেলেন? গ্রামের সেই বেলাল খান কিভাবে আজকের অবস্থানে আসলো সেই গল্পটা শুনতে চাই।

বেলাল খান : ঠিক যখন আমার গ্রামের বন্ধুরা সবাই টাঙ্গাইলকে ঘিরেই তাদের ক্যারিয়ার শুরু করে। আমি তখন ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরে একটি মেসে উঠলাম। তখন আমি নিজেকে স্বাধীন ভাবতে শুরু করলাম। যখনই সময় পেতাম গানের সঙ্গে যাদের ওঠাবসা তাদের কাছে ছুটে যেতাম। বিভিন্ন সিডির দোকানে ঘোরাফেরা করতাম। সিডির কভারে কোন ঠিকানা দেখলেই ছুটে যেতাম সেখানে। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয় সেই আশায়। আমার এক মামা আমাকে একটা টেপ রেকর্ডার দিয়েছিলেন। ওটা দিয়ে সারা রাত গান শুনতাম। এভাবে আরও দুই বছর যায়। এর মধ্যে বহুবার পকেটের টাকা শেষ হয়ে গেলে লোকাল বাসে চড়তাম, হেটে হেটে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। সব সময় মিউজিকের আপডেট রাখার চেষ্টা করতাম। এর মধ্যে এইচএসসি শেষ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন দেই। ফাইনালি আমার স্বপ্নটা একধাপ এগিয়ে গেলো। এতো দিন পরে আমার পথ খুঁজে পেলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটা বন্ধু সার্কেল তৈরি হলো। শিক্ষকদের একটা সার্কেল পেলাম। যারা আমাকে মানষিক ভাবে চাঙ্গা রাখতো। মোট কথা ভালো কিছু সার্কেল পাওয়ার কারণে এগিয়ে যেতে সহজ হয়। তখন বেলি রোড কেন্দ্রীক ইন্ডাস্ট্রি ছিলো। ওই সময় যে জনপ্রিয় শিল্পীরা ছিলেন তাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক হতে শুরু হয়। কিন্তু কেউ ই আমাকে সুযোগ দিচ্ছে না। যখনই বলি, আমি গান করতে চাই, সিডি তৈরি করতে চাই, তখনই টাকার প্রসঙ্গ চলে আসে। কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নাই। এভাবেই চলতে থাকে। অনেক কষ্ট নিয়ে সবার পেছনে লেগে থাকি। টিএসসি কেন্দ্রীক একটি সার্কেল তৈরি হলো। টিএসসিতে মিউজিকের কিছু সংগঠন ছিলো তাদের কাছে গিয়ে বসতাম। এসব করতে করতেই কিছু গায়হলুদের শো, টিএসসির আশেপাশে যে অনুষ্ঠানগুলো হয় সেখানে শো করতে থাকি। এরপর যারা গানের কম্পোজিশন করেন তাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটলো। মানে গানের সেক্টরের সকলের সাথে ধীরে ধীরে একটা লিংক তৈরি হতে থাকলো। একপর্যায়ে মানষিক ভাবে বেশ শক্ত হলাম। ভাবলাম কেউ সুযোগ দিক আর না দিক আমার মত আমি কাজ করে যাবো। তখন আমার কাছে যে রেকর্ডার ছিলো তাতে নিজে নিজে রেকর্ডিং করতে শুরু করি। নিজের মত করে সুর করতাম। অসংখ্য গান রেকর্ড করি। অন্তমিল কিছু পেলেই সুরে ফেলে রেকর্ড করতাম। আমি হয়তো গানের কোন ব্যকরণ শিখে আসি নি কিন্তু লেগে থাকলে যা হয় তাই হয়েছে।

একুশে টিভি অনলাইন : আপনি যে গনটি দিয়ে শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন। অর্থাৎ সংগ্রামী বেলাল খান যে গানটি দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করেছে সেই গানের পেছনের গল্পটা কি?

বেলাল খান : এ গল্পটি অনেকেই জানেন। আমি তখন হলে থাকি। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। বিকেলে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরছি। যখনই কোন সুর মাথায় আসতো সেই রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করে রাখতাম। এরই মধ্যে আমার এক বন্ধু ছিলো হাবিব। ওর বাড়ি ছিলো কুমিল্লা। ও রাজশাহীতে পড়াশুনা করতো। যখনই সে ছুটি পেত চলে আসতো ঢাকায়। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতো, গল্প করতো, আমাদের সঙ্গে হলে থাকতো। ও প্রায়ই বলতো – ‘আমি একটা মেয়ের জন্য পাগল। কিন্তু মেয়েটা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না।’ এ ঘটনা প্রায়ই বলতো। বলতো যে, আমার জন্য একটা গান বানা। ওটা দিয়ে আমি মেয়েটাকে প্রস্তাব দিবো।

আমি তখন ইয়ারকির ছলেই বলিছিলাম- তোকে একটা গান করে দিবো। যে গানে তোর সব অভিব্যাক্তি থাকবে। ওই গানটা দিয়ে বলবি - এটা তোর মনের কথা। এভাবেই গানটার জন্ম।

তখন শুধু একটা লাইনই করা হয়। এরপর অনেকটা গ্যাপ ছিলো। ও চলে যায়। আমাদের আর এটা নিয়ে ঠিক বসা হয়নি। আমি যখন গানটি শেষ করি ততদিনে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। ওটা আর তাকে দেওয়া হয়নি। আমরা এখনও দেখা হলে মজা করি।

ওই যে একটা গানের লাইন আমার ভেতরে সুর বেধে ছিলো পরবর্তিতে নির্মাতা মঈন বিশ্বাসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ওনার সিনেমার জন্য গানটি তৈরি করি। গানটির পুরো লিরিক্স লিখেছিলেন জুলফিকার রাসেল। আমার সঙ্গে গানটি দ্বৈতভাবে গেয়েছিলেন ন্যান্সি। গানটি প্রকাশ পেয়েছিলো ২০১১ সালের ভালোবাসা দিবসে।

একুশে টিভি অনলাইন : আপনিতো নিয়মিত চলচ্চিত্রে গান করছেন। স্টেজে শো করছেন। মিউজিক ভিডিও করছেন। এছাড়া নাটকের টাইটেল সং ও করছেন। এগুলোর মধ্যে কোনটিতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?  

বেলাল খান : আমার চলচ্চিত্রেই গান করতে বেশি পছন্দ। ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি একটা বাড়তি আগ্রহ ছিলো। এই যে আলাদা আলাদা চরিত্রের সঙ্গে আমার কণ্ঠ থাকছে, আমার কম্পোজিশন বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে স্ক্রিনে দেখবো ভাবতে ভালো লাগে। আসলে এর মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে।

একুশে টিভি অনলাইন : স্টেজ শো করতে কেমন লাগে?

বেলাল খান : টিভি লাইভকে আমরা লাইভ বললেও একটাতে যান্ত্রিক একটা বিষয় থাকে। স্টেজের যে ফিলিংস সেটা এখানে পাওয়া যায় না। স্টেজ কিন্তু সব শিল্পীর কাছেই অন্যরকম আনন্দের একটি জায়গা। এখানে শ্রোতাদের সারাটা সরাসরি পাওয়া যায়। একটা উন্মাদনা কাজ করে। আমি বেশ উপভোগ করি।  

একুশে টিভি অনলাইন : গান নিয়ে সামনের দিনে আপনার পরিকল্পনা কি?

বেলাল খান : এই মুহুর্তে আমি একটু স্লো গতিতে আগাচ্ছি। অনেক গান রিলিজ করতে হবে, অনেক কিছু প্রেজেন্ট করতে হবে এই ধারণা থেকে আমি রেড়িয়ে আসতে চাইছি। আমি চাচ্ছি বছরে আমার তিন থেকে চারটি সিঙ্গেল রিলিজ হবে। সেগুলো একটা থেকে যেনো অন্যটা আলাদা হয়। সেখানে যেনো আমি নতুন কিছু করতে পারি, আমাকে আমি নতুন করে চেনাতে পারি সে চেষ্টা থাকবে। এর বাইরে যেটা হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে সিনেমার কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া অনেকের জন্য গান কম্পোজ করছি। যাদের গান একের পর এক রিলিজ হবে। এর বাইরে স্টেজ শো আছে। চেষ্টা করছি চব্বিশ ঘন্টাই মিউজিকের সঙ্গে থাকতে।

একুশে টিভি অনলাইন : শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কি কিছু বলতে চান?

বেলাল খান : বরাবরের মত একটাই চাওয়া- বাংলা গান শুনবেন। গান শুনে সুন্দর সুন্দর মতামত দিবেন। বর্তমানে ইউটিউব কেন্দ্রীক যে গান প্রকাশ পায় আপনি যদি মন্তব্য করতে চান করতে পারেন। মন্তব্য করলে আমি দেখতে পাবো। আপনাদের মতামত শুনে আমি নতুন কিছু করতে পারবো। ভালো গান গ্রহণ করুন। বাংলা গানের সঙ্গে থাকুন।

সব শেষে বলতে চাই একুশের পরিবারকে আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

 

এসএ/এআর


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি