জিয়াউর রহমানের দূরদর্শীতায় বদলে যায় বাংলাদেশের গতিপথ
প্রকাশিত : ২২:৩০, ১১ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ২২:৫৩, ১১ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এই ৫৪ বছরের মধ্যে মাত্র ৪ বছর, ৩৯ দিন একজন মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। তারই কণ্ঠে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিল বাংলাদেশের মানুষ।
মুক্তিযোদ্ধা সমর নায়ক থেকে ইতিহাসের বাঁক ঘুরে এসে ১৯৭৭ সালে দেশের প্রেসিডেন্ট হন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের বয়েস তখন মাত্র ৬ বছর। তখন দেশ পরিচালনায় এসে জেনারেল জিয়াউর রহমান কিছু গ্রাউন্ড ব্রেকিং ও ভিশনারি পদক্ষেপ নেন। যা আজও বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নানা ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের ভূমিকা পালন করছে।
বিশেষ করে অর্থনীতি, জনমিতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, জনশক্তি, প্রশাসনিক এবং কৃষি ও পরিবেশের ক্ষেত্রে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী কার্যকলাপের সুফল এখনও বাংলাদেশ ভোগ করছে।
তিনি মাত্র চার বছরের শাসনকালে লাভ করেছিলেন আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা ও আসমুদ্র হিমাচল ভালোবাসা। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতিতে মৌলিক বাঁক বদল ঘটেছে বলে জানা যায়।
এসব ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায়--- জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হবার পরে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। এছাড়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশিদের স্বতন্ত্র পরিচয় লাভের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেন তিনি।
একইভাবে পাহাড়ে বসবাসরত অবাঙালি জনগোষ্ঠী ও বাঙালি উভয়কে একই ছাতার নিচে নিয়ে এসে জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেছেন জিয়াউর রহমান।
পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে এতদিনের একমুখি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বলয় থেকে বের করে বিশ্বায়নের ধারা চালু করেন। বৈশ্বিক বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমেরিকা, চীনের এবং সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করেন।
এছাড়া জিয়াউর রহমানের সময় মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। তিনি তাঁর স্বল্প সময়ের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে ইরাক-ইরান যুদ্ধে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। আল কুদস কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া, ফিলিস্তিন জনগণের প্রতি অবিচল সমর্থন, ওআইসিকে একটি কার্যকরি সংগঠনে পরিনত করার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার ভুমিকা মুসলিম বিশ্ব আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
এছাড়া তিনিই মূলত মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সেখানে বাংলাদেশি শ্রমবাজার সৃষ্টি করে সরকারিভাবে কর্মী প্রেরণ করেন। বায়রা সূত্রে জানা যায়, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর মধপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির ঐতিহাসিক সূচনা করেন।
এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জোট সার্ক গঠনের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। একইসাথে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়।
আমেরিকার পাবলিক ইউনির্ভাসিটি সিস্টেমসের অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, জিয়াউর রহমান সরাসরি ভারত-বিরোধী ভূমিকায় যাননি। তবে তিনি কৌশলে দেশের স্বার্থ রক্ষা করেন। যেমন তার প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি হয়েছিল।
অন্যদিকে, জিয়াউর রহমানের শাসনামলের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ১৯ দফা কর্মসূচী। এই কর্মসূচির মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার অন্যতম অবদান ছিলো খাল খনন কর্মসূচি। যার অর্থনৈতিক সুফল জনসাধারণ পেয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ সালে খাদ্য শস্য রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদিত হয়। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। তাঁর আমলে প্রায় দেড় হাজারের বেশি খাল খনন করা হয়েছিল যার দৈর্ঘ্য ছিলো আনুমানিক ৯০০ মাইল। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাল খননের ধারা অব্যাহত থাকলে পরবর্তীতে বাংলাদেশকে এতো বন্যা দেখতে হতো না। প্রশাসন ব্যবস্থায় জিয়াউর রহমান দূরদর্শী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সরকারের সচিবালয়ের বিভিন্ন উচ্চপদে পদায়নে বৈষম্য নিরসনসহ বেশকিছু লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালে সিনিয়র সার্ভিস পুল (SSP) চালু করেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। জনমুখী, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ প্রশাসন কাঠামো গড়ে তুলতে তিনি SSP-র মাধ্যমে উন্মুক্ত পরীক্ষার ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে হতে উপসচিব থেকে সচিব নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদ সরকার SSP-র কার্যক্রম বাতিল করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে জনপ্রশাসনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত হয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, জিয়ার হাতধরেই গড়ে উঠা সেদিনের শিশু গার্মেন্ট শিল্প আজ দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত। সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই সরকারি টিসিবির সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে সর্বপ্রথম ৪ লক্ষ টাকা মূল্যের পুরুষদের শার্ট ফ্রান্সে রপ্তানী করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ১৯৭৭-৭৮ সালে এদেশে ৯টি রপ্তানিমূখী পোষাক কারখানা গড়ে উঠে। এভাবে সরকারি বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প এই ২০২৫ সালে এসেও আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগের যোগান দিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষায় জিয়াউর রহমানের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের যুদ্ধ ক্ষেত্রের মধ্যে ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ফলে সেখানকার ইতিহাস, ভূগোল, জনমানস এবং সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলের অস্থিরতা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। স্পষ্ট ধারণা থাকার কারণেই প্রেসিডেন্ট জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন, পাহাড়ের সংকট সমাধান করতে হলে কী কী করতে হবে। তিনি ঘন ঘন পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে একদিকে সেখানকার সামাজিক ও গোষ্ঠি নেতাদের সাথে ধারাবাহিক মিটিং করে স্থানীয় মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন।
সাধারণ মানুষের উন্নয়নে গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, তাদের কৃষ্টি-কালচার রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট। এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতি কোটা প্রদান করা হয়। তিনি সমতল থেকে নদী ভাঙ্গা বেশকিছু পরিবারকে পাহাড়ে পুনর্বাসন করেন। যারা একদিকে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অনাবাদী ভূমিকে চাষের আওতায় আনে, অন্যদিকে দেশের অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠে। পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে ঢেলে সাজান তিনি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন পেট্রো বাংলা একটি শক্তিশালী সংস্থায় পরিণত হয় এবং তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন করে মনোযোগ দেয়। ১৯৭৯ সালে, জিয়াউর রহমান বাপেক্স প্রতিষ্ঠা করেন, যা পেট্রো বাংলার একটি সহযোগী সংস্থা এবং দেশের অভ্যন্তরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করে।
১৯৭৮ সালে সিলেটের কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ পুর্ব ইউনিয়ন বড়চাতল গ্রামে তেল কুপ খননের উদ্যোগ গ্রহণ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
দীর্ঘ চার বছরের প্রচেষ্টায় জাপানের একটা কোম্পানি তেল উত্তোলনের কাজ প্রায় সম্পন্ন করে। ১৯৮১ সালের যেদিন জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণ করেন, ঠিক তার পরদিন এই কূপ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কথা ছিলো।
এভাবে মাত্র চার বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার ছোট্ট সময়ে জিয়াউর রহমান অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার অনেক কার্যক্রম বিএনপি সরকারই যথাযথভাবে চালিয়ে নিয়ে যায়নি বলে অভিযোগ আছে। সামনের নির্বাচনকে ঘিরে সচেতন জনগণ আবারও নব উদ্যমে নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলোর প্রতি নজর দিচ্ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির প্রতি অনেক ভোটার আশা করছেন, তারা যেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে এগিয়ে নেয়।
এএইচ
আরও পড়ুন