ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সিরাজগঞ্জের ৫ উপজেলার বন্যা দুর্গত মানুষের আক্ষেপ

আঙ্গরে কেউ দ্যাহে না...

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৫:০২, ১৮ জুলাই ২০২০

যমুনার দুর্গম উমারপুর ইউনিয়নের হাপানিয়া চরের বন্যা দুর্ভোগে বিপর্যস্ত মেহের উন নেছা।

যমুনার দুর্গম উমারপুর ইউনিয়নের হাপানিয়া চরের বন্যা দুর্ভোগে বিপর্যস্ত মেহের উন নেছা।

‘১০/১২ দিন ধইরা পানিতে ভাইসত্যাছি, কাম-কাইজ কিছু নাই। ঘরে দুই ফুইট পানি ইউঠ্যা গ্যাছে। কোনো রহমে চহি উচা কইরা থাইকত্যাছি। এহেনে খ্যায়া না খ্যায়া দিন কাটাইত্যাছি। কেউ আঙ্গরে খবর নিবার নিগা আইসেনা। কেউ দ্যাহেনা।’ বন্যায় নিজের দুর্ভোগের কথা এভাবেই বলছিলেন সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার যমুনার দুর্গম উমারপুর ইউনিয়নের হাপানিয়া চরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুল জব্বারের স্ত্রী মেহের উন নেছা (৬২)। 

নদীতে ঘর-বাড়ি বিলীন হবার কয়েক বছর আগে মিনিদিয়া বাজারের পশ্চিম পাশে বাড়ি করেছে। সেই বাড়ি-ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে পানি উঠে পড়ায় সামগ্রিকভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন পরিবার নিয়ে। শনিবার (১৮ জুলাই) সকালে কোন রকমে সন্তানকে নিয়ে কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা খেয়েছেন। দুপুরের চাল নেই। টিউব ওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় দূর থেকে পানি আনতে হচ্ছে তাকে। চলাচলের জন্য ব্যবহার করছেন কলাগাছের ভেলা। এ অবস্থায় দুর্ভোগের সীমা নেই তার। 

মেহের উন নেছা আক্ষেপ করে বলেন, ভোটের সময় ঠিকই মেম্বর, চেয়ারম্যান ও এমপিরা আসেন। এখন আর খোঁজ নেই। আমরা পুরো ইউনিয়নজুড়ে বন্যায় হাবু-ডাবু খাচ্ছি, কারো দেখা নেই। চেয়ারম্যানের লোকেরা তাও বলেছে কিছু সহায়তা করবে। এমন অবস্থা শৈলজানা, ধুবুলিয়া, ছলের চর, ঘোরজান, স্থলসহ আশপাশের এলাকা। 

এদিকে, এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হচ্ছে- যমুনা বিধৌত চৌহালী, শাহজাদপুর, বেলকুচি, সদর ও কাজিপুর উপজেলা। এখানকার অধিকাংশ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষ করে, চরাঞ্চলগুলোতে চলছে হাহাকার। মানুষের খাদ্য, পানি ও গবাদী পশুর খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। কোন রকমে মাচা উচুঁ করে করছে সবাই বসবাস। আবার বসবাসের অনুপযোগী হওয়ায় এনায়েতপুর-সিরাজগঞ্জ ওয়াপদাবাধ, পাঁচিল-প্যাচাখোলা বাধ জুড়ে আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্য মানুষ তাদের গবাদী পশু নিয়েই। এখানেও তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে চলছে বসবাস।

যমুনার দুর্গম উমারপুর ইউনিয়নের হাপানিয়া চরের বন্যা দুর্ভোগে বিপর্যস্ত মেহের উন নেছা।

ভাটপাড়ার জামিরতা বাধে আশ্রয় নেয়া বুদ্ধু মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক, উমর আলী জানান- অন্যান্য বছর দেখেছি বন্যার সময় সরকারসহ অনেকেই সহযোগীতার হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। বড় বন্যা হলেও এখন পর্যন্ত আমরা কোন সাহায্য পাইনি। কাউকে নিতেও দেখেনি। এরমধ্যে কাজ না থাকায় খুব কষ্ট দিন যাচ্ছে আমাদের। 

এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকালেও যমুনায় সামান্য পানি কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে পানি দুই সেন্টিমিটার কমে শনিবার সকালে বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার যমুনা নদী তীরবর্তী কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার ৪৭ হাজার পরিবারের আড়াই লাখ মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। 

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী একএম রফিকুল ইসলাম জানান, পানি আগামী দুই, তিন দিনের মধ্যে আরো কমতে শুরু করতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে আরো জানান, ঈদের আগে যমুনা নদীর পানি তৃতীয় দফায় বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে কাজ করা জেলার অন্যতম উন্নয়ন সংস্থা ‘মানব মুক্তি’ এর নির্বাহী পরিচালক উন্নয়ন কর্মী হাবিবুল্লাহ বাহার জানান, চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। পুরো দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে দিখেছি- মানুষের কত কষ্ট ও দুর্দশা। একদিকে বন্যা তাদের আক্রান্ত করেছে। অপরদিকে নদী ভাঙ্গন তাদেরকে চরম ভাবে বিপর্যন্ত করে তুলেছে। মানুষের ঠাঁই নাই। আহার নেই। চৌহালী-শাহজাদপুর অঞ্চলের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। তাদের প্রধানত প্রয়োজন খাবার ও একটু আশ্রয়।

এদিকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার ৪৭ হাজার ২১৭ পরিবারের দুই লাখ ১৩ হাজার ৪৭৩ জন মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের উদ্যোগে পাশের উঁচু স্থান ও বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন।

সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ বলেন, ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৪০০ টন চাল, দুই লাখ টাকার শিশু খাদ্য, দুই লাখ টাকার গো-খাদ্য ও চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জেলার বন্যা দুর্গত এলাকার জন্য ১৪২ টন চাল এবং দুই লাখ ৫৪ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। ১৭৯টি আশ্রয় কেন্দ্র ও ৩৩টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে।

এদিকে সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস জেলার বন্যা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ মন্তব্য করে অসহায় মানুষের পাশে সরকারের পাশাপাশি মানবিক মানুষগুলোকেও দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরেজমিনে দুর্গত এলাকা না দেখলে বন্যায় মানুষের চরম অসহায়ত্ব বোঝা যাবেনা। আপনার একটু সহায়তা ওদের মুখে আহার তুলে দিতে পারে। 

তিনি বলেন, করোনায় বেকার অসহায়দের জেলা পরিষদ থেকে নানা ভাবে সহযোগীতা করেছি। বন্যা দুর্গতদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নেবার চেষ্টা চলছে। 

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি