ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪

ছেলের চিকিৎসায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আবদুর রহমানের হাতে ভিক্ষার ঝুলি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:০৩, ১০ অক্টোবর ২০১৭

মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত পুত্র নিয়ে পরিবারসহ অসহায় ও মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন রোহিঙ্গা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হাফেজ আবদুর রহমান (৪৮)। গুলিবিদ্ধ পুত্র সহ আবদুর রহমানের পরিবারের সদস্য আট জন। একদিকে গুলিবিদ্ধ ছেলের চিকিৎসা অন্য দিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ট্রলার ভাড়া বাবত বিশাল অংকের দেনার দায়ে জর্জরিত তিনি। ছেলের চিকিৎসার খরচ যোগাতে ভিক্ষার ঝুলি মাথায় নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আবদুর রহমান।

গত সোমবার সকালে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প (স্থানীয় ভাষায় রোহিঙ্গা টাল) সংলগ্ন পূর্ব পাশে স্থানীয় জহির আহমদের মালিকানাধীন জমিতে মাসিক ৫০০ টাকায় ভাড়া নেওয়া ঝুপড়ি ঘরে দেখা হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হাফেজ আবদুর রহমানের সাথে। তাঁর দ্বিতীয় ছেলে মো. আলম (১৬) মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত। নির্বিচারে চালানো ব্রাশ ফায়ারে আলমের ডান হাত ও ডান পায়ে গুলি লাগে।

আবদুর রহমানের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু মেরুলায় ঝুমপাড়া গ্রামে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও সুন্দর সাজানো-গোছানো সুখের সংসার ছিল আবদুর রহমানের। তার স্ত্রী দিল বাহার বেগম (৩৭), ছেলে শফিক আলম (১৮), মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত মো. আলম (১৬), মেয়ে ফেরদৌস বেগম (১৪), মো. রিদুয়ান (১২), মো. জোহার (১০), ও মেয়ে হুরি জন্নাত (৮) নিয়ে তার সুখের সংসার ছিলো।

অশ্রু সজল নয়নে আবদুর রহমান জানান, সেপ্টেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহে মিয়ানমার বাহিনী যেদিন আমাদের গ্রামে অভিযান শুরু করে, তখন পুরো গ্রাম জুড়ে ভয়াবহ অবস্থা। চারদিকে গুলির শব্দ। আগুনে বসতবাড়ি পোড়ানোর গন্ধ। মার মার, কাট কাট, লুটপাট আর অসহায় রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকার, দিকবিদিক ছুটাছুটি। প্রাণ বাঁচানোর তাকিদে আমিও স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ পালানোর সময় মিয়ানমার বাহিনীর বেপরোয়া ব্রাশ ফায়ারের শিকার হই। এসময় আমার এক ছেলে মো. আলম (১৬), প্রতিবেশী পুতুইয়ার ছেলে শামসুল আলম (২৩), জমির হোছনের ছেলে আক্তার কামাল (২৫), আবুল হোছনের ছেলে জাহেদ হোছন (২০) এবং রাহমতুল্লাহ (২৩) নামে অপর এক যুবকসহ ৫ জন আহত হয়।

কোনো রকমে মিয়ানমার সেনা-পুলিশ ও মগদের চোখ এড়িয়ে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় আমরা পাহাড়ে আশ্রয় নেই। একদিকে গুলিবিদ্ধদের ক্ষত স্থান থেকে রক্তক্ষরণ, অন্যদিকে সেনা আতংক, সে এক ভয়ানক অবস্থা। প্রথমে গুলিবিদ্ধদের জরুরী চিকিৎসার জন্য ৫ লক্ষ কিয়াটে ট্রলার ভাড়া করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর আমরা বাংলাদেশে আসি। ট্রলার মালিক ভাড়ার জন্য আমাদের টেকনাফের কাটাবনিয়া গ্রামে ২ দিন আটকে রাখে। আমাদের ট্রলারে ১৮ জন রোহিঙ্গা ছিল। পূর্ব পরিচিত ও আত্মীয়দের কাছ থেকে কর্জ নিয়ে জনপ্রতি ৩ হাজার বাংলাদেশি টাকা ভাড়া পরিশোধ করে মুক্তি পাই। এরপর ৮ দিন নতুন পল্লান পাড়ার একটি বাড়িতে আশ্রয় নেই। পরে সেখান থেকে অন্য রোহিঙ্গাদের সাথে এখানে চলে আসি।

মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত ছেলের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমে টেকনাফের সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর লেদায অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কয়েকদিন সেখানে ভর্তি ছিল। এরপর থেকে বাসায় আছে। তার চিকিৎসার জন্যও অনেক টাকা খরচ হয়েছে। ঔষধ কিনতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এখনও ক্ষত স্থান শুকায়নি। হাতে-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ধাক্কা-ধাক্কি করে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। ট্রলার ভাড়ার দেনার টাকা, গুলিবিদ্ধ ছেলের চিকিৎসার জন্য জরুরী ঔষধ কেনার টাকা, ঝুপড়ি ঘরের মাসিক ভাড়ার টাকা এবং ৮ সদস্যের পরিবারের খরচের টাকা যোগাড় করতে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষায় নামতে হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমি জন্মান্ধ নই। বালক অবস্থায় ১৩ বছর বয়সে অসুস্থতায় আমার উভয় চোখ নষ্ট হয়ে যায়। মিয়ানমারে মুসলমানদের উন্নত চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই। ১৫ বছর বয়সে আমি হাইচ্ছুরাতা গ্রামে হাফেজ আবুল খায়েরের তত্বাবধানে হেফজ শুরু করি। শিক্ষক এবং সহপাঠিদের সহযোগিতায় আমি পবিত্র কুরআন হেফজ করি। এখন আমি চরম অসহায়। ধরের টাকা পরিশোধ করা দূরে থাক, গুলিবিদ্ধ ছেলের চিকিৎসা এবং জরুরী খরচ মেঠানোও সম্ভব হচ্ছে না। ঝুপড়ি ঘরের মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়া পরিশোধ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

 

আরকে/টিকে


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি