ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে সিআরআই’র পর্যবেক্ষণ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৪৫, ৭ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৭:৫৫, ৭ জুলাই ২০২০

চীনের উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী যেভাবে তাণ্ডব চালাচ্ছে তাতে প্রতিনিয়ত স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান হারাচ্ছে বিশ্বের বহু মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি, পিছিয়ে পড়ছে বিশ্বের অর্থনৈতিক অবকাঠামো। এরইমধ্যে পৃথিবীব্যাপী আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সোয়া কোটি মানুষ। প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখের কাছাকাছি। 

এদিকে আক্রান্ত ও সংক্রমণের দিক থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজার ১৫১ জন বাংলাদেশি। এছাড়া আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৪৫ জন। মহামারি আকার ধারণ করা এই ভাইরাসের প্রকোপ কবে থামবে তা সঠিকভাবে কেউই বলতে পারছে না। এর সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব নেই কারও কাছে। 

ধারণা করা হচ্ছে, প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশেও স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান হারাতে পারে ৬০ লাখ মানুষ। দেশের এই ক্রান্তিকালে করোনা পরবর্তী সময়ে কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে চলছে বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যালোচনা। করোনাপরবর্তী সময়ে কিভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায় তা নিয়ে ইতিমধ্যে বেশকিছু প্রস্তাবনা প্রদান করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। সেখানে বলা হয়েছে, ‘এক বছরের মধ্যে এই সমস্যাকে কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।’

‘কোভিড-১৯ কালে সক্রিয় বাংলাদেশ: কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি’ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে বিস্তারিত। সিআরআই-এর জন্য যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন ইমরান আহমেদ ও সৈয়দ মফিজ কামাল।

পাঠকের উদ্দেশ্যে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো:

কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিপর্যস্ত করে চলেছে। বাধ্যতামূলক ছুটির কারণে অর্থনীতির গতি নিম্নমুখী। স্বল্প আয়ের এবং/অথবা শ্রমঘন প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সঙ্গে যুক্তরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এসব চাকরির বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে যুক্ত। 

বলা যায়, এ সব খাতের কর্মজীবী ও উদ্যোক্তা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। কর্মীরা অস্থায়ী। অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে তাদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অবশ্য, স্থায়ী ধরনের প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিতদের একটি অংশও চাকরি হারাবে। 

সিআরআইয়ের হিসেবে, চাকরিচ্যুতির ‘স্থায়ী’ প্রভাব পড়বে আনুমানিক ৬০ লাখ লোকের ওপর যা বেকারত্বের হার প্রায় দ্বিগুণ করবে। মোট প্রায় ২ কোটি ৪০ লোক এর যন্ত্রণা ভোঁগ করবে।

বর্ধিত বেকারত্ব ও মৌলিক প্রয়োজন যথাযথ মেটাতে না পারার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে নতুন একটি ধারা যুক্ত করবে, যাদের ‘নব্য দরিদ্র’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে উপার্জন হারিয়ে তারা দারিদ্র সীমার নিচে চলে এসেছে। নব্য দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়াবে আনুমানিক ৩ কোটি ৮০ লাখ গ্রামে ২ কোটি ৭০ লাখ ও শহরে ১ কোটি ১০ লাখ। এভাবে নব্য দরিদ্রের হার দাঁড়াবে ২২.৬ শতাংশ। বিদ্যমান ১৮.৯ শতাংশ দরিদ্রের সঙ্গে তারা যুক্ত হবে, মোট দরিদ্র্য হার দাঁড়াবে ৪১.৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা আর্থিক ও মুদ্রা প্রণোদনার সমন্বয়ে একটি প্যাকেজ ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, যার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি জিডিপির ৩.৭ শতাংশ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, কর্মসংস্থানবিহীন পুনরুদ্ধার গত এক দশকে অর্জিত আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে চরম ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, বিশেষ করে আমাদের দেশে স্বাভাবিক সময়েই যখন তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উচ্চমাত্রায়। এ অবস্থায় কম দক্ষ মানুষের জন্য আয় তুলনামূলক কম হলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য সামনে রেখে আরও কিছু খাতভিত্তিক প্রণোদনা ও বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সবার জন্য উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জন্য যা অপরিহার্য। 

নীতিনির্ধারকদের কাছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ এখানে তুলে ধরা হলো :

১. শ্রমঘন উপখাতগুলোত বাড়তি প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, যা  থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ ও বাড়তি পণ্য রফতানি করতে পারে। কৃষি গবাদিপশু ও মৎস্য উপখাতসহ, কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত যেখানে  শ্রমদানের উপযোগী মানুষের ৪১ শতাংশ নিয়োজিত। জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১৩.৭ শতাংশ। তদুপরি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বাড়তি পণ্য রফতানির সুযোগ রয়েছে। উচ্চ কর্মস্থান সৃষ্টির অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক, চিকিৎসা সংক্রান্ত পণ্য ও সরঞ্জাম উৎপাদন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও লজিস্টিক, খুচরা ব্যবসা, নির্মাণ, ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা। 

২. শ্রমঘন অবকাঠামো প্রকল্পসমুহের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শুরু।

৩. এমএসএমই-এর মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যাদের ব্যাংক ঋণ সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই, তাদের অর্থায়নের জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকার ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি পিকেএসএফ-এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায় সহায়তা দিতে পারে। এ কাজে এমএফআই পার্টনারদের মাধ্যমে বিদ্যমান এসএমই গ্রহীতাদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব। ডিজিটাল আর্থিক সেবা, আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নেওয়া, এ সবের মধ্যে একটি সমন্বিত কৌশল উদ্ভাবন করা চাই। 

৪. স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও প্রবাস থেকে ফিরে আসা কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতি বাড়তি নজর দান।

৫. অঞ্চলভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ উদ্যোগকে ফাস্ট ট্র্যাক-এ অন্তর্ভুক্ত করা।

প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি

কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশে শত শত মানুষের প্রাণ সংহার করেছে। এর বাইরেও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তৃতিরোধের জন্য বাজার ও সীমান্ত বন্ধ করা, চলাচল সীমিত রাখা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর আশু ও প্রধানত নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শ্রমঘন কর্মসংস্থানে। শিল্প-কারখানা, কৃষি খামার, খুচরা ব্যবসা, পর্যটন, পরিবহন ও বাজার চেইন এ সব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অনানুষ্ঠানিক খাত বিশেষভাবে নিম্নমুখী। বেঁচে থাকার জন্য  ৬ কোটি শ্রমশক্তির ৮৪ শতাংশ এখনও কৃষি, দিনচুক্তি ভিত্তিক নির্মাণ কাজ, পরিবহন, কিংবা শহরের রাজপথে-ফুটপাতে হকারের মতো কোনো না কোনো ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাত কিংবা ‘স্বল্প আয়ের’ শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। 

১. এসব চাকরির সঙ্গে যুক্তরা স্বল্প দক্ষতার, নিম্নআয়ের। খাতওয়ারি কর্মসংস্থানে রয়েছে অসমতা। এ খাতের শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা এসেছেন কম আয়ের পরিবার থেকে। তাদের নগদ অর্থের প্রবাহ কম। স্বাস্থ্য বীমা বা নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। খাদ্য মজুদ ও লজিস্টিক ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দামেও রয়েছে ওঠানামা। তদুপরি, তরুণ-যুবক শ্রমশক্তির (৩৫ বছরের কম বয়স্করাই ৪৩ শতাংশ) মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। 

২. এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রাপ্যতার সুযোগ কমে যাওয়া। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী সঞ্চয় ভাঙিয়ে চলবে কিংবা আয়ের উৎস বহুমুখী করবে এটাও কার্যকর বিকল্প নয়। এভাবে বেশিদিন চলা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সঙ্গতকারণেই অনেকের জন্য বেঁচে থাকা ও খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে। কোভিড-১৯ মহামারী কেবল কর্মসংস্থান ও উপার্জন কমিয়ে দেয়নি, সার্বিক অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন হচ্ছে চলতি অর্থ বছর (২০১৯-২০) ও আগামী অর্থ বছর (২০২০-২১) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে ২-৩ শতাংশ। 

৩. গত মার্চ, ২০২০, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবির এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.১ শতাংশে নেমে যেতে পারে (সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তৈরি হলে)। এর অর্থ হচ্ছ, কোভিড-১৯ অর্থনীতি থেকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার হাওয়া করে দিতে পারে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ২০২০ অর্থ বছরে রফতানি আয় পূর্ববর্তী বছর থেকে ৫-৮ বিলিয়ন ডলার কম হতে পারে (অর্থাৎ ২০ শতাংশ পর্যন্ত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ, যা গ্রামীণ পরিবারগুলোতে ভোগের চাহিদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে- ২০২০ সালের মার্চ মাসে কমেছে ১২ শতাংশ এবং এপ্রিলে ৩০ শতাংশ। আগামী মাসগুলোতে এ প্রবাহ আরও কমতে পারে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, ২০২০ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২২ শতাংশ কমবে। 

এ নিবন্ধে বিভিন্ন খাতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে। যেমন, চাকরি হারানো বা বেকারত্ব। যে সব উপাদান চাকরি সৃষ্টিতে সহায়তা করে তার প্রতিও আলোকপাত করা হয়েছে। কর্মসংস্থান প্রশ্নে সরকারের যে সব উদ্যোগ রয়েছে তাও পর্যালোচনা করা হয়েছে। সবশেষে রয়েছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সক্রিয়া নীতিনির্ধারকদের জন্য কিছু সুপারিশ। ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্যও করণীয় আমরা তুলে ধরেছি।

১. লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৭, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
২. লেবার ফোর্স সার্ভে, ২০১৭
৩. সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস স্প্রিং ২০২০, বিশ্বব্যাংক

কাজ হারানোর যন্ত্রণা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ মহামারী দুই ধরনের চাকরিচ্যুতি ঘটিয়েছে লকডাউনের প্রভাবে ‘সাময়িক’ চাকরি হারানো এবং ‘স্থায়ীভাবে’ চাকরি হারানো। বিভিন্ন সূত্রের হিসাব থেকে অনুমান লকডাউনের দুই মাসে সাময়িক চাকরি হারানো লোকসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ। এ সংখ্যা চারটি প্রধান খাত বন্ধ থাকার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে- ৭০ লাখ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বা এসএমই শ্রমিক, ৫০ লাখ পরিবহন শ্রমিক (রিকশাচালক ও সিএনজি অটোরিকশা চালকসহ), ৩০ লাখ নির্মাণ শ্রমিক ও ৩০ লাখ ম্যানুফ্যাকচারিং বা শিল্প শ্রমিক (এমএসএমই ম্যানুফ্যাকচারিংসহ)

৪. লাইটক্যাসল কনসালটিং ফার্মের মতে, কৃষি খাতে আরও ১ কোটি লোক উপার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

৫. এ সব যুক্ত করলে কাজ হারানো লোকের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি দাঁড়াবে। অনেক চাকরি হারানোর ঘটনা ঘটেছে সরকার আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে (এ নিবন্ধে ২ মাসের হিসাব দেখানো হয়েছে)। এ চাকরি হারানো সাময়িক। 

৬. বেশিরভাগ রিকশাচালক, বাস-ট্রাক শ্রমিক ও সিএনজি চালক অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে কাজে ফিরবে। অনেক দিনমজুর ফসল কাটার মৌসুমে কাজ ফিরে পাবে। নির্মাণ শিল্প সম্পর্কেও একই কথা। পোশাক কারখানা খোলার কারণে অনেকের বেকারত্ব ঘুচে যাবে।

তবে বাণিজ্য ও উৎপাদন খাতে এড়ানোর অযোগ্য অধোগতির কারণে অনেক লে-অফ স্থায়ী রূপ নেবে। এ সব চাকরি জীবীকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব নির্ধারণে প্রধান উপাদান হবে। বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিফোন ভিত্তিক এক সার্ভেতে দেখা যায়, রফতানি আদেশ ব্যাপক হারে বাতিল এবং ভবিষ্যৎ রফতানি সম্ভাবনায় অনিশ্চয়তার কারণে অন্তত ৪৭ শতাংশ পোশাক শ্রমিক (যে সংখ্যা দাঁড়াবে ২৩ লাখ) তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক চাকরি হারাতে পারে। 

৭. কয়েকটি নির্বাচিত খাতে কর্মসংস্থান
১৫ লাখ রিকশা শ্রমিক
৩৬ লাখ পোশাক শ্রমিক
৫২ লাখ পরিবহন শ্রমিক
২৬ লাখ নির্মাণ শ্রমিক
২৪ লাখ হকার  

৪. লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৭, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নিজস্ব মূল্যায়ন
৫. জীবীকার ওপর করোনা ভাইরাসের প্রভাব : বাংলাদেশের গ্রামীণ ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী, ১২ মে ২০২০, লাইটক্যাসল পার্টনারস
৬. লকডাউন সময় ২ মাস ধরে হিসাব করা হয়েছে
৭.আরএমজি শ্রমিকদের জন্য মহামারীর কী অর্থ  What the pandemic means for RMG workers: https://www.dhakatribune.com/opinion/op-ed/2020/05/05/what the-pandemic-means-for-rmg
৮. হাউসহোল্ড আয়-ব্যয় সার্ভে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
৯.‘লাইভলিহুডস, কোপিং অ্যান্ড সাপোর্ট ডিউরিং কোভিড-১৯ ক্রাইসিস’, ১৬ এপ্রিল ২০২০, বিআইজিডি অ্যান্ড পিপিআরসি
১০.“Reaching Out to the Poor and Needy with Direct Cash Support: Dealing with the Last-Mile Delivery Challenge,”
April 2020, Policy Research Institute.
১১. Coronavirus shutdown makes 2.4cr new poor in Bangladesh: https://www.newagebd.net/article/105687/coronavirus-shutdown-makes-24cr-new-poor-in-bangladesh-binayak-sen
১২. MSMEs - both a choice and a reality for Bangladesh: https://www.thefinancialexpress.com.bd/views/msmes-both-a-choice-and-a-reality-for-bangladesh-1566055028
১৩. At the core of our potential: https://www.dhakatribune.com/opinion/2018/07/10/at-the-core-of-our-potential
১৪. Impact on Bangladesh’s SME Landscape, based on survey on 4 April, 2020, LightCastle Partners and Sheba.xyz
১৫. Author’s estimates.
১৬. Author’s estimates.
১৭. World Development Indicators database, World Bank

‘স্থায়ী’ চাকরি হারোনার অভিঘাত : বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া হিসেব 
সূত্র বেকার (মিলিয়ন) ক্ষতিগ্রস্তদের ওপর আর্থিক প্রভাব (মিলিয়ন)
বিশ্বব্যাংক  ৭                ২৮
এডিবি      ৪                 ১৬
পিআরআই  ১২             ৫৮
সিআরআই   ৬              ২৪
সিপিডি     -               ৫৬
পিপিআরসি / বিআইজিডি  ৭০
নিউজইন্টারভিউস          ৫০

বাংলাদেশে নতুন বেকার সংখ্যা নিয়ে সিআরআই হিসাব (কোভিড-১৯ কালে চাকরি হারানো) ৬ মিলিয়ন, যা মোট শ্রমশক্তির ১০ শতাংশপ্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন ধরলে প্রায় ২৪ মিলিয়ন বা দুই কোটি ৪০ লাখ লোক কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। 

৮. দারিদ্র্য পরিস্থিতি : ‘নব্য দরিদ্র’
জীবনযাত্রা, আয় ও দারিদ্র্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার ধারাবাহিকভাবে কমছে, বছরে ১.২ শতাংশ করে। জীবীকা হারানো ও তার প্রভাবে আয় কমে যাওয়ার কারণে করোনা মহামারী দরিদ্র মানুষের সংজ্ঞায় একটি উপধারা যুক্ত করেছে- ‘নব্য দরিদ্র’।

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দারিদ্র্য চিত্র- বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া হিসাব

৪১.৫                           ৩৯.৮          ৩৩.২
পিপিআরসি/বিআইজিডি       পিআরআই    বিআইডিএস

পিপিআরসি/বিআইজিডি-এর এক সার্ভেতে (১৭ এপ্রিল, ২০২০) দেখানো হয়েছে, দরিদ্র ও অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপার্জন বিপুলভাবে কমে গেছে। তাৎক্ষণিক হিসাবে দেখা যায়, শহরের বাসিন্দাদের আয় গড়ে ৮২ শতাংশ কমে গেছে ( ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাসিক আয়ের সঙ্গে তুলনা)। গ্রামের উত্তরদাতারা বলেছেন, আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। 

৯. কোভিড-১৯ এর প্রভাবে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার কারণে নব্য দরিদ্র দাঁড়াবে ৩৮ মিলিয়ন- ২৭ মিলিয়ন গ্রামে এবং ১১ মিলিয়ন শহরে। অতএব, নতুন নব্য দারিদ্র্য হার দাঁড়াবে ২২.৬ শতাংশ। বিদ্যমান দারিদ্র্য হার ১৮.৯ শতাংশ। মোট দরিদ্র্য হার লাফিয়ে দাঁড়ায় ৪১.৫ শতাংশ। পিআরআই ভোগ প্রবণতা থেকে দারিদ্র্য চিত্র তৈরি করেছে। ভোগ ব্যয় কমে যাওয়ার হিসাব থেকে বলা যায় মোট দরিদ্র দাঁড়াবে ৩৪.১-৪৫.৫ শতাংশ। 

১০. পিআরআইয়ের প্রাক্কলন অনুযায়ী মোট নতুন দরিদ্র দাঁড়াবে ১২.৮ মিলিয়ন ও ২৬ মিলিয়নের মধ্যে। বিআইডিএস-এর হিসাবে নতুন দরিদ্র দাঁড়াবে ২৪ মিলিয়ন (১৮ মিলিয়ন শহরে ও ১৫.৫ মিলিয়ন গ্রামে) নব্য দারিদ্র্য হার বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৩৩.২ শতাংশ। 

১১.এমএসএমই-এর গুরুত্ব ও অনানুষ্ঠানিক খাত
অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ কর্মী জড়িত, যার মধ্যে কৃষিখাতে যুক্তদেরও ধরা হয়। বাংলাদেশে এমএসএমই (মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান) খাত ও অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে পার্থক্য টানাও কঠিন। একটিকে আরেকটির ভেতরেও ফেলা চলে। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি এমএসএমই প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করছে। ১২. ২০১৫ সালে এডিবির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, জিডিপিতে এমএসএমই-এর অবদান ২৫ শতাংশের মতো। মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। ১৩. এসএমই ফাউন্ডেশন-এর হিসাব অনুযায়ী বেসরকারি খাতের প্রতি তিনটি চাকুরির ক্ষেত্রে এমএসএমই-এর অবদান দুটি। লাইটক্যাসল পার্টনারস দেখিয়েছে, কৃষিতে মোট কর্মসংস্থানের ৭০-৮০ শতাংশ সৃষ্টি করছে এমএসএমই খাত। ১৪. গ্রাফ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের চিত্র-

৪৮.৪    ৩৪.৯    ১৬.৭
শিল্প    সেবা     কৃষি

কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি : খাতওয়ারি চিত্র
কর্মসংস্থানে বিভিন্ন খাতের অবদান অনুসারে জিডিপিতে অবদান নাও হতে পারে। কর্মসংস্থানে সর্বোচ্চ পাঁচটি খাতের (কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং, বাণিজ্য, পরিবহন ও লজিস্টিক এবং নির্মাণ) অবদান ৮৪ শতাংশ, কিন্তু জিডিপিতে তাদের অবদান ৭০ শতাংশ। ১৫. পশুপালন ও মৎস উপখাতসহ কৃষি খাত মোট কর্মসংস্থানে ৪১ শতাংশ অবদান রাখে, কিন্তু জিডিপিতে অবদান মাত্র ১৩.৭ শতাংশ। 

আনুপাতিক অবদান বিবেচনায় রেখে আমরা বলতে পারি, জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১ শতাংশ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ে ৩ শতাংশ। ১৬. এ থেকে আমরা দেখতে পাই স্বল্প উৎপাদনশীলতা ও স্বল্প আয়ের সম্পর্ক। এ খাত অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানি আয়েরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

‘কৃষি খাত মোট কর্মসংস্থানে ৪১ শতাংশ অবদান রাখে, কিন্তু জিডিপিতে অবদান মাত্র ১৩.৭ শতাংশ’উচ্চ উৎপাদনশীল ম্যানুফাকচারিং থেকে আসে জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশ। মোট কর্মসংস্থানে এ খাতের অবদান ১৪ শতাংশ, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে কর্মসংস্থানে এ খাতের গুণিতক অবদান রয়েছে। অর্থনীতিবিদ জায়েদি সাত্তারের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে- তৈরি পোশাক শিল্প, নিটিং, ফার্নিচার, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ও হাল্কা প্রকৌশল-এর মতো ম্যানুফ্যাকচারিং খাত চাকরির রয়েছে গুণিতক প্রভাব।  আসন্ন বিশ্ব মন্ধার কারণে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প বিশেষভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। 

বাণিজ্য (পাইকারি ও খুচরা), পরিবহন ও লজিস্টিক এবং নির্মাণের মতো খাত অভ্যন্তরীণ চাহিদার দ্বারা পরিচালিত হয়। কর্মসংস্থান ও জিডিপিতে রয়েছে এ সব খাতের ভারসাম্যপূর্ণ অবদান। 
অন্য যেসব খাতের উল্লেখ করতে হয় সেগুলো হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সরকারি খাত বা পাবলিক সেক্টর। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যসেবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা খাত শ্রমঘন। সরকারি খাতে তাৎক্ষণিকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। পুঁজিঘন সরকারি অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বল্প মজুরির কর্মী নিয়োগ হতে পারে।

জিডিপির অনুপাতে খাতওয়ারি কর্মসংস্থানের হিস্যা
খাত           কর্মসংস্থানে হিস্যা            জিডিপিতে হিস্যা
কৃষি             ৪১%                         ১৪%
ম্যানুফ্যাকচারিং
ও প্রসেসিং      ১৪%                      ২৪%
পাইকারি
ও খুচরা ব্যবসা   ১৪ %                   ১৩% 
পরিবহন ও
লজিস্টিক         ৯%                   ১১%
নির্মাণ         ৬%                    ৮%
শিক্ষা         ৪%                 ২%
গৃহকর্ম        ২%                 ২%
অতিথিসেবা         ২%                ১%
সরকারি খাত             ২%          ৪%
স্বাস্থ্য ও এমএফআই         ১%      ২%
ডাক, টেলিকম ও প্রযুক্তি      ১%     ৩%
আর্থিক খাত               ১%         ৩% 
এনার্জি             ০%             ২%
রিয়েল এস্টেট       ০%       ৬%
অন্যান্য সেবা      ৫%        ১০%
সূত্র : ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট ২০২০, বিবিএস ও লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৬-১৭, বিবিএস; সিআরআই বিশ্লেষণ

# নোট : সারণীর হিসাব রাউন্ড ফিগারে। 
## নোট : কর্মসংস্থানের তথ্য-উপাত্ত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের, জিডিপি তথ্য-উপাত্ত ২০১৯-২০ অর্থ বছরের

সরকারি পদক্ষেপ ও তার বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন
করোনা সমস্যা বা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের অর্থনৈতিক প্রণোদনা সাধারণভাবে ভাল সাড়া ফেলতে পেরেছে। কারণ এটা যথেষ্ট সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং এর লক্ষ্য অর্থনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ শাখার পুনর্গঠন ও সক্রিয় করার জন্য অতি প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানদান। বিশেষভাবে নীতিনির্ধারকরা একসঙ্গে আর্থিক ও মুদ্রা প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। অর্থের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি (জিডিপির ৩.৭%)। এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট অপরিহার্য ভোগের সামগ্রীর সংস্থানের জন্য শিল্প ও সেবা খাতের কর্মীরা যেন বেতন এবং স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো ন্যূনতম উপার্জন বা খাদ্য সরবরাহ পায়। 

চাকরি সংশ্লিষ্ট যে সব প্রণোদনা প্যাকেজ (এ পর্যন্ত ঘোষিত) ঘোষণা করা হয়েছে তার মূল মুল দিকসমূহ এখানে তুলে ধরা হলো:

# বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে শিল্প ও সেবা খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন জোগান। এ ঋণের সুদ হার হবে ৯ শতাংশ, যার অর্ধেক দেবে ঋণগ্রহীতা এবং বাকি অর্ধেক ভর্তুকি হিসেবে দেবে বাংলাদেশ সরকার।
# এমএসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন জোগান। ঋণগ্রহীতা সুদ দেবে ৪ শতাংশ , বাকি ৫ শতাংশ সরকার দেবে ভর্তুকি হিসেবে।
# কৃষি খাতে ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। 
# কৃষি পণ্যের ব্যবসার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন জোগান। শস্য ভিত্তিক শিল্প (যেমন হরটিকালচার ও পবাদিপশুপালন) এর বাইরে থাকবে। ঋণ গ্রহীতা সুদ দেবেন ৪ % এবং ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ১ শতাংশ সুদ পাবে।
# রফতানিমুখী লিল্পের কর্মীদের বেতন পরিশোধের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা জোগান। এ ঋণের সুদ হার হবে শূন্য শতাংশ। ব্যাংক একবারের জন্য ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ করতে পারে। 
# প্রবাস থেকে আসা কর্মী, বেকার যুবক-যুবতী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ২ হাজার কোটি টাকা সফট ঋণ প্রদান। গ্রামীণ অর্থায়নে যুক্ত চারটি প্রতিষ্ঠান এ ঋণ বিতরণ করবে।
# সাধারণ ছুটির কারণে চাকরি হারানোদের জন্য ৭৬০ কোটি টাকা ঋণ।
#  প্রবাস থেকে যে সব কর্মী ফিরে এসেছে তাদের ব্যবসা শুরুর জন্য ৭০০ কোটি টাকা সফট ঋণ প্রদান। 
# শহর এলাকায় খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য ২৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান।

যে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা প্যাকেজ যথেষ্ট বড় আকারের এবং অন্য কোথাও এ ধরনের নজিরও মিলবে না। তবে নীতিনির্ধারকদের অর্থনীতি দ্রুত স্বাভাবিক করা ও হারানো কর্মসংস্থান ফিরিয়ে পথ অনুসন্ধান করতে হবে। রূপালি রেখা হচ্ছে, বাংলাদেশ ম্যাক্রোইকোনমিক (ঋণ হার কম, কম বাজেট ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা, এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ভাল অবস্থানে থাকা) স্থিতিশীলতার কারণে স্বল্প মেয়াদে ঋণগ্রহণ এবং তা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যবহার করার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

ইকোনমিস্ট ইন্টালিজেন্স ইউনিটের মূল্যায়ন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। কর-জিডিপি অনুপাতের নিম্নহার (বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে) থাকার পরও এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। নেপাল (১৯%) ও ভারতের (২২ শতাংশ) মতো দেশের কর আদায় ভাল হওয়ার কারণে তাদের ব্যয়ের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি। ১৭. অগ্রাধিকারে পরিবর্তন এনে বাংলাদেশে বাজেটে ব্যয়ের কিছু খাত পুনির্বন্যাস করে কোভিড-১৯ এর পরিবর্তিত চাহিদার উপযোগী করার সুযোগ রয়েছে।

গরিবদের কাছে নগদ অর্থ তুলে দেওয়ার পাশাপাশি এ নিবন্ধে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের পুনরুদ্ধার  প্রস্তাবের ফোকাসে রয়েছে আশু কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

১. শ্রমঘন উপখাতসমূহে বাড়তি প্রণোদনা প্রদান, যা থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ ও উদ্বৃত্ত পণ্য রফতানি করতে পারে।

কৃষি : নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের শঙ্কা রয়েছে। এ বছরে তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণার শিকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২৬ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছাতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের কথা বলেছেন। এ বিষয়টি বিচেনায় রেখে প্রণোদনা প্যাকেজে দেশের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানির কথা ভাবতে পারি। এ খাতের জন্য আরও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে প্রণোদনার কথা বিবেচনা করতে হবে। ডাল, আলু, গম, ও ধান এবং এ সবের পাশাপাশি মাছ ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ নজর দিতে হবে।

সরকার ইতিমধ্যেই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ধান-চাল সংগ্রহের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের সংগ্রহ কর্মসূচি নিতে হবে। যদি মজুদ বা লজিস্টিক ব্যবস্থা সরকারের জন্য সমস্যা হয় তাহলে কৃষকরা নিজেরাই সাময়িকভাবে এ সব মজুদ করতে পাওে কিংবা বাজারেও তা বিক্রি করে দিতে পারে। বিশ্বে খাদ্য ঘাটতির প্রেক্ষাপটে বাড়তি পণ্য রফতানি করা যায়। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান নিবিড়তার (জিডিপিতে ১ শতাংশ হিস্যা বাড়লে কর্মস্থান বাড়ে ৩ শতাংশ) কারণে এর প্রভাবে স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর অপরিহার্য জীবীকার সুযোগও সৃষ্টি হবে।

বাণিজ্য, পরিবহন ও লজিস্টিক ব্যবস্থা
খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির আওতায় আগামী ৬ মাসের জন্য চালের পাশাপাশি দেশব্যাপী আরও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ কর্মসূচির সফলতার জন্য স্বচ্ছ উৎস, সরবরাহ চেইনের সুব্যবস্থা এবং অধিকতর জবাবদিহিতামূলক বণ্টন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। 

উৎপাদন, দ্রুত পণ্য সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসেবা এসব গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। শহর এলাকায় প্রতিদিনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য ই-কমার্স গতি পেয়েছে। কিন্তু গ্রামে লজিস্টিক সুবিধা বড় চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে। তবে কোভিড-১৯ এর কারণে সড়ক ও রেল পথ বিমান ও জলপথের তুলনায় কম প্রভাবিত হয়েছে। 

সড়ক পথের মূল দুশ্চিন্তা হচ্ছে চালক ও সংশ্লিষ্ট সহযোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। অবকাঠামোর নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি খাত বর্তমান পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য তারা নতুন নতুন কৌশল সামনে আনছে। 

বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দাম কমাতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের আরও করণীয় হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় লজিস্টিক কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক স¤প্রসারণের জন্য কর প্রণোদনা প্রদান এবং পরিবহন খাতের অংশীদারদের সঙ্গে অবকাঠামোর সুরক্ষা ও চালকদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য সহযোগিতা করা। ডিজেলের দাম বিশেষভাবে কমাতে হবে। এর ফলে সেচ এবং বাস-ট্রাক সেবা খাত স্বস্তি পাবে।

খাদ্য প্রক্রিয়াজাত
বাংলাদেশ যেহেতু মূল্য সংযোজনে মনোযোগী হয়েছে, সে কারণে কৃষি খাতের সুবিধা খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের ওপর পড়বে। অপেক্ষাকৃত নতুন এ খাতটির জিডিপিতে অবদান ১.৭ শতাংশ এবং মোট শ্রমশক্তির ২.২ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান করে। এ শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশ কম দক্ষ। বিশ্বে খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে আমরা খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের প্রসারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারি। বিশ্বে এ শিল্পের লেনদেন ২ লক্ষ কোটি ডলার। আমরা সময়মতো তৎপর হলে এ থেকে ভাল হিস্যা পেতে পারি। এ লক্ষ্য সামনে রেখে প্যাকেটজাত, শুষ্ক ও টিনজাত খাদ্য রফতানির জন্য বাড়তি প্রণোদনার কথা ভাবতে হবে। 

তৈরি পোশাক শিল্প : 
বাংলাদেশে জিডিপির বড় অবদান রাখা খাতগুলোর একটি হচ্ছে পোশাক শিল্প। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে নিরাপত্তা হচ্ছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ খাত যেন চিকিৎসা নিরাপত্তা সামগ্রী বাজারে নিয়ে আসতে পারে সে জন্য প্রণোদনা দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও মন্দার শঙ্কার মুখে মাস্ক, গ্লোভস ও পিপিই উৎপাদনে যেতে হবে। ভিনজ রিসার্চ-এর অনুমান, কোভিড-১৯ সময়ে পিপিই বাজার ছিল ৫৫ বিলিয়ন ডলার। আগামী ৪ বছরে এ বাজার বেড়ে ৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। এ বিষয়ে আইওএম, ইউএনডিপি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার কাছে কারিগরি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ সহায়তার অনুরোধ করা যেতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক মান ও বিধিবিধান-নিয়ম কানুন অনুসরণ সহজ হবে। দেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ লাখ পিপিই গাউন সরবরাহের অর্ডার বাস্তবায়ন করছে। এ নজির অনুসরণযোগ্য। 

১৮.অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা পণ্য
যথাযথ প্রণোদনা পেলে হাল্কা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামের ভেন্টিলেটর, এবং স্বাস্থ্যযত্ন /পরিচ্ছন্নতা পণ্য উৎপাদনে যেতে পারে।

ওষুধ শিল্প
দ্রুত বিকাশমান এ শিল্পকে অপরিহার্য ওষুধ উৎপাদন স¤প্রসারণ ও বহুমুখী করার জন্য স্বল্প ব্যয়ের মূলধন জোগান দিতে হবে। ২০১৮ সালে দেশের ওষুধ শিল্পের বাজার ছিল ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। গত পাঁচ বছরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫.৬ শতাংশ। ১৯. এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বা এসকেএফ বিশ্বে প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা রেমডেসিভির উৎপাদন শুরু করেছে, করোনা ভাইরাস চিকিৎসায় খুবই কার্যকর হিসেবে স্বীকৃত। 

বিদেশী বিনিয়োগ
বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ বা বিআইডিএ-এর জন্য ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশকে অনুসরণের উপযুক্ত সময় এখনই। বিশ্বের প্রধান প্রধান উৎপাদকরা তাদের উৎপাদন সুবিধা চীন থেকে অন্যত্র পুনর্বিন্যস্ত করছে। তাদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়ে আসার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। করোনা উত্তরকালে অনেক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে সরে যেতে সচেষ্ট। ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে এ বিনিয়োগের একটি অংশ নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশও পারে। আগামী বছর টার্গেট করে বিশেষভাবে শ্রমঘন শিল্পের দিকে নজর দিতে হবে। সরকারকে এ বছরের মধ্যে তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আগামী চার মাসের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত ব্র্যান্ড বাংলাদেশ ধারণা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে।

ওষুধ রফতানি ---  আয় মিলিয়ন ডলারে
২০১৪-১৫-- ৬৯.২৪, ২০১৫-১৬..   ৭২.৬৪,   
২০১৬-১৭.. ৮৯.১৭,   ২০১৭-১৮..  ১০৩.৪৬,  
২০১৮-১৯...   ১৩০
সূত্র : ইপিবি

স্বাস্থ্য খাতের সঙ্কটের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয় এশিয়ার সবচেয়ে কম দেশগুলোর সারিতে। করোনার প্রকোপ এ খাতের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সামনে এনেছে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ এবং অন্যান্য অগ্রণী গবেষণা সংস্থা বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ০.৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। 

স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়- তুলনামূলক চিত্র- জিডিপির শতাংশ (২০১৮)
বাংলাদেশ ০.৯%, ভারত ..১.৩%, শ্রীলঙ্কা..১.৭%, মালয়েশিয়া..২.২%, ভিয়েতনাম..২.৫%, থাইল্যান্ড..৩.৭%
# বাংলাদেশের তথ্য ২০১৯ সালের।
## ভারতের হিস্যা বেশি হবে। এখানের তথ্য কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের। রাজ্য সরকারের ব্যয় বিবেচনায় আসেনি।

