ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

তরুণদের মুখোমুখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:২৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) আয়োজনে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয় ‘লেটস টক’ অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে তরুণদের মুখোমুখি হন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন শহীদ বুদ্ধজীবী ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর কন্যা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. নুজহাত চৌধুরী। অনুষ্ঠানটির বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

 

উপস্থাপক : সবাইকে স্বাগত। শুরু করছি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত লেটস টক। আজকের পর্বে আমাদের সঙ্গে উপস্থিত আছেন বিশেষ একজন মানুষ, একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; আমাদের সবার প্রিয় আপা। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের এই অনুষ্ঠানে।

 

শেখ হাসিনা : আমারও ভালো লাগছে এই ছোট বাচ্চাদের দেখে। আমার কাছে ওরা বাচ্চাই। কেননা আমার নাতি-নাতনির বয়সী সব।

 

উপস্থাপক : আজকে আমরা যারা এখানে আছি, তরুণ-তরুণী যারা আছে, তারা সৌভাগ্যবান আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে। আমি যদি একটু ঘুরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করি, যে সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে আপনার নিরলস প্রচেষ্টা, এত পরিশ্রম, সেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কিন্তু তারাই (উপস্থিত তরুণ-তরুণীরা)। এই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের এই আয়োজনে এসেছেন আপনি কথা বলতে—আপনার কেমন লাগছে?

 

শেখ হাসিনা : আমার সৌভাগ্য যে এই তরুণ প্রজন্ম আমার সামনে। আর আমি মনে করি, বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে আমাদের তরুণ প্রজন্মই পারবে। আজকে যারা তরুণ শুধু তারা নয়, বরং ভবিষ্যতেও, যেমন আজকেও যে শিশুটি জন্মাবে, সেও তো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। তাদের জন্য একটি সুন্দর সমাজ গড়ে রেখে যেতে চাই।

 

উপস্থাপক : তরুণ শেখ হাসিনা—এই সম্পর্কে একটু জানতে চাই।

 

শেখ হাসিনা : প্রথমে ঢাকায় আসলাম ১৯৫২ সালে। তখন বাবা কারাগারে; উনার সাথে দেখা হলো না। হাঙ্গার স্ট্রাইক করার কারণে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো ফরিদপুরে। আবার আমরা ফিরে গেলাম। এরপর নির্বাচন হলো ১৯৫৪ সালে। আব্বা তখন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তিনি আমাদের নিয়ে এলেন ঢাকায় ’৫৪ সালে। আমরা—আমি, কামাল আর জামাল তখন ছোট—মাত্র হামাগুড়ি দেয়, একেবারেই ছোট, কোলে। তখন যখন এসেছি, তখনো আমার বাবা খুব ব্যস্ত। পাই না। উনি সেই সকালে বেরিয়ে যান আর গভীর রাতে যখন ফেরেন, তখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি।

 

উপস্থাপক : অভাবটা বোধ করতেন, তাই না?

 

শেখ হাসিনা : হ্যাঁ, ওই অভাবটা ছিল। তা ছাড়া গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদি, আত্মীয়-স্বজন তাদের সবার সাথে থেকে যেটা পেতাম, শহরে এসে মনে হতো একটু অন্য রকম, ওই পরিবেশটা নেই। এর পরেই আব্বা মিনিস্টার হলেন। মিনিস্টার হওয়ার পরে আমরা মিন্টো রোডে ছিলাম। তখন জীবনটা একটু অন্য রকম হলো, বেশ একটু...গাড়িতে বেড়াতে যেতাম। স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গেলেন, ভর্তি করে দিলেন। এরপর ধীরে ধীরে আবার একসময় আব্বা জেলে। তারপর আবার আমরা বাড়িছাড়া। ১৪ দিনের নোটিশে আবার আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। কোথায় মিন্টো রোড, সেখান থেকে গেলাম নাজির বাজার, আলাউদ্দিন রোডে—পুরান ঢাকায় যেখানে গাড়িটারি ভেতরে যায় না। রিকশাই চলে। আমাদের গাড়িটারি কিছুই নাই। আমরা রিকশায় চড়ি। এই যে আমাদের জীবনটা, সব সময় উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই চলত। তাতে একটা জিনিস আমরা কখনো অভাব বোধ করতাম না। আমার বাবা বোধ হয় ছোটবেলা থেকে আমাদের এমনভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন, জীবনটা যখন যেভাবে আসবে, সেভাবে মেনে নিতে হবে। আমরা কিন্তু সেভাবেই মেনে নিতাম এবং সেভাবেই করতাম। আব্বা জেলে, স্কুল বন্ধ। যেহেতু সরকারি স্কুলে ছিলাম, তারা নাম কেটে দিত। একবার নয়, বারবার এ অবস্থা আমাদের জীবনে এসেছিল।

 

দর্শকের প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধকালে আপনার পরিবার অবরুদ্ধ ছিল, সেই সময়টার বিষয়ে জানতে চাই। কিভাবে কেটেছিল?

 

প্রধানমন্ত্রী : আমি যেহেতু সব সময় রাজনীতিতে ছিলাম, আমরা ভাই-বোন সবাই রাজনীতিতে ছিলাম। আর দেশ স্বাধীন করার জন্য আমার বাবার যে পরিকল্পনা ছিল, এটাও আমরা নিজেরা অনেকটাই জানতাম। বাইরে হয়তো ততটা প্রচার ছিল না। কিন্তু তিনি আমাদের বলতেন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত কী হবে না হবে সব কিন্তু তিনি ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিলেন। যখন স্বাধীনতার ঘোষণাটি এলো, ৭ মার্চের পর থেকে দেখলাম সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হওয়ার সাথে সাথে উনার যেই মেসেজটা ছিল, সেটা বিজিবি, তৎকালীন ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিল। সেই সাথে সাথে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা বাড়িতে ঢোকার ঠিক কিছুক্ষণ আগে জাকির খান নামের এক ভদ্রলোক আমাদের পরিচিত, তিনি এসেছিলেন। তিনি আমাকে, আমার ছোট বোন রেহানাকে এবং আমাদের এক খালাতো বোনকে বললেন, আপনারা এখনই এই বাসা থেকে চলে যাবেন। এদের বিশ্বাস করবেন না। এরা কী করতে পারে আপনারা জানেন না। একরকম জোর করেই আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এরপর আব্বাকে অ্যারেস্ট করার পর কারফিউ জারি হলো। আমার মা ছিলেন বাসায়, আর আমার ছোট ভাইটা রাসেল আর মেজো ভাই জামাল। আমরা এসে মাকে খুঁজে পেলাম। ওই সময় আমরা বিভিন্ন জায়গায় থেকে শেল্টার নিয়েছিলাম। কিন্তু একসময় আমরা গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম। আর যেহেতু তখন আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম, আমার প্রথম সন্তান হবে। কোথাও থাকা, শেল্টার পাওয়াও খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। যখন অ্যারেস্ট করা হলো, পুরাতন ধানমণ্ডি-১৮ নম্বর রোডের একতলা একটি বাড়িতে আমাদের নিয়ে রাখা হলো। সেই বাড়িটায় কিছুই ছিল না। কোনো ফার্নিচার নাই, কিছুই নাই। সব ধুলো মাটিতে ভরা। আর পাকিস্তান আর্মি থেকে আমাদের একটি কম্বল দেওয়া হলো। পুরো পরিবারের জন্য ওই একখানা কম্বল ছিল একমাত্র সম্বল। খাওয়াদাওয়া কিছু নাই। কারণ দুপুরবেলা অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে, সারা দিন-সারা রাত আমাদের ওই অবস্থায় থাকতে হলো। এর পর থেকে ওই বন্দিখানায় তাদের অত্যাচারের শেষ ছিল না। খুব অত্যাচার করত। অনেক সময় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিত। আর আমাদের কোনো প্রাইভেসি ছিল না। কোনো পর্দা নাই, আমাদের কাছে কিছুই ছিল না। এই অবস্থায় থাকতে হয়েছে। এই অবস্থায় আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হলো। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, জন্ম হওয়ার পর ওকে যে প্রথম কাপড়টা দেওয়া হবে, সেটাও দেওয়ার কোনো ক্ষমতা আমাদের ছিল না। কারণ আমাদের বাজারটাজার করার এত তখন সুযোগও ছিল না। হাসপাতালের কাপড় দিয়েই কোনো মতে তাকে রাখা হলো। আমার এক বান্ধবী ছিল, সে-ও সন্তানসম্ভবা ছিল। ওর বোনের অপারেশন হয়েছিল, পাশের কেবিনে ছিল। ও কতগুলো কাপড় দিয়ে গেল আমাকে। সেখানে ওই অবস্থায় আমরা যখন থাকতাম মাটিতে, স্যাঁতসেঁতে ফ্লোর, সেখানেই থাকতে হতো। তবে একটা জিনিস— আমরা কখনো মনের জোর হারাইনি। আমাদের একটা ধারণাই ছিল, দেশ একদিন মুক্ত হবেই, স্বাধীন হবেই। আর জামাল ওই জেলখানায় থাকতে একদম প্রস্তুত ছিল না। সে বলত, আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবেই। ও খুব গেরিলা কায়দায় একদিন পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল। অত কষ্টের মধ্যে থেকেও দেশ স্বাধীন হয়েছে—এটাই বড় কথা। কিন্তু যেদিন পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করল—১৬ ডিসেম্বর, আমরা কিন্তু মুক্তি পাইনি। তখন মনে হতো সত্যেন সেনের কথা, রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ। চারিদিকে শুনি জয় বাংলা স্লোগান। আমরা ভেতর থেকে স্লোগান দিতাম। আমি, মা, রেহানা সবাই কিন্তু ভেতর থেকে স্লোগান দিচ্ছি। আমরা কিন্তু তখনো বন্দি এবং সারা দিন ওরা ওখানে মানুষ হত্যা করল। আমরা শুনছি মানুষের চিৎকার, আহাজারি, কান্না। ১৭ ডিসেম্বর আমরা মুক্তি পেলাম।

 

দর্শকের প্রশ্ন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা জানতে চাচ্ছি আপনার সেই তরুণ রাজনৈতিক জীবনের কিছু কথা। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, আমরা তরুণরা যারা আছি, যারা ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে চাই আজকের কথা তাদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

 

প্রধানমন্ত্রী : রাজনৈতিক একটি পরিবারে আমার জন্ম। আর রাজনীতি আমাদের সাথে এমনভাবে জড়ানো ছিল যে রাজনীতিতে ঠিক কখন প্রবেশ করলাম, তা সঠিকভাবে বলতে পারব না। স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। সেই সময় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন, তারপর আরো বিভিন্ন আন্দোলন। যখন আন্দোলন হতো তখন এটা ঠিক, স্কুল পালিয়ে চলে যেতাম সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মিটিং শোনার জন্য। আবার স্কুল থেকে আমাদের সংগঠন করতে হবে, ছাত্রলীগ করতে হবে বলা হলো। তাই স্কুল থেকে বিভিন্ন স্কুলে যেতাম। মেয়েদের বোঝাতাম কেন আমাদের সংগঠন করতে হবে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন। মানে আমরা আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করলাম। কিন্তু প্রথমে এলো আরবি হরফে বাংলা লিখতে হবে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হলো। এরপর রোমান হরফে বাংলা লিখতে হবে। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন হলো।

 

কলেজে ভর্তি হলাম। আমি ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে সেখানকার ছাত্রীরা খুবই উৎসাহিত। আবার আমাদের ছাত্রলীগের নেতারাও খুব উৎসাহিত। আমাকে প্রথমে ছাত্রলীগের সেক্রেটারি করা হলো কলেজ ইউনিটের। আমরা বিভিন্ন কলেজে গিয়ে গিয়ে সংগঠন করতাম। তখন প্রতিটি কলেজে বার্ষিক নির্বাচন হতো। তখন আমাকে সংগঠনের সেন্ট্রাল কমিটি থেকে জানানো হলো, ‘তোমাকে নির্বাচন করতে হবে।’ তখন আমার মা বাধা দিলেন। কেননা আমার বাবা তখন ছয় দফা দিয়েছেন। ছয় দফা দেওয়ার পর তিনি জেলে। আমাদের পার্টির তখন অধিকাংশ নেতাই বলতে গেলে জেলখানায় বন্দি। ওই অবস্থায় নির্বাচন করাটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আমি যে কলেজে পড়তাম, সেটা ছিল সরকারি কলেজ। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি কলেজে শেখ মুজিবের মেয়ে নির্বাচন করে জিতবে, এটা কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছুতেই মানতে পারেনি। ইলেকশন হলো। ইলেকশনে আমি জিতলামই না শুধু, আমার বিপক্ষে দুই প্রার্থী ছিল। তাদের দুজনের ভোট যোগ করেও তার দ্বিগুণ ভোট আমি পেলাম।

 

যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন শুনলাম, গভর্নর ভিসিকে ডেকে বলছেন, গনি সাহেব ভিসি ছিলেন। তাঁকে বলছেন, শেখ মুজিবের মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো কিভাবে? তিনি জানান, হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে প্রতিবছর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। আলাদাভাবে খোঁজ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? তিনি বেশ একটু ডাঁটের লোকই ছিলেন। পরে একজন শিক্ষক আমাকে জানিয়েছিলেন, তুমি কি জানো, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গভর্নর ভিসিকে ডেকে নিয়ে ধমক দিয়েছেন, শেখ মুজিবের মেয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো কিভাবে। তো আমাদের জীবনটা এমনই ছিল। আব্বা যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন শিক্ষকরা আমাকে খুব আদর করতেন। আবার আব্বা যখন জেলে গেলেন তখন বলতেন, ‘ও, ওর বাবা তো জেলে।’ তখন যত দোষ আমাদের ওপর।

 

উপস্থাপক : পঁচাত্তরে হঠাৎ করে ছোট বোন বাদে বাকি সবাইকে হারালেন। এমন মর্মান্তিক একটি আঘাতের পর আপনি নিজেকে শক্ত করলেন কিভাবে ? 

প্রধানমন্ত্রী : এটা অপ্রত্যাশিত ছিল! আর সেই সাথে একটা ভয়ও হতো। আব্বা এভাবে একটা দেশকে স্বাধীন করলেন, তারপর স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীটি সব সময় সক্রিয় ছিল। আমার স্বামী যেহেতু নিউক্লিয়ার সায়েনটিস্ট ছিলেন, উনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন রিসার্চের জন্য। আমাকেও বললেন চলে আসতে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমি ভিসি স্যারের সাথে দেখা করলাম ছুটির জন্য। বঙ্গবন্ধুর তখন যাওয়ার কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন, আর আমি থাকব না! তো আমি ভিসি স্যারের কাছে গেলাম, তখনকার ভিসি মতিন চৌধুরী স্যারের ছাত্র ছিলেন আমার স্বামী। তিনি বললেন, ‘তুমি চলে যাবে, এটা একটা কথা হলো নাকি?’ আমি বললাম, ‘স্যার, আপনার ছাত্রকে তো আপনি চেনেন, ভীষণ চাপ দিচ্ছেন। আপনার ছাত্রকে বলেন, আমি এখন যাব না, ১৫ তারিখের পরে যাব।’ তখন তিনি বললেন, ‘তুমি ওকে আমার কথা বলে ফোন করো।’ তখন তো আর এখনকার মতো এত ফোন ছিল না। একটাই ইন্টারন্যাশনাল কল করা যেত যেই ফোনে, সেটা আমার আব্বার বেডরুমে ছিল। ওখানে বসা উনি, বললাম, আমি একটা ফোন করব। ফোন করে যখন আমি বললাম, তখন খেলাম বকা। আব্বার সামনে ঝগড়াও করতে পারছি না। আবার কিছু বলতেও পারছি না। হয়তো অন্য সময় হলে কিছু বলতাম। আব্বা সব বুঝছিলেন। বলছিলেন, কি, ওয়াজেদ এটা বলছে, ও কথা বলছে। ঠিক আছে, তাহলে তুমি যাও। তখন আমার খুব মন খারাপ।

একটা ছবি আছে না, আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে, ওটা আব্বার সাথে আমার শেষ ছবি। আমি কাঁদছিলাম, আর আমাকে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিল— ঠিক আছে তুমি যাও। চলে গেলাম। তবে এটা ঠিক, মনটা খুব খারাপ ছিল। কারণ তার কিছুদিন আগে আমার দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। আমরা খুব একটা আনন্দের মধ্যে থাকব, আর আমার সব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। আর বিদেশে যাবার সময় মানুষ যেমন খুশি হয়, তেমন কোনো খুশি ছিল না। আর আমার মা-ও খুব কাঁদলেন। খুব ভারাক্রান্ত মন নিয়ে গেলাম। আমরা তখন ইউরোপ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। তখন আমরা বেলজিয়ামে। হঠাৎ একদিন সকালে ফোন। বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর বললেন, ওখানে খুন হয়েছে। ওই কথা শোনার পর মনে হলো তাহলে তো আমাদের আর কিছু নাই। ওদের ভাষায় টিভিতে আব্বার শুধু ছবি দেখছি। কিছু বুঝতে পারছিলাম না। জার্মানিতে ফিরে এলাম। তখন সেখানে অ্যাম্বাসেডর যিনি ছিলেন, তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। উনি, উনার ওয়াইফ সবাই খুব সান্ত্বনা দিলেন। তিনি একসময় আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, তিনি বিভিন্নভাবে খবর নিয়েছেন, সম্ভবত কেউই আর বেঁচে নাই।

আমি আসলে বলতে পারব না— পৃথিবীর ওই সময়টা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। আমি এসে দেখলাম, রেহানা শুয়ে আছে। আমি আস্তে করে রেহানাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলাম। বলতে পারলাম না কিছু। ওকেও আমি বলিনি। আর ও যখন জানতে পারল, ও কিছু আমাকে বলেনি। এ রকম একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে। তখন আমাদের অ্যাম্বাসেডর, ভারতের অ্যাম্বাসেডর কথা বলছিলেন। কেননা তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। মার্শাল টিটোও ফোন করেছিলেন। তারপর আমরা ভাবলাম, না, আমরা ফিরে যাই দেশে। দেখি, দেশে যেতে পারি কি না। তারপর চলে এলাম দিল্লিতে। তখন জানতে পারলাম, কেউই বেঁচে নেই। এর আগেও মনে আশা ছিল, মা, রাসেল হয়তো বেঁচে আছে। কিন্তু মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা হলে তিনি জানালেন, না, কেউই বেঁচে নেই। তিনি আমাদের ওখানে শেল্টার নিয়ে থাকতে বললেন। ছয়টা বছর ওখানে থাকতে হলো। প্রথম কয়েকটা বছর আসলে বিশ্বাস করতে পারিনি। বিশ্বাস করতে চাইনি। নামাজ পড়তাম, মোনাজাত ধরতাম। কিন্তু বাবা-মায়ের কথাটা কখনই বলতে পারতাম না। ভেতর থেকে আসত না। যা-ই হোক, দিন চলে যায়।

দর্শকের প্রশ্ন : ১৯৮১ সালে যখন আপনি ফেরত এলেন, তখন কারা বা কোন বিষয়টি আপনাকে মোটিভেট করেছিল। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আপনি সাহস কোথা থেকে পেলেন? আপনার ভয় করেনি?

প্রধানমন্ত্রী : পঁচাত্তর-পরবর্তী তিন-চার বছর একটা অন্ধকার সময় ছিল। বলা যায় একটা বাসায় বন্দি। সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এমনকি নিজের পরিচয় দেওয়ারও সুযোগ ছিল না। একটা নামও দেওয়া ছিল। ওই নামে আমাদের পরিচয়। নিজের পরিচয়টাও ছিল না। তখন মনে হতো, জীবনের সব থেকে কম যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু নিয়েই চলব। সেখানে থেকে সংসারের প্রতিটি কাজ একে একে আমাদের শিখতে হলো, করতে হলো। করে করে শিখলাম। বাড়ির বড় মেয়ে ছিলাম। আলসেও ছিলাম খুব। এমনও অনেক দিন গেছে, না খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। আব্বা এসে ঘুম ভাঙিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিতেন। আমার খুব বদ-অভ্যাস ছিল বসে বসে গল্পের বই পড়া আর গান শোনার। তখন মা এক কাপ চা বানিয়ে এনে দিতেন। নিজে খুব একটা বেশি কাজ করতাম না, আলসে ছিলাম এটা ঠিক। সেখান থেকে এমন একটা অবস্থায় পড়ে গেলাম, যে ঘর ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে সব কিছু নিজেদের করতে হতো, করতাম। একটা পর্যায়ে এসে আমার চাচা এসে রেহানাকে নিয়ে গেল লন্ডনে।

গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং দেশের মানুষের জন্য কিছু করা। কেননা ছোটবেলা থেকে আব্বার সাথে সাথে থেকে জানা, উনি বাংলাদেশের জন্য কী করবেন, বাংলাদেশটাকে কিভাবে গড়ে তুলবেন—সব সময় এ গল্পটা করতেন। করতেন বলেই মনে হলো, এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। আমাদের তো কিছু করতে হবে, দেশের জন্য। আর কিছু না হোক, মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আসব। এটা ঠিক, ওই সময় দেশে আসাটা বেশ ভয়াবহ ছিল। তার কারণ খুনিদের কিন্তু বিচার হয়নি। এতগুলো খুন যারা করল, একটা ছোট্ট শিশুকেও তারা ছাড়েনি; তাদের বিচার করা যাবে না, এমন ইনডেমনিটি বিল তারা পাস করল। আইন করে দেওয়া হলো খুনিদের বিচার করা যাবে না। আমি আমার বাবা-মাকে হারিয়েছি আমি বিচার চাইতে পারব না। আমি মামলা করতে পারব না। এ অবস্থায় দেশে ফেরা অবশ্যই সাহসের বিষয়। কেননা অনেকেই বলেছে, দেশে ফিরলে এয়ারপোর্টেই আমাকে গুলি করে মারবে। আমার চিন্তা ছিল, বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে তো হারিয়েছি। হারানোর আর তো কিছু নাই। সবই যখন হারিয়েছি, জীবনটাও না হয় চলে যাবে। তাই বলে মৃত্যুভয়ে বসে থাকলে তো আর হবে না। আর মরার আগে মরতে আমি রাজি না। আমি দেখতে চাই বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে পারি কি না। আর সে জন্যই ফিরে আসি।

যখন এয়ারপোর্টে নামলাম। ওই সময়টা ছিল খুব কষ্টের। কারণ আমি যখন যাই, তখন এয়ারপোর্টে  তো আমাদের সবাই ছিল। কামাল-কামালের বউ, জামাল-জামালের বউ, ছোট্ট রাসেল—সবাই আমাকে বিদায় দেয়। আর আমি যখন ফিরে এলাম, তখন হাজার হাজার মানুষ। আর মুষলধারে বৃষ্টি। আকাশে ঘন মেঘ। আমার মন তখন হাহাকার করছে। কারণ যে মুখগুলো আমি দেখতে চাচ্ছি, সে মুখগুলো তো দেখতে পাচ্ছি না। তাদের তো খুঁজে পাচ্ছি না। এয়ারপোর্ট থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত আসতে চার ঘণ্টা লেগেছিল, এত মানুষের ভিড় ছিল। সেখানে বৃষ্টিতে ভিজে মাইক্রোফোনের  সামনে আমাকে বত্তৃদ্ধতা দিতে বলা হলো। ওখানে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম। ১৫ আগস্ট—এটা মেনে নেওয়া যায় না।

 উপস্থাপক : এই স্রোতের বিপরীতে আপনার যাত্রা সম্পর্কে বলেন।

শেখ হাসিনা : বনানী কবরস্থানে আমি যখন গেলাম, সেখানে সারি সারি কবর। কিন্তু ৩২ নম্বরের বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কখনো। এমনকি আমি যে একটু মিলাদ পড়াব বা বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করাব সেই সুযোগও তৎকালীন সরকার আমাকে দেয়নি। তখন ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। বললেন, আমার থাকার জন্য অনেক বড় বাড়ি দেবেন। আমি বললাম, অনেক বড় বাড়ির দরকার নেই। এই বাড়িতে আমার বাবা-মা শাহাদাতবরণ করেছেন। আমি ওখানে যেতে চাই। তাদের জন্য মিলাদ পড়ব, দোয়া করব। আমাকে কিন্তু ঢুকতে দেয়নি।

 আর একটি মাত্র টিভি, একটি মাত্র রেডিও। মিথ্যা ও অপপ্রচার ছিল। সরকারের তরফ থেকে বাধা ছিল। দলের ভেতর থেকেও ছিল বাধা। কিন্তু তা অতিক্রম করতে পেরেছি।

দর্শকের প্রশ্ন : ২০০৭ সালে আপনি আপনার ছেলেকে দেখতে বিদেশে গেলে দেশে ফিরে আসার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়। বলা হয়, দেশে এলে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে। আপনি কি তখন ভয় পাননি?

শেখ হাসিনা : ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলাম। সেই সময় বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু কাজ করেছিলাম। দুর্ভাগ্য হলো সেই কাজগুলো আর থাকল না। বরং জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস আর দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। তারপর যখন আরেকটি নির্বাচন এলো, অনেক ঝড়ঝাপটা এলো। দেখা গেল, এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং এমনভাবে নির্বাচন সাজানো হলো যে জনগণের ভোট দেওয়ার আর ক্ষমতা ছিল না।

এর মধ্যে আমার ছেলের বউয়ের বাচ্চা হয়েছে। জয়েরও গলব্লাডার অপারেশন হয়েছে। তাদের সাথে দেখা করতে বিদেশে গেলাম। তখন আমার বিরুদ্ধে মার্ডারের মামলা দিয়ে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হলো। এর পরও যখন আমি দেশে ফিরতে চাইলাম, তখন তারা বলল, আপনি দেশে ফিরতে পারবেন না এবং প্রতিটি এয়ারলাইনসকে বলে দেওয়া হলো আমাকে নিয়ে তারা এলে তাদের বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে দেওয়া হবে না। আমেরিকা থেকে লন্ডনে যাওয়ার সময় আমি যে-ই এয়ারলাইনস ব্যবহার করি, তারা আমাকে বোর্ডিং পাস দেবে না। ঝগড়া করে বললাম, তোমার এয়ারক্রাফট লন্ডনে যাচ্ছে। ঢাকায় তো যাচ্ছে না। তিন ঘণ্টা বাগিবতণ্ডা শেষে আমি লন্ডনের ফ্লাইটে উঠি। সেখান থেকে লন্ডনে পৌঁছানোর পর আমাকে বাংলাদেশের ফ্লাইটে নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু আমি দেশে ফিরবই। তখন আন্তর্জাতিক সমর্থন পেলাম আমি। সবার কথা এটাই ছিল, আমারও যুক্তি ছিল, আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তা মোকাবেলায় আমি দেশে আসব। কিন্তু ওদের ধারণা ছিল আমাকে মামলার ভয় দেখালে হয়তো আর দেশে ফিরব না। আমি বললাম, না, আমি দেশে আসব এবং মামলার মুখোমুখি হব। শেষে আন্তর্জাতিক চাপে বাধ্য হয়ে আমাকে দেশে আসতে দেওয়া হলো এবং এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। কোর্ট থেকে আমাকে পরিত্যক্ত একটা ঘরে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি রাজনীতি করে এসেছি। জানি আমাকে জেলে যেতে হবে। তাই এটা নিয়ে আমার কখনো দুশ্চিন্তা ছিল না। বরং আগে থেকেই গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলাম কী বই নেব জেলে। রেহানা ফোন করে আরো বলে দিয়েছিল—টর্চ, মোম, লেখার কাগজ ইত্যাদি নিয়ে নিলাম। কিছু টাকাও নিয়েছিলাম সাথে। কারণ দেখতাম, বাবা কিছু টাকা সাথে রাখতেন।

দর্শকের প্রশ্ন : জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপনি কাজ করে গেছেন। এটি নিয়ে আপনার মধ্যে কোনো শঙ্কা কাজ করে বা করছে কি না।

শেখ হাসিনা : আমি চেয়েছি দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক। কিন্তু সারা দেশে যখন একযোগে ৫০০ স্থানে বোমা হামলা হয়, বোমা পুঁতে রাখা হয়— এ ধরনের কাজ আমি পছন্দ করিনি। আর আমি এর আগে ক্ষমতায় এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি করে সেখানকার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়ে প্রতিবেশী দেশে হামলা করা হতো। আমি বুঝেছিলাম, জঙ্গিবাদ থাকলে কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বিরোধী দলে থাকি, আর সরকারি দলে; যেটা নীতির ব্যাপার সেটার বিষয়ে সোচ্চার হওয়া শুধু সরকারি দলে এলেই করব, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় করব না, এমন নয়। আমার দেশকে আমি ভালোবাসি। আর সে কারণেই এ বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদ করেছি।

 

আর আমাকে তো অনেকবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কয়েকবার না, অনেকবার। এমনকি সামনে থেকে গুলি করেও হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে আমাকে। যখন বিভিন্ন অঞ্চলে গেছি, তখনো বাধা পেয়েছি। কিন্তু একটা বিষয়, এ দেশের মানুষের কাছে যেখানে গেছি সেখানে এত ভালোবাসা পেয়েছি। এই ভালোবাসা আমার শক্তি। সেটাই আমার প্রেরণা।

আজকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। এটাও তো বড় বিষয়।

 উপস্থাপক : ব্যক্তি শেখ হাসিনা সম্পর্কে জানতে চাই। এত খাটেন, নিজের জন্য সময় পান?

শেখ হাসিনা : আমি আমার জীবনটাকে তো উৎসর্গ করেছি দেশের মানুষের জন্য। আসলে আমার নিজের বলতে কিছু নেই। রাতে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমাই। আর বাকি সময় চেষ্টা করি কত দ্রুত আমার কাজগুলো শেষ করতে পারি। কারণ, আমি জানি যেকোনো মুহূর্তে চলে যেতে হতে পারে। কখনো গুলি, কখনো গ্রেনেড হামলার ভয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তে দেশের মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়ার চেষ্টা করি।

দর্শকের প্রশ্ন : রাজনীতিতে না এলে কী করতেন? ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?

প্রধানমন্ত্রী : আমার ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হব। এসএসসি পরীক্ষা দিলাম, তখন দেখলাম অঙ্কে কাঁচা। আর বন্ধুরা সবাই আর্টসে ছিল, আমিও আর্টসে ভর্তি হই। এরপর ইচ্ছা ছিল শিক্ষক হওয়ার। আবার শিক্ষক মানে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বাচ্চাদের পড়াব।

 দর্শকের প্রশ্ন : নিজের শরীরকে কিভাবে ঠিক রাখছেন?

প্রধানমন্ত্রী : আমাদের জীবনে রুটিন ঠিক থাকে না। তবে ফিট থাকতে আমি নামাজ পড়ি নিয়মিত। তেমন ব্যায়াম করা হয় না। আর গণভবনে থাকা বন্দি জীবনের মতো। তার পরও চেষ্টা করি সকালে উঠে একটু হাঁটতে। ছাদে হাঁটি। পরিমিতভাবে খেলে সুস্থ থাকা যায়। আর চিন্তা-ভাবনাকে স্বচ্ছ রাখা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমি সুস্থ থাকব— এটা ভাবা।

দর্শকের প্রশ্ন : নানি বা দাদি হিসেবে আপনি কেমন? আপনার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

প্রধানমন্ত্রী : সেটা আমার নাতি-নাতনিদের জিজ্ঞাসা করলে বলবে। আমরা লুডু খেলি, ক্যারম খেলি, দাবা খেলি। তারা আমার হাতের রান্না পছন্দ করে। আর ছোট একটা আছে, সে আবার খুব ডিমান্ড করে। বলে দেয়, তুমিই রান্না করবে। ববির ছোটটা। সে বলে, তুমিই রান্না করবে। সে কোলে চড়ে বসে, আবার নির্দেশও দেয় এটা দাও, ওটা দাও। বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনি নিয়ে থাকার চেয়ে আর কোনো সুখের সময় হয় না।

তরুণসমাজ কী চায় আমি জানতে চাই। জানলে পরে আমার সুবিধা হবে পরিকল্পনা গ্রহণে। আমরা কত বেশি মেয়ে এবং কত বেশি তরুণকে সুযোগ দিতে পারি, এই চেষ্টা করি। বিগত বছরগুলোতে আমরা অনেককে সুযোগ দিয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকে ভালো করেছে। অনেকের ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে। তবে বয়োবৃদ্ধ দেখে একেবারে অবহেলা করা উচিত হবে না।

দর্শকের প্রশ্ন : সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটি পুনর্বিবেচনা করবেন কি না?

প্রধানমন্ত্রী : কোটা বাতিলের জন্য আন্দোলন করা হয়েছে। সে কারণে কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে। অনেকে বলেছে, এই দাবি মেনে নেওয়া মানে হেরে যাওয়া। আমি বলেছি, না, হেরে যাওয়া নয়। কেননা বাচ্চারা দাবি করেছে। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোটা বাতিল করা হয়েছে। যারা প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আছে, তাদের বিষয়ে নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে।

দর্শকের প্রশ্ন : প্রান্তিক পর্যায়ের উন্নয়নে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন?

প্রধানমন্ত্রী : আমরা দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়ন পৌঁছে দিতে চাই। আমরা কাজ করছি। গ্রাম আর গ্রাম থাকবে না, শহরে পরিণত হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়ার সময় শহরকেন্দ্রিক বা রাজধানীকেন্দ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় না। বরং দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের কথাও ভাবা হয়। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের জন্যও কাজ করা হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের উন্নয়নের জন্যও কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। বাংলাদেশ নিয়ে যে দীর্ঘ পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে, আমি হয়তো তত দিন বাঁচব না। কিন্তু তোমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

দর্শকের প্রশ্ন : স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পথ কিভাবে বন্ধ হবে, কবে বন্ধ হবে?

শেখ হাসিনা : কারো ভেতরে যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বা দেশের প্রতি ভালোবাসা না থাকে, তারা কখনো দেশের উন্নয়ন করবে না, করতে চাইবেও না। পরাজিত শক্তির দোসর যারা, তারা তো দেশকে পিছিয়েই রাখতে চায়। এর ফলাফল আমরা দেখেছি ১৯৭৫ সাল থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমি দাবি করতে পারি, আমরা প্রমাণ করেছি সরকার জনগণের সেবক। গত ১০ বছর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের চিত্র একবার খুঁজে দেখার চেষ্টা করলে তোমরাই দেখতে পাবে কতটা এগিয়েছি আমরা। এর একমাত্র কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি। আগে যারা ছিল, সেখানে ভেজাল ছিল। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধের শক্তি, মুক্তিযোদ্ধা সব মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা।

দর্শকের প্রশ্ন : কবে দুর্নীতিমুক্ত হবে বাংলাদেশ?

 শেখ হাসিনা : এটা আমার লক্ষ্য আছে। আমি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করা হবে। আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের ভালো আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেখানে দুর্নীতি করার দরকার কী? অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে পারলে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব।

তরুণদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা

দেশকে ভালোবাসতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে কী পেলাম, না পেলাম, আমি দেশের জন্য কতটুকু দিতে পারলাম, মানুষের জন্য কতটা দিতে পারলাম—তা ভাবতে হবে। পরশ্রীকাতরতা থেকে বের হয়ে এসে নিজেকে নিজেরই বলতে হবে— আমি পারি। আমি আমার মতো করেই ভালো করব। কেউ দ্রুত ওপরে উঠে গেল দেখে আমাকে একটি অশুভ প্রতিযোগিতা করতে হবে, সেটা ঠিক নয়। সেই সঙ্গে দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হলে একটি মানুষও অবহেলিত থাকবে না। প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে। সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। আর তোমাদের দায়িত্ব নিজের মধ্যে সেই ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করে দেশের প্রতি দায়িত্ব, নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব এবং প্রতিবেশী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। আর সব সময় একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চললে দেশকে কিছু দিতে পারবে, নিজেও জীবনে কিছু করতে পারবে। হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই। জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা আসবে। কিন্তু ইচ্ছাশক্তি প্রবল থাকলে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা যায়।

 

 টিআর/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি