নিরাপদ খাদ্যের সন্ধান
উৎপাদন যেখানে হচ্ছে, সেখানে মনিটরিংটা জোরদার করতে হবে
প্রকাশিত : ১৬:১৬, ২২ মে ২০১৯

যে বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, সেটি হলো যে বিএসটিআই পরীক্ষায় নিম্নমান প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন কোম্পানির ৫২টি খাদ্যপণ্য অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এসব খাদ্যপণ্য বিক্রি ও সরবরাহের সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নেও মাদকবিরোধী অভিযানের মতো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, যেটাকে বলা যেতে পারে আসলে ভেজাল ও নিম্ন মানের খাদ্যপণ্যের বিরুদ্ধে এক ধরণের যুদ্ধ ঘোষণা করার আহ্বানও সরকার এবং সরকার প্রধানের প্রতি জানিয়েছেন হাইকোর্ট।
সেইসঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে, দুধের সিসা পাওয়ার পরও বিএসটিআই কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি এজন্য হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
আসলে শিশুখাদ্য দুধ থেকে শুরু করে চাল, লবণ, তেল, মশলা, কাঁচা ফলমূল, মাছ-মাংস অর্থাৎ সব কিছুতেই নিম্নমান বা ক্ষতিকর যে উপাদানগুলো মিশ্রিত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এতে করে কিডনি, লিভার এগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া এর ফলে ক্যানসার, চর্মরোগের মতো ভয়াভহ রোগও দেখা দিচ্ছে। আসলে মানব শরীরে এর ক্ষতিকারক মাত্রা কতখানি? খাদ্যে ভেজাল সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? এ বিষয়ে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন।
তিনি বলেন, এটার মাত্রা হচ্ছে একটা বিষাক্ত জিনিস আমি কতমাত্রায় কতদিন ধরে খাবো তার উপর নির্ভর করে। আসলে দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যে ভেজাল বা কেমিক্যাল সে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। এবং এগুলো আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো আমরা সরকার সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে জানিয়েছি।
‘২০১১-১২ সালে আমরা সারা বাংলাদেশ থেকে মুরগি এবং মুরগির ডিম এনে ফুড কম্পোজিশন টেবিলের জন্য এনালাইসিস করলাম। তাতে আমরা ক্রোমিয়াম পেলাম। এবং ক্রোমিয়ামের উৎস খুঁজতে গিয়ে আমরা টেনারির বর্জ্য পেলাম। এবং এই একুশে টিভিতেই আমাদের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে টকশোতে আলোচনা হওয়ার পরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দুইশো টেনারি বন্ধ করে দেওয়া হলো, যেখান থেকে টেনারি বর্জ্যগুলো এনে পোলট্রি ফিড তৈরি করা হতো।’
‘সেখানে পরিবেশ অধিদফতরে সেটাই বলা হলো যে এই ধরণে টেনারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তার কারখানার ভেতরেই থাকার কথা। এই বর্জ্য কিন্তু বাইরে আসার কথা না। এ বর্জ্য কেন অন্যরা কিনার সুযোগ পাবে! এ বর্জ্য তো তাকে টেনারির ভিতরেই ধ্বংস করতে হবে। এবং পরিবেশ অধিদফতরের সেই নির্দেশনা না হলে একটা কারখানাকে অনুমোদন দেওয়ার কথা না। কিন্তু তারপরও সাভারে যাওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে টেনারির বর্জ্য তারা কিনতে পারছে; এবং সেগুলো আবার জব্দ করছে। তাহলে কী হচ্ছে! আমরা যে জিনিসটা দেখছি, তার তো কোনও উন্নতি হচ্ছে না। সেগুলো তো থেকেই যাচ্ছে।’
অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন আরও বলেন, যেমন আমরা ল্যাংড়া আমে সিসার উপাদান পেয়েছিলাম। সেই ল্যাংড়া আমে সিসার উপাদানের মাত্রা কেন বেশি, সেটা খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখলাম যে ৩০ বারের অধিক ইনসেকটিসাই স্প্রে করা হয়েছে। এরপরই নিরাপদ খাদ্যের জন্য ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ হলো। তারপর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ হলো। তারা কাজ করছে। তাই আমাদের ধারণা ছিল আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু সেই অনুপাতে তো এর অগ্রগতি হচ্ছে না।
তিনি বলেন, একটা জিনিসে এবার অবাক হলাম, সেটা সোডিয়াম সাইক্লোমেট। আমরা ২০০৫ সালে সোডিয়াম সাইক্লোমেট নিয়ে মানববন্ধব থেকে শুরু করে সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছি। সোডিয়াম সাইক্লোমেট আমেরিকাতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ১৯৬৭ সালে। এবং আমাদের এখানে সোডিয়াম সাইক্লোমেট ব্যবহার করা হতো। এবং সেগুলোর জন্য আমরা যখন দাবি করলাম, তখন সেখানে আইন করা হলো। এবং এ রকম মোবাইল কোর্ট দিয়ে সোডিয়াম সাইক্লোমেট তুলে নেওয়া, জব্দ করা নানা কাজ হলো। এখন আবার তারা সোডিয়াম সাইক্লোমেট পেয়েছে। সোডিয়াম সাইক্লোমেট এখনও খাবারে ব্যবহার হচ্ছে। এতো দীর্ঘদিন ধরে চৌদ্দ বছর ধরে সতর্ক করার পরেও এগুলো তো যাচ্ছে না। এগুলো তো বন্ধ হচ্ছে না।
আর তাই সচেতন হওয়ার বিষয়টা নির্ভর করছে যে ভোক্তাকে জানতে হবে কোনটার মধ্যে কী ধরণের ভেজাল আছে। এখন যেমন দুধ হচ্ছে শিশুখাদ্য। দুধের বিকল্পটা কী? এখন একটা বাচ্চাকে দুধ খেতে হবে। বাড়ন্ত বয়সের একটা বাচ্চার শরীর বৃদ্ধির জন্য তাকে দুধ দিতে হবে। এখন দুধের বিকল্প হিসেবে তাকে কী দেওয়া? এবং যেটা দেওয়া হবে সেটাই যে ভেজালমুক্ত, সেটার নিশ্চয়তা কোথায়?
‘আসলে ভোক্তার পক্ষে পুরোপুরি সতর্ক হওয়া সম্ভব নয়। এখন সরকার চেষ্টা করছে, অনেক আইন হয়েছে, অনেকগুলো সংস্থাও কিন্তু এখানে কাজ করছে। কিন্তু তারপরও অবস্থার উন্নতির চেয়ে কিন্তু নতুন নতুন ভেজাল আমরা পাচ্ছি। যার ফলে মনে হচ্ছে, মানুষ এখন জেনে শুনেই বিষ খাচ্ছে।’
অধ্যাপক আরও বলেন, ঠিক আছে, সরকারের উদ্যোগ আছে; অনেক আইন আছে। সেই আইন তৈরির সঙ্গে আমরাও যুক্ত ছিলাম। মোবাইল কোর্ট কাজ করছে। কিন্তু এগুলো মধ্যে একটা সমন্বয় দরকার। এবং মনিটরিংটা ইফেকটিভ মনিটরিং হওয়া দরকার। ইফেকটিভ মনিটরিং হলে এটার উৎপাদন যেখানে হচ্ছে, সেখানে মনিটরিংটা জোরদার করতে হবে। তাহলে হয়তো আমরা এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাবো।
(অনুলিখন করেছেন আব্দুল করিম।)
আরও পড়ুন