ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ ১০০ বছরে পড়ল

শামীম আজাদ

প্রকাশিত : ২১:৪৫, ১ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২১:৪৮, ১ জুলাই ২০২০

শামীম আজাদ বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ কবি ও সাহিত্যিক। তিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লন্ডন শাখার চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উপন্যাস, কবিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর তার ৩৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ দেশ বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিচিত্র পুরষ্কার ছাড়াও তিনি আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমি শুনেছি ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমন ছিল। তখন কিভাবে আমাদের বাংলা বিভাগের শুরু হয়। সে সময় তা ছিল ‘সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ’। প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহই বাংলা অনার্স শ্রেণির পাঠক্রম করেন। ১৯৩৭ সালে সংস্কৃত বিভাগ ও বাংলা বিভাগ আলাদা হয়ে যায় আর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হন বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ। সে সময় যে মনীষী, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও গবেষকগণ বাংলা বিভাগ আলো করেছিলেন তাঁরা হলেন- মোহিতলাল মজুমদার, ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ডক্টর মনোমোহন ঘোষ, কবি জসীমউদ্‌দীন, মুহম্মদ আবদুল হাই প্রমুখ। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে এবং তার পরে নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমাদের বাংলা বিভাগ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

আর আমরা তার গল্প শুনতে পেয়েছি বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডক্টর আহমদ শরীফ, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, নীলিমা ইব্রাহীম, আনোয়ার পাশা এঁদের কাছ থেকে। শুনেছি আমাদের সময়ের কলাভবনের আমাদের এই বিদ্যাদেবগলণের কাছ থেকে, একেবারে সামনে বসে। কখনো বিশাল ২০১৭ নম্বর কক্ষে, কখনো শীতের রোদে হেলান দিয়ে বাংলা বিভাগের করিডোরে, কখনো আসন্ন উৎসবের জন্য ডি এল রায়, রবীন্দ্রনাথ কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের গানের মহড়া দিতে দিতে অধ্যাপক আব্দুল হাই স্মৃতি পাঠকক্ষে মেঝেতে বসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁরাই প্রাচ্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় করে তুলেছিলেন। কিন্তু সেই অসামান্য শিক্ষাগুরুদের জ্ঞান কলস আমাদের হতভাগ্য মাথায় উপুর হবার আগেই তাঁদের ক’জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা। হত্যা করে ঠিক বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রাক্কালে। আজ আমার বার বার সেই স্যারদের কথা স্মরণ হচ্ছে।

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রায়ই পরতেন ঘি রঙা খদ্দর বা দেশী সুতির লম্বা পাঞ্জাবি। তাঁর পা’জামা হতো সাদা ও ঘেরওলা। স্যার সাইকেল চালিয়ে আসতেন। শরৎচন্দ্র পড়াবার সময় তিনি শ্রীকান্ত হয়ে গেলে পুরো কক্ষে এমন এক নাটকীয়তা এসে যেত যে আমরা নিশ্চল হয়ে যেতাম। মোটা ফ্রেমের চশমাটা ক্রমশ নুয়ে পড়তো। তাঁর চশমার ভেতরে ছিল বিদ্ধ হবার মত দৃষ্টি। তাঁর অবিস্মরণীয় বাচন ও পড়ানোর রীতিতে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্য যাই পড়িয়েছেন তাঁর জন্য রেজিস্টার ব্যবহার করতে হয়নি কখনো। থাকলেও কোনদিন নাম ডাকার দরকার হয়নি।

ভর্তি পরীক্ষার ভাইবায়, আমি সিলেটের মেয়ে জেনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলতো কোন বাঙ্গালি মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল সিলেটে? সেই প্রথম শুনেছিলাম তাঁর ফ্যাঁসফ্যাঁসে অসাধারণ কণ্ঠস্বর। থমকে গিয়েছিলাম আমি। তখন নিজেই সূত্র ধরিয়ে বলেছিলেন তাঁর ডাক নাম দিয়ে তোমাদের সিলেটে কত গান হয়েছে। মুহূর্তে অবনত মুখ তুলে বলেছিলাম- শ্রী চৈতন্য দেব। এবার ডাক নাম বলো? নিমাই চাঁন।

একবার আমাদের বিভাগ থেকে স্যারের ‘চিঠি’ নাটক হচ্ছে। অভিনয় করছেন রেখে আপা, কামাল ভাই আরও কে কে যেন। সারাদিন টিএসসিতে চা শিঙ্গারা ও মহড়া চলছে। প্রথম বর্ষের ক’জন স্বেচ্ছাসেবী হয়েছি। আমি, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর,‌ আলী ইমা‌ম, শেলী মির্জা, বাবলী হক, মহসীন রেজা। নীলিমা ইব্রাহীম আপা এসে ঘুরে গেলেন। মুনীর স্যার আর আকরম স্যার আছেন সারাদিন। উত্তেজনায় আমি একদম নার্ভাস। তাদের সামনে দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে গেলেও কেঁপে উঠি। সন্ধ্যা হতেই জমে উঠলো তারার মেলা। সামনে পাদপ্রদীপের নিচে নাটকের তারকারা আর আমাদের জীবনের জলজলে তারারা সব অডিটরিয়ামের পেছনে। আমাদের সঙ্গেই বসেছেন। মুনীর স্যার বললেন, এখান থেকে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখো।

শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী পড়াতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। শান্তি নিকেতনের প্রথম শ্রেণি পাওয়া ছাত্র- এত মেধাবী, এত গুণের আকর, এত এক বিশ্বকোষ। শান্তিনিকেতনে তাঁকে বলা হতো ‘মুখোজ্জ্বল চৌধুরী’। যে কোন বেলায় দেখলেই মনে হতো যেন সদ্য শীতল জলে স্নান করে এসেছেন। তিনি পরতেন পাজামা পাঞ্জাবিও কালো ওয়েস্ট কোট। পায়ে বেল্ট দিয়ে আটকানো স্যান্ডেল। কথা বলতেন এতো নরম করে যেন বাতসের গায়ে আঁক বসে যাবে।

স্যার ‘সবলা’ পড়তে ও পড়াতে পড়াতে গল্প করতেন শান্তি নিকেতনের মেয়েদের কথা। যেখানে ইন্দিরা গান্ধীও একজন সাধারণ মেয়ের মত খালি পায়ে এক বাক্স কাপড় চোপড়ে দীক্ষা নিয়েছেন। ছাতিমতলার গাছের ছায়ায় সঙ্গীতের মায়ায় নিজেকেও করে তুলেছিলেন তেমনি সাদাসিধে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রিয়দর্শিনী’।


ছবিতে আমার বিদ্যাদেবগণ: শহীদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা ও রাশিদুল হাসান

‘বলাকা’ পড়াতে পড়াতে স্যার যখন বলতেন, সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের শ্রোতখানি বাঁকা/ আঁধারে মলিন হল যেন খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার। আর বাণী ভেঙে কবিতার বল বের করে আনতেন, আমার মনে হত কপ করে ধূসর ধাতবের খোপে সাঁই করে সেঁটে গেল রূপালী পারদ। চোখ ও মগজ আটকে যেত স্যারদের কথায়। ক্লাসের সময় কখন দুম করে শেষ হয়ে যেতো!

শান্তি নিকেতনের একেকটি বাড়ির কবিতার মত নাম শুনে অবাক হয়ে যেতাম। শুদ্ধ উচ্চারণে কবিতা পাঠ করতে না পারলেও, প্রশ্নের উত্তর সঠিক না দিলেও বকাটা দিতেন নরম করেই। আমরা বলতাম শান্তি নিকেতন তাঁর মাথায় একটি ফ্রিজ বসিয়ে দিয়েছে। আমার সন্দেহ হয় স্যার জীবনে কাউকে হাল্কা চড়চাপড়ও দিয়েছেন কি!

একাত্তর সালের প্রথম দিকে। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। করিডোরে করিডোরে আমাদের তখন কী স্লোগান! একদিন আমি তাঁর কক্ষের সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি থামলাম। তিনি হালকা করে পিঠে হাত ছোঁয়ালেন। মৃদুহাস্যে বললেন, তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসবো।

সেদিন বিকেলে আমি আর আব্বা সোবহান বাগ কলোনীর দোতলার ব্যালকনিতে অপেক্ষা করছি। স্যার তার ছোট্ট গাড়িটি ফ্ল্যাটের সামনে পার্ক করতেই পাশের দরজা খুলে বেরিয়ে দাঁড়ালেন মনসুর মুসা স্যার। মুসা স্যারের কোমরে লেদার বেল্ট ও জিন্স ট্রাউজার পরা। ওঁরা দু’জন এসেছেন? আমি তো উত্তেজনায় বাঁচি না।

আম্মা খয়েরী করে ঘিয়ে ভেজে সুজির মোহন ভোগ করেছেন। চা’র কাপ নামিয়ে বৈঠক খানায় তাঁদের কথপোকথনে কান পেতে অবাক হয়ে যাই। স্যার তাঁর প্রিয় ছাত্রীটির জন্য সে সময়ের উজ্জ্বলতম মেধাবী ও সর্বদা সত্যভাষী এক তরুণ শিক্ষকের জন্য বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন! ততক্ষণে আম্মাও সে ঘরে প্রবেশ করেছেন। প্যাসেজ থেকে তাঁদের মিলিত হাস্য কথন শুনে মনে হল যেন মা-বাবার বন্ধুরা এসেছেন। ওঁরা চলে গেলে দেখলাম আব্বা মহা আহল্লাদিত! তাঁর কন্যার কারণে এমন সব নমস্য মানুষদের আগমন ঘটেছে আমাদেরই ঘরে!

শহীদ আনোয়ার পাশা স্যার পড়াতেন রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। দ্রুত কথা বলতেন তিনি। রেজিস্টার শেষ করেই অল্প সময়েই কাদম্বিনী, চারুলতা, নরেশ, ভূপতি, রতন সবাইকে এনে ক্লাসরুমে দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারঙ্গম ছিলেন। স্যারের নিজের গদ্যের হাত ছিল শক্তিজলে ধোয়া। ছোটগল্পই একা শিল্পকর্ম হিসেবে যে একটা মহা কারুকার্যময় ব্যাপার, ঐ ব্যাপারের আগে যে শ্যাপারগুলোও পড়তে হয়, আর তার জন্যে যে পাবলিক লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির সামনে স্যান্ডেল ক্ষয় করতে হয়, স্যারের ক্লাসেই তা প্রথম মনে হল।

লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত উপন্যাস - ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’। স্যার কি তবে এক সন্ত পুরুষ ছিলেন, যিনি ভবিষ্যত দেখতে পারতেন? কিন্তু নিজের নির্মম ভবিষ্যত তো দেখতে পাননি এ ভবিষ্যতদ্রষ্টা? ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে নিজের ভবিষ্যতকে সুরক্ষা করতে ভেবেছিলেন, মুসলমানদের পাকিস্তানই অভীষ্ট। ভারত থেকে তাই শরণার্থী হিসেবে এদেশে এসেছিলেন স্যার। যে দেশকে নিরাপদ ভেবেছিলেন, সেখানেই তাঁকে প্রাণ দিতে হল একাত্তরে!

নাতিদীর্ঘ মানুষ ছিলেন স্যার। বুকের কাছে ধরা ছোট গল্পের মহামোটা এক ডিক্সোনারি মার্কা বইটিকে মনে হত যেন তাঁর দেহের অংশ। যেন তাঁকে ছাড়েনি কখনো। ছাড়েনা কিছুতেই। হাঁটতেন ক্ষিপ্র পায়ে। কথা বলতেন দ্রুত। করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলে ‘পিছু নিচ্ছি নেবো’ করলেই আর স্যারকে পাওয়া যেতো না।

পিতৃ আজ্ঞায় আমাকে সাবসিডিয়ারীর একটি বিষয় হিসেবে ইংরেজি নিতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আসামে এয়ারপি অফিসার বাবা আবু আহমদ মাহমুদ তরফদারের ‘ব্রিটিশ ইংলিশে’র প্রতি ছিল অসম্ভব প্রীতি। সে গল্প আরেক দিন বলবো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি শিক্ষকগণ যাঁদের একাত্তরের ঘাতকরা- কেবল বুদ্ধিজীবি ছিলেন বলেই হত্যা করেছিলো তাঁদের আরো একজন ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক রাশিদুল হাসান। স্যার পড়াতেন সি পি স্নো। এমন করে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট টেনে আনতেন যে পুরো বিশ্বের শীর্ষ উপন্যাসগুলো ও উদ্ধৃতিতে উঠে আসতো।

তখন যুদ্ধ চলছে। আমি আর বাবলী ক্লাস করার নাম করে ওপার থেকে আমাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের মাধ্যমে আসা যুদ্ধের প্রচারপত্র গোপনে বিলাতে যেতাম। যেতাম তাঁদের কাছে সতর্ক হবার খবর পৌঁছাতে। স্যাররা তখন বন্দুকের মাথায় ক্লাস করছেন। পুরো কলা ভবন থমথমে। রাশিদুল হাসান স্যারকে তখন কে একবার ধরে নিয়ে এবার ফিরিয়েও দিয়েছে। এখন তিনি ঢাকাবাসী আমাদের বাংলা বিভাগের স্যারদের মত তিনিও ক্লাস নিতে বাধ্য।

স্যারের কক্ষটা ছিলো ইংরেজি বিভাগের প্রায়ান্ধকার এক প্যাসেজে। চারিদিক দেখে শুনে সুরুত করে প্রবেশ করে দ্রুত বল্লাম, স্যার আপনাকে পালিয়ে যেতে বা বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে হবে। স্যার হেসে বললেন, ওরে মেয়েরা ওদের এত ভাবতে নিষেধ করো। যারা ধরে নিয়ে গেছিল তারাতো আমাদেরই ছাত্র। দেখো না কোন অত্যাচার ছাড়াই ক্লাস করার জন্য ছেড়ে দিয়েছে!

সেদিন বুঝিনি অমানুষিক অত্যাচারে আমাদের দেশের সোনার সন্তানদের প্রাণ কেড়ে নেবে বলেই তারা তখন তৈরি হচ্ছিল। হায়!

বাইরে বিলেতের রাত শীর্ণ হয়ে এসেছে। আজ আমার অভিজ্ঞানদাতা পিতৃতুল্য শিক্ষকদের কেউ নেই। আজ তাঁদের পদচিহ্ন পড়া বিদ্যাপিঠের ১০০ বছর। আজ কেন যেন অনেক আনন্দের স্মৃতি থাকলেও তাঁদের কথা বড় বেশী মনে পড়ছে!

তোমাদের নমি

শামীম আজাদ
লন্ডন
১ জুলাই ২০২০ 

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি