ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্যাসিনো তালিকা 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৫৪, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১২:৫৮, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বহু বছর আগে ক্যাসিনোর উত্থান। শুরুর দিকে অনিয়ন্ত্রিত জুয়ার আসরের কারণে এসব ক্যাসিনোর উৎপত্তি। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জুয়ার আসরে চলে ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা। ওড়ানো হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। গোটা বিশ্বে অসংখ্য ক্যাসিনো থাকলেও এবার রাজধানী ঢাকার ১০০টি স্পটে অবৈধ ক্যাসিনো (জুয়ার আসর) ব্যবসা চলছে বলে জানা গেছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ ব্যবসায় জড়িত রয়েছে কেন্দ্রীয় ও মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবলীগের একশ্রেণির নেতা। অবৈধভাবে চালানো এসব জুয়ার আসরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ছয় নেতা মাঝেমধ্যে অংশগ্রহণ করেন। ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ চারটি দেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের আনা হচ্ছে। প্রশিক্ষিত জুয়াড়ির পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রহরীও আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে। ক্যাসিনোগুলোতে প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা উড়ছে। এর পরিমাণ কমবেশি ১২০ কোটি টাকা হতে পারে।

জানা গেছে, রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আটটি স্থানে যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের এক শীর্ষ নেতার তত্ত্বাবধানে ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নিয়ে ক্যাসিনো চালানো হচ্ছে। এখানেই মূলত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ছয় নেতাসহ অনেকের আনাগোনা রয়েছে। রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় তিনটি ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক সাংগঠনিক সম্পাদক। 

এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্পোর্টিং ক্লাব, অভিজাত এলাকার ক্লাব ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রাত গভীর হলেই বসছে কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর। মতিঝিলের ক্লাবপাড়া ছাড়াও দিলকুশা, ব্যাংক কলোনি, আরামবাগ, ফকিরেরপুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গুলিস্তান, ওসমানী উদ্যান, বঙ্গবাজার এলাকায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। 

মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে অনানুষ্ঠানিক ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ রয়েছে গুলশান লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, নিউমার্কেট এলাকার এজাজ ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, পল্টনের জামাল টাওয়ারের ১৪ তলাসহ বেশ কয়েকটি নামিদামি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে।

রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোতে ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, চরকি রামিসহ নানা নামের জুয়ার লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই পথে বসছেন। এতে পারিবারিক অশান্তিসহ সামাজিক নানা অসংগতি বাড়ছে। ভুক্তভোগীরা সর্বস্বান্ত হলেও জুয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আয়োজক চক্র। আর এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী। অথচ আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোককে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন চলছে এসব কর্মকাণ্ড। 

তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারির পর সেগুনবাগিচায় কয়েকটি ক্যাসিনো দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

জানা গেছে, যুবলীগের তত্ত্বাবধানে ৬০টি বড়ো ক্যাসিনো চললেও সংগঠনটির থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাতেও বসছে জুয়ার আসর। পাড়া-মহল্লার জুয়ার আসরগুলোতেও লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা হচ্ছে। আর যুবলীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগর উত্তর-দক্ষিণের একশ্রেণির নেতাদের শেল্টারে ৬০ স্পটে চলছে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জুয়ার খেলা। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার খেলা হচ্ছে। পাহারায় নিয়োজিত থাকে বিদেশ থেকে আনা নিজস্ব অস্ত্রধারী টিম। এদের আইনি ঝামেলা থেকে সুরক্ষা দেয় খোদ পুলিশ প্রশাসনেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বড়ো ৬০টি ক্যাসিনোয় একেকটি স্পটে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। সেই হিসাবে রাজধানীর জুয়ার স্পটগুলোতে দৈনিক ১২০ কোটি টাকা উড়ছে। এ টাকার একটি বড়ো অংশ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় বিদেশে। বহুতল ভবনের ছাদ ও অভিজাত ক্লাবগুলোতে রাতভর জুয়ার আড্ডা চলে। অনেক ক্ষেত্রে পেশাদার জুয়াড়িরা ক্লাব-গেস্ট হাউজের জুয়া পরিচালনা করলেও নেপথ্যের শেলটারদাতা হিসেবে থাকেন যুবলীগের নেতা। 

রাজধানীর সেগুনবাগিচা-মতিঝিল-আরামবাগে খেলাধুলা চর্চার জন্য গড়ে ওঠা নামিদামি ক্লাবগুলো বাস্তবে পরিণত হয়েছে ক্যাসিনোয়। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোও জুয়ার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। গভীর রাতে ক্লাবগুলোতে আসতে শুরু করে বিত্তবানদের গাড়ি। তাদের সঙ্গে থাকে ঢাকাই সিনেমার উঠতি নায়িকা থেকে শুরু করে নামিদামি মডেল। এসব মডেল-অভিনেত্রী জুয়ার আস্তানায় ‘এস্কর্ট গার্ল’ হিসেবে পরিচিত।

সূত্র জানায়, যুবলীগের একশ্রেণির নেতার ছত্রছায়ায় এ সর্বগ্রাসী জুয়ার আস্তানা এখন ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর অলি-গলিতেও। ক্লাবের বাইরে বিভিন্ন এলাকার গেস্ট হাউজ ও ফ্ল্যাট বাসায়ও এ ধরনের আয়োজন করা হচ্ছে। বাদ পড়ছে না বস্তি এলাকাও। নিকেতন, নিকুঞ্জ, উত্তরা, রূপনগর, খিলগাঁও, লালবাগ, হাজারীবাগ, বাড্ডার অসংখ্য বাসায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসানো হয়। এসব আসরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, ছিঁচকে চোর, পকেটমার, মলমপার্টির সদস্যরাও অংশ নেয়। উত্তরার একটি অভিজাত ক্লাবে নেপালিসহ কয়েক জন বিদেশি নারী-পুরুষের সহযোগিতায় চালানো হচ্ছে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য। 

উত্তরার পাশাপাশি দক্ষিণখানে, আশকোনাতেও রয়েছে ক্যাসিনো। জুয়ার আসরগুলো থেকে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, মাস্তান, কমিউনিটি পুলিশের ইউনিট, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পিএস-এপিএসদের নাম লিখে দৈনিক বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেওয়া হচ্ছে। জুয়াড়িরা খেলতে আসা লোকদের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়া খেলতে গিয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারসহ এলাকার মানুষজন। যুবলীগের নেতারা জড়িত থাকায় পুলিশ জুয়া খেলায় সরাসরি মদত দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এই জুয়ার আড্ডাগুলো সম্পর্কে সম্প্রতি প্রমাণসহ গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। 

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে, রাজধানীতে যুবলীগের বিভিন্ন অপতৎপরতা চলছে। শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে ঢাকায় অন্তত ১০০টি ক্যাসিনো চলছে যুবলীগের তত্ত্বাবধানে। পুলিশের এই প্রতিবেদন পেয়ে যুবলীগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে যুবলীগের ওপর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ঢাকায় যুবলীগের নেতারা অবৈধভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নেওয়া হয়েছে। যুবলীগের সবার আমলনামা আমার কাছে রয়েছে। এসব বন্ধ করতে হবে। আমি জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কাছে সবার সব তথ্য আছে। এরপর গত শনিবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় যুবলীগ নিয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। 

প্রসঙ্গত, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজধানীতে অর্ধ শতাধিক ক্যাসিনো পরিচালনা করত যুবদল। ২০০১ সালে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া রাইফেলস ক্লাবে সায়েম ও মহসীন নামের দুই যুবককে ১২ টুকরা করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব ক্লাবে জুয়ার আসর নিষিদ্ধ করা হয়। ক্লাবগুলোতে র্যাব-সেনাবাহিনীর অভিযান চলত তখন নিয়মিত। এখন যুবলীগের নেতৃত্বে ক্যাসিনো অনেক জমজমাট। তবে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এসব ক্যাসিনো বন্ধে যা করার দরকার সংশ্লিষ্টদের তা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এখন ক্যাসিনোগুলো যুবলীগের নিয়ন্ত্রণে। শুধু এই ৬০টি-ই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় রীতিমতো বাসা ভাড়া নিয়ে চলছে জুয়ার আসর। এর কোনো কোনোটিতে আবার জুয়াড়িদের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরী নারীরা রয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৯৪ সালের দিকে আরামবাগে আগমন ঘটে ওয়ান-টেন খেলার। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার সব ক্লাবে। এ নিয়ে জুয়াড়িদের মধ্যে এতটাই উত্তেজনা ছড়ায়, যার ফলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। ১৯৯৭ সালে দিলকুশা ক্লাবে জুয়াড়িদের হাতে খোকন নামের এক ব্যক্তি মারা যান। এর রেশ ধরে বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল জুয়ার আসর। এরপর আবার চালু হয়। 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি