ইন্টারকে বিধ্বস্ত করে ইউরোপ সেরার মুকুট পড়লো পিএসজি
প্রকাশিত : ১৫:৩০, ১ জুন ২০২৫

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বপ্নে বহু বছর ধরে তারকা ভিড়িয়েছে পিএসজি। নেইমার, এমবাপে, মেসিদের নিয়ে তৈরি হয়েছিলো গ্ল্যামারময় এক সুপার টিম। কিন্তু এতদিন অপেক্ষার পর ইতিহাস গড়ল এক ভিন্ন পথের পিএসজি যেখানে গ্ল্যামারের চেয়ে বড় ছিল দলগত চেতনা, কৌশল আর তরুণদের দুর্দমনীয় লড়াই। তাদের দ্যূতিময় আর দাপুটে পারফরম্যান্সের সামনে একেবারে ফিকে পড়ে গেল ইন্টার মিলান। ন্যূনতম চ্যালেঞ্জও জানাতে পারল না তারা। তিনবারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়নদের গোলবন্যায় ভাসিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের আনন্দে ভাসল লুইস এনরিকের দল।
গত রাতে মিউনিখে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ইউরোপিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করে ইতিহাস গড়েছে পিএসজি। ফাইনালে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয় তুলে নিয়ে প্রথমবারের মতো উঠেছে ইউরোপ সিংহাসনের শীর্ষে।
প্রথমার্ধেই গোলমুখে ১৩টি শট নেয় জ্বলে ওঠা পিএসজি। এর মধ্যে লক্ষ্যে ছিল পাঁচটি। অন্যদিকে, নখদন্তহীন ইন্টার দুটি শট নিয়ে কোনোটিই লক্ষ্যে রাখতে পারেনি।
ম্যাচের শুরু থেকেই উজ্জীবিত থাকা প্যারিসিয়ানদের গোল পেতে বেশি সময় লাগেনি। গোছানো আক্রমণে দ্বাদশ মিনিটে এগিয়ে যায় তারা। ভিতিনিয়ার থ্রু বলে এলোমেলো হয়ে যায় ইন্টারের রক্ষণভাগ। ডি-বক্সের ভেতরে বাঁদিকে দুয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজে শট না নিয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুঁজে নেন হাকিমিকে। একেবারে ফাঁকায় থাকা মরক্কান ডিফেন্ডার খুব কাছ থেকে আলতো টোকায় করেন লক্ষ্যভেদ।
ধাক্কা সামলে নেওয়ার পরিবর্তে নির্জীব ইন্টার আট মিনিট পর আরও বড় বিপদে পড়ে। ত্বরিত পাল্টা আক্রমণে ব্যবধান দ্বিগুণ করে চালকের আসন বসে পিএসজি।
কর্নার আদায়ের চেষ্টায় ছিলেন নিকোলো বারেলা। তবে উইলিয়ান পাচো বল খেলায় রেখে বাড়ান খাভারাতস্খেলিয়াকে। জর্জিয়ান উইঙ্গারের পাস পেয়ে উসমান দেম্বেলে বামদিক দিয়ে পৌঁছে যান ডি-বক্সের কাছে। এরপর তিনি দেখেশুনে অন্যপ্রান্তে দুয়েকে দেন বল। তরুণ ফরাসি উইঙ্গারের ডান পায়ের শট প্রতিপক্ষের ফেদেরিকো দিমার্কোর পায়ে লেগে দিক পাল্টে জালে জড়ায়। কিছুই করার ছিল না গোলরক্ষক ইয়ান সোমারের।
৪৪তম মিনিটে দেম্বেলের সামনে সুযোগ আসে। তবে গোলমুখে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন তিনি। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে দুয়ের গড়ানো শট থাকেনি লক্ষ্যে।
বিরতির আগে দুবার পিএসজির রক্ষণে হানা দিলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি ইন্টার। দুটি সুযোগই আসে কর্নার থেকে। ২৩তম মিনিটে ফ্রান্সেসকো আচেরবির হেড ক্রসবারের উপর দিয়ে চলে যায়। ৩৭তম মিনিটে মার্কাস থুরামের হেডও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে বের করার বদলে আরও মলিন হয়ে যায় নেরাজ্জুরিরা। বিপরীতে, আক্রমণের তীব্র ঝাপটা জারি রাখে পিএসজি। আরও তিনবার গোলের আনন্দ ভক্ত-সমর্থকদের উপহার দেয় তারা।
ফের খেলা শুরুর প্রথম মিনিটে খাভারাতস্খেলিয়ার শট গোলপোস্ট ঘেঁষে যায়। ৬১তম মিনিটে হাকিমির কোণাকুণি শট প্রতিপক্ষের একজনের গায়ে লাগায় হয় কর্নার।
দুই মিনিট পরই ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় গোল পেয়ে যান দুয়ে। আরেকটি দুর্দান্ত পাল্টা আক্রমণে ভিতিনিয়ার পাসে ডান পায়ের জোরাল শটে জাল খুঁজে নেন তিনি। তখনই পিএসজির শিরোপা উঁচিয়ে ধরা একরকম নিশ্চিত হয়ে যায়।
এরপর ছিল কেবল ব্যবধান আরও বাড়িয়ে নেওয়ার পালা। ৭৩তম মিনিটে দেম্বেলের রক্ষণচেরা পাসে মাঝমাঠের একটু সামনে বল পেয়ে যান খাভারাতস্খেলিয়া। একটানে ডি-বক্সে ঢুকে গোলরক্ষককে একা পেয়ে কোনো ভুল করেননি তিনি। চতুর্থ গোল! ৮১তম মিনিটে বদলি ব্র্যাডলি বারকোলা পায়ের কারিকুরিতে পৌঁছে যান পোস্টের একদম কাছে। কিন্তু জালের বাইরের দিকে মেরে সুযোগ হাতছাড়া করেন তিনি।
পাঁচ মিনিট পরই ইন্টারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে পঞ্চম গোলের দেখা পেয়ে যায় এনরিকের দল। বারকোলার সঙ্গে বল দেওয়া-নেওয়ার পর জোরাল শটে সোমারকে পরাস্ত করেন ১৯ বছরের ফরাসি মিডফিল্ডার মায়ুলু। বদলি হিসেবে তার মাঠে ঢোকার তখন কেবল দুই মিনিট চলছিল।
এই অর্ধে সিমোনে ইনজাগির শিষ্যরা দুটি শট লক্ষ্যে রাখতে পারে। তবে পিএসজির গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোন্নারুমাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সব মিলিয়ে চরম হতাশা নিয়ে মৌসুম শেষ করতে হলো তাদের। গত মাসেও টিকেছিল দলটির 'ট্রেবল' জয়ের সম্ভাবনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই মিলল না। এবারের বিব্রতকর হারের আগে নাপোলির কাছে সিরি আ ও মিলানের কাছে ইতালিয়ান কাপের শিরোপা খুইয়েছে তারা।
শেষ বাঁশি বেজে উঠতেই উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে পিএসজি। দ্বিতীয় ফরাসি ক্লাব হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল তারা।
১৯ বছর বয়সী দেজিরে দুয়ে এই ফাইনালে হয়ে উঠেছেন গল্পের নায়ক। দুটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট করে গড়েছেন ইতিহাস। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে জোড়া গোল করা সবচেয়ে কনিষ্ঠ ফুটবলারদের একজন এখন তিনি।
তার সঙ্গে আলো ছড়িয়েছেন খাভিচা খাভারাতস্খেলিয়া, সেনি মায়ুলু ও আশরাফ হাকিমি। ফাইনালের পাঁচ গোলই এসেছে পাঁচজন ভিন্ন খেলোয়াড়ের পা থেকে—এ এক নিখুঁত দলগত রূপান্তরের প্রতীক।
এই রাতটি আরও বিশেষ করে তুলেছে কোচ লুইস এনরিকে। ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি—মেয়ের মৃত্যু—আর পেশাদার গৌরব এক হয়ে উঠেছে এই মুহূর্তে। বার্সেলোনার পর এবার পিএসজিকেও ইউরোপ সেরা করে তুললেন তিনি। ম্যাচশেষে মেয়ের ছবিযুক্ত টি-শার্ট পরে যখন মাঠে হাঁটছিলেন এনরিকে, তখন ‘পিএসজি আল্ট্রাস’ তুলে ধরেছিল সেই একই ছবি সম্বলিত বিশাল পতাকা। আবেগ তখন ফুটবলের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এই জয়ে পিএসজি পেয়েছে এক নয়, তিনটি শিরোপা—চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লিগ ওয়ান এবং ফরাসি কাপ। ইউরোপের ‘ট্রেবল’ জেতা দ্বিতীয় ফরাসি ক্লাব হিসেবে তারা যোগ দিল মার্সেইয়ের পাশে, যারা ১৯৯৩ সালে একই শহর মিউনিখেই গড়েছিল ইতিহাস।
এমবি//