নির্মাণ
কর্মে নিয়োজিত প্রতি ১৫ জনের ১ জন রয়েছে নির্মাণ শিল্পে। নির্মাণ কাজের নানা পণ্য সামগ্রী উৎপাদনে স্থানীয়ভাবে আরও অনেকের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। নির্মাণ ও নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনে দক্ষ ও দিনমজুরসহ অদক্ষ অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়। বেশিরভাগ রিইনফোর্সমেন্ট কনক্রিট ও ইস্পাত, ইট, নির্মাণ বোর্ড, দরজা, ও টাইলস স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়। বেসিন, পাইপ ও বৈদ্যুতিক ক্যাবলসহ বৈদ্যুতিক ও কাঠের সামগ্রীর প্রধান অংশও দেশে তৈরি হয়। সরকার নির্মাণ খাতকে প্রণোদনা প্যাকেজের আনার কথা ভাবতে পারে। এর ফলে স্থানীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়বে এবং দিনমজুরদেরও সুবিধা হবে। প্রণোদনা পাবার জন্য দিনমজুরদের ডিএফএস স্যালারি পেমেন্ট শর্ত হিসাবে রাখা যেতে পারে। এর ফলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ তৈরি পোষাক শিল্পে সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। 

নীতিনির্ধারকদের যে প্রধান প্রধান শিল্প খাত বিবেচনায় নিতে হবে সংখ্যাগত বিশ্লেষণ
শিল্প / কর্মসংস্থান / আয় /  অতিরিক্ত সুবিধা / কম আয়ের চাকরি / গ্রামীণ / রফতানি বান্ধব
গবাদি পুশপালন
মৎস্য
শস্য
তৈরি পোশাক শিল্প
সুরক্ষা চিকিৎসা সামগ্রী উৎপাদন
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ
নির্মাণ
খুচরা ব্যবসা 
লজিস্টিক
পরিবহন
হাল্কা প্রকৌশল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম
স্বাস্থ্যসেবা

২. সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে শ্র্রমঘন অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু করুন
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প,; ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প; কর্ণফুলী আন্ডারওয়াটার টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো ফাস্ট ট্রাকের শ্রমঘন পাবলিক অবকাঠামোর প্রকল্পসমূহের কাজ শুরুর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, যেমন এলজিআরডি এবং সড়ক ও পরিবহন খাতের বাজেট বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলোর ওপর চাপ বাড়াতে হবে যাতে সড়ক মেরামত ও সড়কের বাতি ব্যবস্থাপনার কাজসহ শহর ও গ্রামের অবকাঠামোর কাজ দ্রুত শুরু করে। 

৩. এমএসএমই-এর জন্য জরুরি অর্থায়ন
লাইটক্যাসল পার্টনারস-এর সার্ভে অনুযায়ী কোভিড-১৯ সংকটের কারণে এমএসএমই সমূহের অর্ধেকের বেশি (৫২%) বন্ধ ছিল। ২১. সার্ভতে আরও বলা হয়েছে, প্রায় ৬৪ শতাংশ এমএমএমই প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে / কিংবা পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কর্মী ছাঁটাই করবে। রক্ষণশীল হিসাবেও এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ লোক চাকরি হারাবে। 

বাংলাদেশ সরকার এমএসএমই খাতে প্রণোদনা প্যাকেজ হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। তবে অর্থ বণ্টন করা হবে ব্যাংকের মাধ্যমে। সীমিত সংখ্যক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও যুক্ত করা হবে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। অনুষ্ঠানিক খাতের এমএসএমই সমূহ ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) থেকে ঋণ গ্রহণ করে। এ ধরনের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা পুনরায় শুরুর জন্য মূলধন প্রয়োজন। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাসমূহের জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তবে জামানতবিহীন ঋণের চাহিদা আরও বেশি। পল্লী কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অংশীদারদের মাধ্যমে সরকার এমএসএমই সমূহের জন্য অতিরিক্ত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে। এর ফোকাসে থাকবে : 

-রেঁস্তোরা, স্থানীয় মুদি দোকান, স্থানীয় ফলের দোকান, ওয়েল্ডিং শপ ও কুটির শিল্পের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রতিষ্ঠান
-রিকশা চালক / সিএনজি-ইলেকট্রিক রিকশা মালিক ও পণ্য পরিবহনকারীসহ অনানুষ্ঠানিক পরিবহন খাত
-পশুপালন ও মৎস। আমরা জানি, কোরবানীর ঈদ সামনে। গবাদি পশু মোটাতাজাকরণের এটা বড় সুযোগ। স্থানীয় চাহিদা পূরণের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।

অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা পুনরায় শুরুর জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হবে তার জন্য প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও এজেন্ট ব্যাংকিং, উভয় ধরনের ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। ঋণ প্রভিশন ঝুঁকি সরকারকেও বহন করতে হবে। এর ফলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ যত দ্রুত সম্ভব তহবিল বণ্টনে উৎসাহিত হয়। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (এমআরএ) অন্তত পরবর্তী দুই বছরের জন্য সংরক্ষিত তহবিল হিসাবের বিধিবিধান শিথিল করতে হবে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো আরও নগদ অর্থ হাতে পাবে। 

৪. স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং ফিরে আসা রেমিট্যান্স কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচি
অধিক সংখ্যক স্বাস্থ্য কর্মী, নার্স, ও স্বাস্থ্য যত্ন কর্মী তৈরির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান বাজেট বাড়াতে হবে। এর দুটি উদ্দেশ্য স্থানীয় চাহিদা পূরণ এবং জনশক্তি রফতানির সুযোগ গ্রহণ। আন্তর্জাতিক সীমানা খুলে গেলে এ চাহিদা বাড়বে বলেই আশা করা যায়। (এ জন্য দু’বছরের একটি কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে)। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে বেশি বয়সী লোকের কারণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকার চাহিদা ইতিমধ্যেই উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। মহামারী থেকে বিশ্ব যত মুক্তি পেতে থাকবে, এ চাহিদা কেবল বাড়তে থাকবে। প্রবাস থেকে ফিরে আসা রেমিট্যান্স কর্মী ও বন্ধ হয়ে যাওয়া পোশাক কর্মীদের এ সব খাতে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য অগ্রাধিকার প্রদান করা যায়।

গত কয়েক মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে ৩০ হাজার কর্মী ফিরে এসেছে। আরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আগামী মাসগুলোতে ফিরতে পারে। তাদের প্রশিক্ষণ ও টেকনিক্যাল সমর্থন দেওয়া যেতে পারে। ২২. এ সব কর্মীদের পুরানো দেশের কর্মস্থলে ফিরে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। তাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে স্থানীয়ভাবে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি সময়ের দাবি।

সরকার ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসা কর্মীদের উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করেছে। ভর্তুকিযুক্ত ঋণ এবং দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ কর্মসুচি ও কারিগরি সমর্থন স্থানীয়ভাবে নতুন এমএসএমই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় সহায়ক হবে। 

তৈরি পোশাক শিল্প প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বড় উদাহরণ। সরকার আর্থিক প্রণোদনা পেতে পোশাক কর্মীদের মালিকদের জন্য শ্র্রমিকদের বেতন ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (ডিএফএস) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সার্ভে অনুযায়ী মে মাসে ৮২ শতাংশ পোশাক কর্মী ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করে বেতন পেয়েছে। এপ্রিল মাসে এ হার ছিল ২৮ শতাংশ। 

ডিএএস সুবিধা ব্যবহারের কী চমৎকার নিদর্শন!
 কোভিড-১৯ যুগে অনেক ধরনের কাজের পুনর্বিন্যাস ঘটবে। কেবল কাজের ক্ষেত্রে নয়, বিদ্যমান শ্রম সংস্কৃতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার জন্য প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। 
প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে শর্ত হিসেবে রাখার জন্য সরকারকে চেষ্টা চালাতে হবে। এর ফলে তহবিলের যথাযথ বণ্টনও নিশ্চিত হবে। 

৪.‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ উদ্যোগকে এলাকাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ফাস্ট ট্র্যাকে অন্তর্ভুক্ত করা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সতর্কতামূলক জীবনধারার নতুন যুগে আমাদের যেতে হচ্ছে। এর ফলে অনেক ধরনের সেবা বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় উদ্যোগ বাড়ানোর বিপুল সুযোগও কিন্তু সামনে এসেছে। বিকেন্দ্রীকরণ এজেন্ডা অগ্রসর করে নেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজের অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। অনলাইন ও ডিজিটাল খাত অগ্রাধিকার পাবে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। সেবা খাত ডিজিটালাইজ করার এ এক বড় সুযোগ। এর পরে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং বিভিন্ন খাত থেকে রাজস্ব আয় বেশি হবে। 

এর অংশ হিসেবে কৃষির যন্ত্রায়ণ কার্যকরভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। অঞ্চলভিত্তিক অর্থনীতিতে এর বহুমুখী প্রভাব পড়বে। প্রণোদনা বরাদ্দ থেকে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো (যেমন ফসল কাটার যন্ত্র) ও অন্যান্য কারিগরি সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। বছরব্যাপী নগদ সহায়তাও প্রদান করা সম্ভব।

চুয়াডাঙ্গা জেলার দোয়াপাড়া গ্রাম ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ উদ্যোগের সুবিধা ভোগের উজ্জ্বল উদাহরণ। ২৩. সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন ও অধিবাসীরা দোয়াপাড়ায় দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পেরেছে। শঙ্কর চন্দ্র ইউনিয়নের সচিব ফজলুর রহমান জানান, দোয়াপাড়া বাংলাদেশের আর সব দরিদ্র ইউনিয়নের মতোই। পানির সুব্যবস্থা নেই। যোগাযোগ নেটওয়ার্ক দুর্বল। সরকারি পরিষেবা অপ্রতুল। কিন্তু এখন পরিস্থিতির উলে­খযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। রাস্তার ল্যাম্প পোস্টে রাতে বিদ্যুতের বাতি জ্বলে। এর ফলে চলাচল সহজ হয়েছে।

নিরাপত্তা বেড়েছে। ছাত্রছাত্রীদের বাইসাইকেল দেওয়া হয়েছে। এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারা সহজে ও নিরাপদে দূরের স্কুলে যেতে পারছে। ‘বেলা শেষে’ নামে বিনোদন কেন্দ্র চালু হয়েছে। গ্রামের কর্মজীবীরা সেখানে দিনের শেষে সমবেত হতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচির আওতায় গ্রামে ফ্রি ওয়াই-ফাই সেবা চালু হয়েছে। গ্রামবাসীদের জন্য রয়েছে সুপেয় পানি ও গ্রন্থাগার সুবিধা। দোয়াপাড়া এখন কেবল বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেনি, অনেক উদ্যোক্তা তৈরি করেছে। গ্রামে বসবাস করেই বাসিন্দারা ভোগ করছে শহরের সুবিধা।

উপসংহার
পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার মূল বিষয় হতে হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি।  চাকুরিবিহীন প্রবৃদ্ধি গত দশকের অর্জনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। তদুপরি, যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল আমরা ভোঁগ করছি তা ডেমোগ্রাফিক বোঝায় পরিণত হতে পারে। বৈষম্যের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক দূরত্ব যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ, নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই তরুণ, কম দক্ষ ও সীমিত সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকা জনগোষ্ঠীকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।

ভিয়েতনাম ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশ ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা ‘ভি’ ধরনের পুনরুদ্ধারে এখনই যেতে চায় না। তাদের নীতিনির্ধারকরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আমরা বাংলাদেশের জন্য একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ প্রয়োজন বলে মনে করি। আমরা আরও প্রণোদনা প্যাকেজের জন্যও কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট সকলকে সে সব অবহিত করা হবে।   
            
 এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি