ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘কথার কথা’ আবার কি?

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৭:০৩, ১১ অক্টোবর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

‘কথার কথা? ‘অবাক হয়ে গেলাম বন্ধুটির মন্তব্যে। প্রগতিশীল বলে তাঁর নাম-ডাক আছে, পড়াশোনার ব্যাপ্তিও তাঁর কম নয়। সাহিত্য-সমাজ নিয়েও তিনি চিন্তা-ভাবনা করেন। এহেন ব্যক্তিটি যে এমন একটা উৎকট মন্তব্য করবেন, ভাবতেই পারিনি। গত দু’দিন ধরে যে বিষয়টি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, সে বিষয়টি নিয়েই বন্ধুটিকে দু’এক কথা বলছিলাম। কিন্তু তা নিয়ে যথাযথ চিন্তা-ভাবনা না করেই হালকাভাবেই তিনি বলে বসলেন, ‘ও তো একটা কথার কথা’।

বিষয়টির সূত্রপাত এ ভাবেই। দপ্তরে বসে কাজ করছিলাম- সাড়া দিয়ে প্রবেশ করলেন তরুণী সহকর্মীটি, যিনি আগামীকাল থেকেই মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যাচ্ছেন। বিদায়ী সাক্ষাৎকারের জন্য এসেছেন তিনি। এ কথা সে কথা বললাম, আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করলাম তাঁকে আগামী দিনগুলোর জন্যে, হাসি-ঠাট্টার কথাও হলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তাঁর স্বামী জনের কথাও উঠল- ঐ ঠাট্টার বুনটেই। পরিচিত সেও আমার। 

ঐ সব কথার রেশ ধরেই এক সময়ে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘I am proud that I am carrying John’s child.’ একটা গর্বের আভা ছড়িয়ে পড়ল তাঁর সারা মুখে। কিন্তু কেন জানি, খট্ করে কথাটা লাগল আমার কানে।

সারাদিন ধরেই ঐ একটি বাক্যই জলের মতো ঘুরে ঘুরে আমার মনের অলি-গলিতে ঘুরতে লাগল। বাড়ী ফিরে রাতের খাবারের পর যে বইটি পড়ছিলাম, সেটা নিয়েই বসা গেল- রমানাথ রায়ের ছোট গল্প। পড়তে পড়তে একটি গল্পের মাঝামাঝি গল্পের নায়িকা মালতীর মন্তব্য পড়ে আবারও চমকালাম। সন্তানসম্ভবা মালতী দৃঢ়স্বরে বলছে, ‘না, ও আমি করতে পারবো না। অনিমেষের সন্তান আমার গর্ভে’।

আমি ধীরে ধীরে বইটি মুড়ে রাখলাম। তিনটে জিনিষ আমাকে অবাক করল- এক, একটি কথা বাস্তব জীবনে শুনেছি, আর অন্য কথাটি গল্পে পড়েছি। দুই, কথাটি একজন বিদেশিনী বলেছেন, আবার কথাটি এক বাংলা গল্পের নায়িকাও বলেছেন। তিন, কথাটি এক জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে বাংলায়, অন্য জায়গায় ইংরেজীতে। কিন্তু এতসব ভিন্নতা সত্ত্বেও ইংরেজী ও বাংলা দুটো বাক্যই তো একই কথাই বলেছে। এবং সেখানেই আমার যত অস্বস্তি, যত আপত্তি।

দু’টো কথনেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় তিনটি- দু’টো প্রত্যক্ষ আর একটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ ব্যাপার দুটো হচ্ছে- এক, সন্তানটি পুরুষের- একটি ক্ষেত্রে জনের, অন্য ক্ষেত্রে অনিমেষের। দুই, উভয় ক্ষেত্রেই নারী হচ্ছেন শুধুমাত্র একটি আধার, যা শিশুটিকে ধারণ করেছে মাত্র। পরোক্ষভাবে এটাই বেরিয়ে আসছে যে-  নারী মানেই পুরুষের সম্পত্তি।

ভেবে পাই না, এটা কেমন করে হয়? একটি মানব সন্তান মা-বাবা দু’জনেরই অবদানের ফল- দু’জনেরই সৃষ্টি। সেখানে কেমন করে ভাবা হয় যে- সন্তানটি পুরুষেরই? এমন একটি ব্যাপারকে কেমন করে ‘কথার কথা’ বলা যায়? কথা তো শুধু কথাই নয়। কি বলছি, কেন বলছি, কেমন করে বলছি, তাও তো শুধু শব্দের সমষ্টি নয়, সে তো ইতিহাস, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, মানসিকতা ও সমাজ-বাস্তবতার প্রতিফলনও। 

অতএব, যে বাক্যদ্বয় পূর্বোল্লেখিত হয়েছে, তা মানব-জন্মের বিবর্তনে সার্বজনীনভাবে নারীর ভূমিকাকে নিতান্ত খাটো করেই দেখা  হয়নি, সেখানে একটি অসম্মানজনক অবস্থানেই তাঁকে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে মানব-জন্ম বিবর্তনে নির্দেশিত ভূমিকাতে পুরুষের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য যেন জ্বলজ্বল করে- বলা বাহুল্য, অন্যায় ও অসত্যের ধ্বজা উড়িয়ে। সেখানে নারীর ভূমিকাকে অবদমিত করা হয়েছে- সমস্বীকৃতি তো দূরের কথা। পুরুষশাসিত সমাজে এর চেয়ে বেশী কিই বা আশা করা যায়?

সুতরাং মানব শিশুর পৃথিবীতে আগমন ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে সচরাচর যা বলা হয় এবং যেমন করে বলা হয়, তার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। সে বক্তব্যে নারী-পুরুষের যৌথ ভূমিকার সমস্বীকৃতি তো থাকতেই হবে, সেইসঙ্গে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে নারীর ভূমিকার প্রতি। কারণ, সত্যিকার অর্থে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- মানব শিশুর জন্ম ঘটনায় মায়ের অবদানই বেশী। তিনি সন্তানকে ধারণ করে থাকেন নিজ দেহে দীর্ঘদিন। মায়ের দেহ থেকে পুষ্টি নিয়েই ভ্রুণের বর্ধন। অত:পর অতীব তীব্র প্রসব বেদনার মধ্য দিয়ে মা একটি শিশুর জন্ম দেন। 

সন্তান ধারণ ও জন্মদানের দীর্ঘ যে কষ্টের পথ, তা পাড়ি দেয়া শুধু নারীর পক্ষেই সম্ভব। পুরুষকে যদি সন্তান ধারণ করতে আর সন্তানের জন্ম দিতে হতো তাহলে আমার মনে হয়, পৃথিবীর জনসংখ্যা ৪০০ এর বেশী হতো না।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি