ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

ইশ্ কি সুন্দর লালশাক

রুহুল আমিন বাচ্চু

প্রকাশিত : ১৫:০৬, ২ ডিসেম্বর ২০২২

‘নানু ও নানু, তুমি কোথায়?’

‘সুহামনি আমি এখানে।’

‘এখানে কোথায়? আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’

‘ঘরের পেছনে চলে এসো?’

‘ঘরের পেছনটা কোথায়?’

‘ঘরের পূর্বপাশ দিয়ে চলে এসো। আমি তোমাদের জন্য খেত থেকে লালশাক তুলছি-’

‘পূর্বদিক কোন্দিকে নানা? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘সেকি কথা সুহামনি। সকাল বেলার সূর্য কোন দিকে উঠে?’

‘ও তাইতো ‘সকালে সূর্য পূর্বদিকে উঠে’। পেয়েছি নানা। তোমার নারকেল গাছের ফাঁকে সূর্য দেখা যাচ্ছে।’

নানার কণ্ঠ ধরে সুহা তার ছোট ভাই শাহানকে নিয়ে ঘরের পিছনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। পেছন থেকে ছোট মামী ডেকে বলেন, ‘সুহামনি ইজানকে সাথে করে নিয়ে যাও।’

গত রাতে একটা মাইক্রো করে সুহার আব্বু, আম্মু, ইজানের আব্বু আম্মুসহ সবাই একসাথে গ্রামের বাড়ি এসেছে। এটা সুহার নানার বাড়ি আর ইজানের দাদার বাড়ি। সুহা ক্লাস ফাইভে ঢাকার আইডাল স্কুলে পড়ে, শাহানের বয়স চার হলেও এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি, ইজানের বয়স সবে মাত্র তিন বছর। বছর শেষে সুহার স্কুল ছুটিতে সবাই এক সাথে বাড়ি এসেছে মজা করতে। সুহার বাবা বল্লেন, ‘সপ্তাহ খানেক বাড়িতে থাকবেন।’ 

সুহার নানা বল্লেন, ‘পুরো ছুটিটা মানে দুই সপ্তাহ থাকতে হবে।’ 

সকালে নানির হাতের তৈরি পিঠা খুব মজা করে খেয়েছে সুহা, শাহান। সুহা ছড়া কাটে, নানা-নানী ডাকে শাহান, দাদু-দাদা ডাকে ইজান, ফিক্ করে হেসে ওঠে সুহা। 

ইজানের এসবে হিসেব নেই।

রাতে কাঁপা কাঁপা শীত পড়েছিল। নানু লেপ কম্বল ঘাড়ে তুলে বাইরে যাচ্ছেন রোদে দিতে, সুহার আম্মু আর ইজানের আম্মু সাহায্য করছে। ধবধবে সাদা মাটির উঠানের তিন পার্শ্বে লম্বা করে বাঁশ বাঁধা রয়েছে। বাঁশের ওপর কাঁথা কম্বল টাঙ্গিয়ে নানু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। রোদের গরম রাতভর কাঁথা কম্বলে ওম ধরে রাখবে। খুব মজা হবে শীতের রাতে ঘুমাতে।

সুহার নানা বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে পুকুর, পূর্ব পাশ্বে নারকেল সুপারির বাগান, বাড়ির সামনে পেঁপে গাছের সারি। উঠানের এক কোণে জবা, বেলী, আর গন্ধরাজ ফুলের বাগান। রাতভর মৌ মৌ ঘ্রাণে বেশ লাগছিল। কয়েকটা প্রজাপতি কাঁপা কাঁপা ডানায় ফুল গাছে বসছে আর ওড়ছে। সুহা একটু দূরে দাঁড়ানো। খুব মজা করে প্রজাপতির ডানার রঙ দেখছে। 

শাহান কোথা থেকে ছুটে এসে একটা প্রজাপতি ধরে ফেলে আরকি! সুহা ওকে আটকে দেয়। সুন্দর করে বলে, ‘শাহান ভাইয়া, ওদের ধরো না, দেখ না কি সুন্দর করে ওরা ওড়ছে। ওদের ডানার রঙ দেখ, কতো কতো রঙে ভরা ওদের ডানা। খুব সুন্দর তাই না-’

নানু, ডাকছেন, ‘সুহামনি তোমরা কোথায়?’

‘আসছি নানু বলে ইজানকে কোলে তুলে নেয় সুহা। কিন্তু ইজান ওর কোল গলিয়ে নিচে নেমে যায়। ও নিজে নিজেই হাঁটবে ভাবটা এমন। দু’চার কদম হেঁটে ও সামনে একটা খাদ দেখে বসে পড়ে। 

সুহা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে যায়।

সুহার চোখতো ছানাবড়া। এত সুন্দর লালশাকের বাগান, পাশ দিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি সারি সারি লাগানো। লালশাকের ফাঁকে ফাঁকে ধনিয়া পাতার গাছ। সুহার নানা দুই মুঠো লালশাক তুলে গোড়া পেঁচিয়ে রেখেছেন হালকা খড় দিয়ে। 

ইজান এবার আর কোলে থাকতে চাইছে না। সুহার কোল থেকে নিজকে গলিয়ে ফুড়ুত করে নেমে যায়। খেতে নেমেই ছুটাছুটি শুরু করে। শাহান নানার সাথে বসে গেছে শাক তোলার জন্য। নানা ক’গাছি ধনিয়া পাতা তুলতেই ধনিয়া পাতার সুঘ্রাণে পুরো খেতের বাতাস যেন ভরে যায়।

সুহার কণ্ঠে অভিমান, ‘নানা আমাদের আগে ডাকনি কেন? আমরাও লালশাক তুলতাম। ইশ্ কি সুন্দর বাগান যেন লাল গালিচা।’ শাহান লালশাক তুলতে গিয়ে গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলে, দাদু ওকে দেখিয়ে দেন কিভাবে তুলতে হবে। ইজান লাফাতে লাফাতে খেতের মাঝখানে চলে যায়। নানা বলেন, সুহা দাঁড়িয়ে আছ কেন? লালশাক তুলে নাও। আমিতো জানি তুমি লালশাকের লাল ঝোল দিয়ে ভাত রাঙিয়ে খেতে পছন্দ কর। তোমার নানু পুঁটি মাছ দিয়ে রান্না করবে।’

ইজান লাফাতে লাফাতে খেতের আইলে পড়ে কান্না জুড়ে দেয়। সুহা ওকে কোলে তুলে কান্না থামিয়ে দেয়। সুহা সামনে একটা আম গাছের মাঝ ডালে একটা মৌমাছির চাক দেখে বলে, ‘নানা ঐ কালো থলেটা কীসের?’

‘সাবধান,’ ওদিকে যাবে না- ওটা মৌচাক।’ নানার চোখে সতর্ক দৃষ্টি

‘মৌচাক কি নানা?’

‘মৌমাছির বাসা। তোমরা যে মধু খাও। এ মৌচাক থেকেই সংগ্রহ করা হয়।’ 

‘মধু কোথায়? দেখছি নাতো। ’

‘বাইরে থেকে দেখা যায় না। ভালো করে দেখ হাজার হাজার মৌমাছি মৌচাক ঘিরে আছে। মৌচাকের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরী আছে তাতেই মৌমাছিরা মধু জমা করে রাখে।’

‘মধু ওরা কার জন্য জমিয়ে রাখে?’

‘ওরা নিজেরা খায়, মানুষ মৌচাক কেটে-মধু বের করে, কেউ বিক্রি করে, কেউ খায়। জানতো মধু সুস্বাদু খাবার, মধুকে বলা হয় সর্বরোগের মহৌষধ।’

‘জান সুহা, মৌমাছি আল্লাহর শ্রেঠত্বের একটি নমুনা। মৌমাছি ফুল থেকে তার জিহ্বাকে লম্বা করে ফুলের মধু আহরণ করে, পা দিয়ে ফুলের রেণু নিয়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে। মৌমাছির ছোঁয়ায় সফল পরাগায়নের মধ্য দিয়ে ফুল থেকে হয় ফল, শস্য, যা আমরা প্রাণীরা খেয়ে বেঁচে থাকি।

মৌমাছির কতো কতো কাজ। কোথায় ফুল আছে, সে ফুলের পরিমাণ কত-ওরা ইশারায়, দেহ ভঙ্গিতেই একে অপরকে জানায়। তাদের মধ্যে রয়েছে রানী মৌমাছি, স্ত্রী মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি, শ্রমিক মৌমাছি। ওদের সবার কাজ আলাদা আলাদা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ওদের ষড়ভুজ আকৃতির একই মাপের অসংখ্য কুঠুরি দিয়ে বাসা নির্মাণ।’

‘আরো শুনে অবাক হবে, একটি শ্রমিক মৌমাছি প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার ফুলের মধু সংগ্রহ করে।’

‘তাই নানা? আমাদের বইতে মৌমাছির চ্যাপ্টার রয়েছে কিন্তু এত মজার মজার তথ্য নেই।’

এরই মধ্যে শাহান এক মুঠি লালশাক তুলে নিয়েছে, ইজান লাফাতে লাফাতে আবার পড়ে যায়।

‘চলো, আজ আর নয় কাল তোমরাই শাক তুলবে।’ দাদুর পেছন পেছন ওরা ঘরে ফিরে আসে।

লালশাকের আঁটি হাতের মুঠো থেকে বের করতেই সুহা দেখে তার দু’হাত লাল রঙে রাঙিয়ে আছে। ও-খুব মজা পায়, শাহানের হাত দু’টোও লালে লাল। ওরা হাত তালি দিতে দিতে মজা লুফে নেয়।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি