ঢাকা, শুক্রবার   ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শৈশবে যেভাবে পাচার হন এই অলিম্পিক তারকা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:৩১, ১২ জুলাই ২০২২

অলিম্পিক তারকা মোহামেদ ফারাহ। শিশু কালে অবৈধভাবে ব্রিটেনে পাচার করা হয় তাকে। এর পরে মানুষের বাসাবাড়িতে চাকর হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

বিবিসির কাছে এসব তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ফারাহ তার আসল নাম নয়। যারা তাকে জিবুতি থেকে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন তারাই তার নাম দেন মোহামেদ ফারাহ। তার প্রকৃত নাম হোসেইন আবদি কাহিন।

তার বয়স যখন নয় বছর তখন এক মহিলা তাকে পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ থেকে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন। এর আগে ওই মহিলার সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি।

তিনি জানান, তাকে ব্রিটেনে নিয়ে আসার পর তাকে আরেকটি পরিবারের শিশুদের দেখাশোনার কাজ দেওয়া হয়।

“বছরের পর বছর ধরে আমি এসব আড়ালে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু এরকম একটা বিষয় কতদিন আপনি এভাবে রাখতে পারেন!”, বলেন ব্রিটিশ এই অ্যাথলিট।

দূরপাল্লার এই দৌড়বিদ এর আগে বলেছিলেন যে, তিনি একজন শরণার্থী হিসেবে তার পিতামাতার সঙ্গে ব্রিটেনে এসেছিলেন।

কিন্তু বিবিসি এবং রেড বুল স্টুডিওজের নির্মিত একটি তথ্যচিত্রে তিনি বলছেন, তার পিতামাতা কোনোদিন যুক্তরাজ্যে আসেননি। তার মা এবং দুই ভাই সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সোমালিল্যান্ডে তাদের পারিবারিক খামারে বসবাস করছেন।

ফারাহর বয়স যখন চার বছর, তখন সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধে তার পিতা আবদি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। সোমালিয়া থেকে বের হয়ে গিয়ে সোমালিল্যান্ড ১৯৯১ সালে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে কিন্তু এটি এখনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি।

তিনি বলেন, তাকে যখন তার বাড়ি থেকে জিবুতির একটি পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার বয়স ছিল আট থেকে নয় বছর। পরে একজন নারী তাকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসেন। ওই নারীর সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই এবং ওই মহিলার সঙ্গে এর আগে তার কখনো দেখা হয়নি।

ওই নারী ফারাহকে বলেছিলেন, ইউরোপে তাদের কিছু আত্মীয়ের সঙ্গে থাকার জন্য তাকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, একথা শুনে তিনি বেশ উত্তেজিত ছিলেন।

“আমি তো এর আগে কখনো বিমানে চড়িনি,” বলেন তিনি।

ওই নারী তাকে বলতে বলেন যে, তার নাম মোহামেদ। তিনি বলেন, তার ভ্রমণের জন্য ওই নারীর কাছে ভুয়া কাগজপত্র ছিল যাতে তার ছবির পাশে মোহামেদ ফারাহ নামটা লেখা ছিল।

যুক্তরাজ্যে এসে পৌঁছানোর পর ওই মহিলা তাকে পশ্চিম লন্ডনের হাউন্সলোতে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান এবং যে কাগজে তার আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা লেখা ছিল সেটি তার কাছ থেকে নিয়ে নেন।

“ঠিক আমার সামনে তিনি ওই কাগজটি ছিঁড়ে আবর্জনা ফেলার বিনে ফেলে দেন। ওই মুহূর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি সমস্যায় পড়ে গেছি,” বলেন তিনি।

ফারাহ বলেন, “আমি যদি কোন খাবার খেতে চাইতাম" তাহলে তাকে সেখানে গৃহস্থালি কাজ করতে হতো এবং শিশুদের দেখাশোনা করতে হতো। তিনি বলেন ওই মহিলা তাকে বলেছিলেন: "তুমি যদি আবার কখনও তোমার পরিবারকে দেখতে চাও, তাহলে কিছু বলবে না।”

“প্রায়ই আমি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম,” বলেন তিনি।

ব্রিটেনে এসে পৌঁছানোর পর পরিবারটি প্রথম কয়েক বছর তাকে স্কুলে যেতে দেয়নি, কিন্তু তার বয়স যখন প্রায় ১২ বছর তখন তিনি ফেল্টহ্যাম কমিউনিটি কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্কুলের লোকজনকে বলা হয়েছিল যে তিনি সোমালিয়া থেকে আসা একজন শরণার্থী।

তার একজন শিক্ষক স্যারাহ রেনি বিবিসিকে বলেন, “অপরিপাটি অবস্থায় এবং অযত্নে লালিত" এক শিশুর মতো সে স্কুলে আসতো। সে খুব সামান্য ইংরেজি বলতে পারতো, এবং "আবেগ ও সংস্কৃতির দিক থেকে সে ছিল একবারে বাইরের এক শিশু।”

তিনি বলেন, যেসব লোক নিজেদের তার পিতামাতা বলে উল্লেখ করেছিলেন তারা কখনও স্কুলে শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে আলোচনায় উপস্থিত হননি।

ফারাহর শারীরিক শিক্ষা বা পিই শিক্ষক অ্যালান ওয়াটকিন্সন বলেন এই শিশুটি যখন অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে নামে তখন তিনি তার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন।

“মনে হচ্ছিল একমাত্র যে ভাষাটি সে বুঝতে পারছে তা হলো শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলার ভাষা,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, খেলাধুলাই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন কারণ এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য একমাত্র যে জিনিসটি আমি করতে পারতাম তা হলো বের হয়ে এসে দৌড়ানো।

এক পর্যায়ে তিনি ওয়াটকিন্সনের কাছে তার আসল পরিচয়, তার পটভূমি, যে পরিবারটিতে তাকে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে সেসব বিষয় তুলে ধরেন।

“আমি আমার আসল পরিবারকে এখনও মিস করি। কিন্তু ওই মুহূর্তের পর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে,” বলেন মো ফারাহ।

ফারাহ ১৪ বছর বয়স থেকে একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে খ্যাতি কুড়াতে শুরু করেন যখন তিনি ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোর হয়ে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাকে লাটভিয়ায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু সেখানে ভ্রমণ করার জন্য তার কাছে কোন কাগজপত্র (পাসপোর্ট, ভিসা) ছিল না।

ওয়াটকিন্সন তাকে মোহামেদ ফারাহ নামে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে সাহায্য করেছিলেন। তাকে ২০০০ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।

ফারাহর উপর নির্মিত তথ্যচিত্রটিতে ব্যারিস্টার অ্যালান ব্রিডক বলেন যে, “প্রতারণা অথবা অসত্য তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার নাগরিকত্ব অর্জন করা হয়েছে।”

কোন ব্যক্তি যদি প্রতারণার মাধ্যমে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব অর্জন করে থাকেন, তাহলে সরকার তার নাগরিকত্ব আইনগতভাবে বাতিল করতে পারে।

তবে ব্রিডক বলেন, ফারাহর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি খুব কম।

“সাধারণত পাচার বলতে বোঝায় সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে কাউকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া,” বলেন তিনি।

ফারাহকে তিনি বলেন, “আপনার বেলায় যা হয়েছে, আপনি নিজে ছোট্ট শিশু হয়ে ছোট ছোট শিশুদের দেখাশোনা করতে এবং বাড়িতে চাকর হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং তখন আপনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন যে, ‘এটা আমার নাম নয়’। এসব কিছুর কারণে হোম অফিসের আপনার নাগরিকত্ব নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কম।”

ফারাহ বলেছেন, পাচার এবং দাসত্ব সম্পর্কে লোকজনের যে ধারণা তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তিনি তার কাহিনিটা বলতে চান।

“আমি যে ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছি, ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যে এতো মানুষ যাচ্ছে এবিষয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না। এই গল্পে দেখ যায় যে আমি কতো ভাগ্যবান,” বলেন তিনি।

“যে জিনিসটা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, যা আমাকে আলাদা করেছে, তা হচ্ছে আমি দৌঁড়াতে পারি।”, বলেন তিনি।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি