ঢাকা, বুধবার   ১৫ অক্টোবর ২০২৫

দুই মুসলিম দেশের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের নেপথ্যে

কেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এই সংঘাত?

বর্তমানে খাইবার পাখতুন ও বেলুচকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র TTP নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়,  TTP আদর্শগতভাবে আফগান তালেবানের “ভ্রাত্রি প্রতীম সংগঠন” — তারা দুই দলই দারুল উলুম দেওবন্দ এর মতাদর্শে বিশ্বাসী।

জাহিদ আল আসাদ

প্রকাশিত : ২২:৩২, ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ২৩:১১, ১৪ অক্টোবর ২০২৫

কেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এই সংঘাত?

কেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এই সংঘাত?

Ekushey Television Ltd.

নিকট অতীতের বছরগুলোর মধ্যে এবার ভয়াবহ সীমান্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী। আফগান বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ৫৮ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছেন দাবি তালেবানের। পাল্টা হামলায় তালেবান এবং এর সঙ্গে যুক্ত ২০০  জন নিহত হওয়ার দাবি পাকিস্তানের। যদিও এই মুহূর্তে এই সংঘাত আপাতত বন্ধ আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুই মুসলিম দেশ কেন নিজেদের মাঝে এই ভ্রাত্রিঘাতী সংঘাতে জড়াচ্ছে। এই বিষয়টা খোলাশা করার চেষ্টা করব।

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই বিবাদপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনর সময় জাতিসংঘে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার মাধ্যমে এই বিবাদ শুরু হয়ে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়ন চলছে এখনো। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ নির্ধারিত পাক-আফগান বিভক্তিকারি ‘ডুরান্ড লাইন’কে সবসময় অবৈধ বলে বিবেচনা করেছে আফগানিস্তান। আফগান বিরোধের মূল কারন ছিলো পাকিস্তানে খাইবার পাখতুনখোয়া আর বেলুচিস্তান রাজ্যে পশতুন জাতির অবস্থান ও তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম। আফগানিস্তানের প্রধান জনগোষ্ঠী হলো পশতুন (Pashtun) জাতি। আবার পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের অনেকাংশ ও বেলুচিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে পশতুন জনগণ বসবাস করে। তাদের অনেকে স্বাধীনিতা চায় আর এতে আফগানিস্তানের সমর্থন আছে বলে ধারণা করা হয়। তবে এটা ছিলো তাদের মধ্যে বিবাদের ঐতিহাসিক ভিত্তি।

বর্তমানে খাইবার পশতুন ও বেলুচকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র TTP (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়,  TTP আদর্শগতভাবে আফগান তালেবানের “ভ্রাত্রি প্রতীম সংগঠন” — তারা দুই দলই দারুল উলুম দেওবন্দ এর মতাদর্শে বিশ্বাসী

তবে সংঘাতের ইতিহাস থাকলেও আফগানিস্তানে ১৯৯৬ সালের তালেবান সরকারকে (১৯৯৬-২০০১) স্বীকৃতি দেওয়া মাত্র তিনটি দেশের একটি ছিল পাকিস্তান। ইসলামাবাদ দাবি করে, পরবর্তী সময়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ও তারা তালেবানকে সহযোগিতা করেছে। যা অনেকাংশে সত্যি হলেও এর বিপরীত অভিযোগও পাওয়া যায়।

পরবর্তীতে ২০২১ সালে বর্তমান তালেবান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের আশা করা হয়। সেই অনুসারে সমঝোতার পথ খুললেও ২০২২ সালে ইমরান খান সরকারের পতনের পর উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ইসলামাবাদ বলে, পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে তালেবান সরকার। তবে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে ইসলামি আমিরাত আফগানিস্তান।

মূলত খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশের জনজাতির সাথে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সম্প্রৃক্ততার ফলে এই সংঘাত জটিল আকার ধারণ করেছে। একইসাথে ভারতের দেওবন্দ ধারার সাথে আফগান তালেবানের গভীর সম্পর্ক এবং ভারতের বর্তমান সরকারের সাথে তালেবান সরকারের সাম্প্রতিক সখ্যতা পাকিস্তানের তরফে শত্রুভাব বৃদ্ধি করেছে।

বিপরীতে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটির প্রতি মার্কিন লোভ এবং ট্রাম্পের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সরকারের সখ্য তালেবানকে পাকিস্তানের প্রতি বিরাগভাজন করেছে। যদিও সপ্তাহ দুয়েক আগে ‘মস্কো ফরম্যাট কনসালটেশন’ এর বৈঠকে চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ বাকি দেশগুলো আফগানিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। এখানে পাকিস্তানের একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের প্রতি দ্বৈত অবস্থানের ফলে পাকিস্তানের সাথে তালেবানের অবিশ্বাসের সম্পর্কের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এছাড়া সম্প্রতি পাক বিমান বাহিনী আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে গিয়ে টিটিপির নেতা নূর ওয়ালি এর উপর বিমান হামলা করেছে। এরপর দুই দেশের সেনাদের সংঘাতে প্রায় ৩০০ প্রাণহানি হওয়ার এই সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক অতীতে পারস্পরিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়েছে পাকিস্তান ও তালেবান। কিন্তু ইসলামাবাদ যখন থেকে তালেবানের বিরুদ্ধে টিটিপির নেতাদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে, তখন থেকেই সম্পর্ক বৈরী হয়েছে। ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্রের (সিআরএএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে টিটিপির হামলায় পাকিস্তানে অন্তত ২৫০০ জন নিহত হয়েছেন। গত বছরও পাকিস্তানে প্রায় ২৬০০ নিহত হয়।

এইসশস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে মূলত ২০২২ সাল থেকে। ওই বছর ক্ষমতাচ্যুত হন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ক্ষমতায় থাকাকালে ইমরান খান তালেবানের মধ্যস্থতায় টিটিপিকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছিলেন। ইমরান খানের উপজাতীয় এই গোষ্ঠির প্রতি ইতিবাচক মনোভব ছিল। বিপরীতে বর্তমান পাকিস্তান সরকার ও সেনা নেতৃত্ব টিপিপির প্রতি অভিযোগ করেছে, টিপিপি পাকিস্তানে খাইবার পখতুন অঞ্চলকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে চায়।

এদিকে আগুনে ঘি ঢালার মতো তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি বর্তমানে ভারত সফর করছেন। তার এই সফরে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ সফর করছেন। ভারতের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের অভিযোগ দিল্লি ভারতের দেওবন্দ ধারার আলেমদের ব্যবহার করে তালেবান সরকারকে নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে।

এক দশক আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের এই সংক্রান্ত এক বক্তব্য নতুন করে আলোচনায় এসেছে। তিনি বলেছিলেন, দেওবন্দ যেভাবে বলবে, তালেবান সেভাবেই শুনবে।

জানা যায়, দেওবন্দ এর পাকিস্তানি ধারা দারুল উলুম হাক্কানিয়াতে তালেবান নেতাদের অনেকে পড়াশোনা করেছেন। তাই তাদের সাথে দেওবন্দের অনেক গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

সার্বিক বিশ্লেষনে দেখা যায়, পাক-আফগান সম্পর্কের সহসা কোনো উন্নয়নের সম্ভাবনা নেই। তবে চীনের মধ্যস্ততায় হয়তো এই দুই মুসলিম দেশ নিজেদের মধ্যে তিক্ততার লাগাম টেনে ধরবে। এভাবেই হয়তো দুই মুসলিম প্রতিবেশীর মাঝে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই বন্ধ হবে।

লেখকঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও শিক্ষক।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি