ঢাকা, শনিবার   ০৫ জুলাই ২০২৫

গীবতঃ অশান্তির বিষবৃক্ষ

প্রকাশিত : ১৮:৪৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

গীবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) হলো কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সর্ম্পকে এমন দোষ-ত্রুটি বলা যা ঐ ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে। গীবত হলো অন্যকে তার অসাক্ষাতে ছোট করা, তার সম্মানকে খাটো করা বা তার সম্পাদিত কর্মকে বা জীবনের পরিশ্রমলব্ধ অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার গোপন প্রচেষ্টা। এটি সংর্কীণ মানসিকতা, ভীরুতা, কাপুরুষতার ফলিত রূপ।

গীবত হলো প্রচন্ড নেতিবাচকতা। আমাদের সমাজে গীবত এত বেশী প্রচলিত হয়ে গেছে যে, এখন এটিকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ধরে নেয়। কেউ দোষনীয় মনে করে না। অনেকে এই বলে মনকে প্রবোধ দেয় যে, আমি তো কারো দোষ বানিয়ে বলছি না, যা দোষ আছে তাই বলছি। কারো মধ্যে যদি দোষ থেকেও থাকে তবে তা তার অনুপস্থিতিতে বলাই গীবত।

মানুষের যে কোন দোষ-ত্রুটি নিয়ে গীবত হতে পারে। দোষ গুণের সমন্বয়েই মানুষ। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না যার শুধু গুণ আছে, দোষ নেই। আবার এমন মানুষও জন্মায়নি যার শুধু দোষ আছে, কোন গুণ নেই। স্রষ্টা প্রতিটি মানুষকে দোষ-গুণের সমন্বয়ে বৈচিত্র দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মেধা, গুণ ও শৃজনশীলতাকে সৃষ্টিকর্তা জন্মস্থান, বংশমর্যাদা, দৈহিক সৌন্দর্য, আর্থিক সামর্থ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে বন্টন করেছেন। যারা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তারা মানুষের গুণের দিকে তাকান আর যারা নেতিবাচক তারা দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করেন।

একজনের গুণ যখন অন্য আরো দশজনের গুণ বা প্রতিভার সঙ্গে সমন্বিত হয় তখনি প্রকৃতি দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টিশিলতায় ধন্য হয়। যারা সব মানুষের মধ্যে একই ধরণের সাদৃস্যতা দেখতে চায় তারা আসলে প্রকৃতির ভাষা বুঝতে ব্যর্থ। কেননা প্রকৃতি বৈচিত্র পছন্দ করে। তাই যারা অন্যের ছিদ্র খুঁজে বেড়ায় তাদের দৃষ্টি একপেশে, সংকীর্ণ ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ। অথচ বাস্তবতা হলো অধিকাংশ মানুষই প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করে আনন্দ পায়। গীবত বা পরনিন্দা প্রকৃতির নেপথ্য স্পন্দনের সাথে বেমানান একটি কাজ।

মানুষ তার অজ্ঞাতসারে কারণে অকারণে গীবতে লিপ্ত হয়। গীবত হতে পারে মানুষের শারীরিক ত্রুটি-বিচ্যুতি, বংশধারা, আচার-আচরণ, আত্মীয়-স্বজন, পারস্পরিক সর্ম্পক, আপ্যায়ন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, ইবাদত, পেশাগত ইত্যাদি। ইদানীং ফেসবুকেও গীবত ও পরচর্চা বেশী পরিলক্ষিত হয়।

আমরা অনেক সময় সরাসরি গীবত বা পরনিন্দা করি না। অন্যরা যখন গীবত করে তখন নীরব শ্রোতা হয়ে শুনি। আর শোনার পর এ যুক্তি দেখাই যে, আমরা তো গীবত করিনি, অন্যরা যা বলছিল তা শুনেছি মাত্র। আসলে গীবত এমন এক অপরাধ যা শ্রোতা ছাড়া সংগঠিত হতে পারে না। কেউ যখন অন্য কারো নিন্দা শোনে তখন সে এ নিন্দাকর্মের অংশ হয়ে যায়। তাই গীবত করা ও শোনা সমান অপরাধ। অথচ আমাদের সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা আজ মহামারীতে রূপ নিয়েছে । ফলে পরিবার ও সমাজে অশান্তি, বৈরিতা, হিংসা, হানাহানি লেগেই আছে।

পবিত্র কুরআনে গীবত সর্ম্পকে বলা হয়েছে, ‘‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অন্যের ব্যাপারে আন্দাজ-অনুমান করা থেকে বিরত থাক। আন্দাজ-অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে গুনাহের কাজ। অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরী করো না। তোমরা কি মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে চাও? না, তোমরা তো তা ঘৃণা করো। (গীবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া সমান)। তোমরা সবসময় আল্লাহ সচেতন থাকো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরমদয়ালু’’।

হাদীস শরীফে গীবতকে ব্যাভিচারের চেয়েও জঘন্য অপরাধ বলা হয়েছে। কারণ ব্যাভিচারকারী অপরাধ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন কিন্তু গীবতের গুনাহ ততক্ষণ পর্যন্ত মাফ হবে না যতক্ষণ না গীবত দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মাফ না করেন।

একবার হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে বললেন যে, হযরত সাফিয়া বেঁটে। রাসুল (সঃ) বললেন, ‘‘আয়েশা তুমি এমন নোংরা কথা মুখ দিয়ে বের করেছো যা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে গোটা সমুদ্রই নোংরা হয়ে যেতো’’ (মিশকাত)।

একজন বেঁটে মহিলাকে শুধু খর্বাকৃতি বলার কারণে যদি মারাত্মক অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে মানুষের চারিত্রিক ও আচরণগত ত্রুটির কথা প্রচার করে বেড়ালে কী অপরিমেয় গুনাহ বা অপরাধ তা সহজেই অনুমান করা যায়।

অপর এক হাদীসে রাসুল (সঃ) বলেন, ‘‘যে বান্দাহ অন্য বান্দার দোষ-ত্রুটি এ দুনিয়ায় গোপন রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন’’ (মুসলিম)।

গীবতকারী আল্লাহর অভিশপ্ত, রাসুল (সঃ) সাথে সর্ম্পক ছিন্নকারী, গীবতকারী সত্যিকার মুসলমান নন, গীবত মুসলমানের পারস্পরিক অধিকার লঙ্ঘন করে, গীবত ব্যক্তিগত সম্মান ভুলুন্ঠিত করে, গীবত কবরে আযাব বৃদ্ধি করে, গীবতকারী পরকালে (তার পূণ্যের অংশ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে পরিশোধ করে) দেউলিয়া হয়ে যাবে, গীবত মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করে, গীবত মেধা ও সৃজনশীলতা বিনষ্ট করে, সর্বোপরি ঈমান ধংস করে।

গীবত থেকে মুক্ত হতে হলে মানুষকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা ও ভলোবাসতে হবে, অন্তরের অহম দূর, মন থেকে রাগ, ক্ষোভ, হীনমন্যতা দূর, অন্যকে ক্ষমা করা, সু-ধারণা পোষণ, নিজের দোষ অনুসন্ধান ও আত্মপর্যালোচনা, সর্বাবস্থায় শুকরিয়া, অন্যের কল্যাণ কামনা, কথাবার্তায় সংযমী এবং সৎসঙ্গে চলতে হবে।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি