ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

নিখোঁজের ৯ বছর পর তরুণীকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর

দ্বীপ আজাদ, নোয়াখালী প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ২২:২৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

নিখোঁজের ৯ বছর পর নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার এক তরুণীকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শনিবার বিকেলে নোয়াখালীর প্রশাসক তন্ময় দাস আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে তার বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় নিখোঁজের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যাদের আশ্রয়ে তরুণীটি বেড়ে ওঠে সেই পালক পিতা মাতা এবং চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি ও জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

হাতিয়ার শূন্যের চরের সূর্যমুখী আসকা বাজার এলাকার মৎস্যজীবী মো. আবুল কাসেমের মেয়ে সেলিনা আক্তার শিরিন(১৯)। ৯ বছর আগে আবুল কাশেম সাগরে মাছ ধরতে যান। এ সময় সাগরের মাঝখানে তিনিসহ অপরাপর জেলেরা ডাকাতের কবলে পড়েন। শিরিন তার নানার বাড়িতে বেড়াতে যায়। নানীর অসুস্থতার কারণে তার সাথেই ছিল শিরিন। জেঠাসহ আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে শিরিন জানতে পারে ডাকাতরা তার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আরা সেই কারণে মা স্ট্রোক করে মারা গেছে। এরমধ্যেই  বড় জেঠার সাথে নানীর চিকিৎসার জন্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে যায় শিরিন।হাসপাতালে নানীর চিকিৎসা করানো অবস্থায় শিরিন হারিয়ে ফেলে তার নানী ও জেঠাকে। কান্নাকাটির এক পর্যায়ে অপরিচিত এক নারীর খপ্পরে পড়ে শিরিন। ওই নারী শিরিনকে তার নানীর কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায় চট্টগ্রামের হালিশহরে। সেখানে একটি বাসায় নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে একটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রি করে চলে যান সেই নারী। সেখানে শিরিনের ওপর নানানভাবে শারিরীক নির্যাতন চালানো হতো।

এভাবে প্রায় ৩ বছর সেই বাড়িতে থাকাবস্থায় শরীরে নির্যাতনের বহু ক্ষত নিয়ে পালিয়ে আসে শিরিন। সারাদিন অভুক্ত কিশোরী শিরিনের তখন বয়স মাত্র ১৩ বছর। এক পর্যায়ে রাতে সন্দ্বীপের অধিবাসী হালিশহরের স্বপ্না বেগমের বাসায় উঠে শিরিন। কান্নাকাটি করে শুধুমাত্র রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার আকুতি জানায়। কোমল হৃদয়ের স্বপ্না এক পর্যায়ে কিছু না ভেবেই মানবিক কারণে সেই রাতে শিরিনকে আশ্রয় দেয়। পরদিন সারা শরীরে নির্যাতনের ক্ষত দেখিয়ে স্থানীয় থানায় নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন স্বপ্না বেগম। এরপর থানা কর্তৃপক্ষের অনুরোধে শিরিনকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন স্বপ্না বেগম। 

এভাবে দুই-তিনদিন থাকার পর স্বপ্নার বড় বোন সানোয়ারা বেগম (৪৫) ও তার স্বামী দিদারুল আলম শিরিনকে মানবিক কারণে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সেই থেকে নিজের মেয়ের মতোই শিরিনকে পড়ালেখা করানো থেকে সবকিছু করেন। গত জুন মাসে মহা ধুমধাম করে শিরিনকে বিয়ে দেন তারা।

দীর্ঘ এই সময়ে তারাও চেষ্টা করেছেন শিরিনের পিতৃপরিচয় এবং তার পরিবারকে খুঁজে পেতে। ব্যর্থ হয়ে সেই আশা ছেড়ে দেন তারা। শিরিন তাদের মেয়ে হিসেবেই জীবন-যাপন করতে থাকে। অন্যদিকে শিরিনের প্রকৃত বাবা-মাও কয়েকদিন মেয়েকে খুঁজে ফিরেছেন। তবে শিরিনের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিদের মতে- শিরিন হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে, হয়তো সে আর বেঁচে নেই- এমন সব কথার কারণে এক পর্যায়ে শিরিনকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন তার বাবা-মা। শিরিন নিখোঁজের ৪ দিন পর তার বাবা ডাকাতের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। সবকিছু মিলিয়ে শিরিনদের সংসারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। 

এদিকে একটি সংবাদ পরিবেশনের সূত্র ধরে সেই পরিবারটি গত জুন মাসের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে সুবিধা বঞ্চিত শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জীবনমান উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে কর্মরত সংগঠন ভোরের আলো’র অফিসে যান। প্রতিষ্ঠানটির সহযোগি প্রতিষ্ঠান মাসিক কাট্টলী বার্তায় একটি সংবাদের কারণে তাদের এই অফিসে যাওয়া। এক পর্যায়ে কাট্টলী বার্তা’র প্রধান সম্পাদক ও ভোরের আলো’র প্রতিষ্ঠাতা মো. শফিকুল ইসলাম খানকে শিরিনের বিষয়টি অবগত করেন এবং তার পরিবারকে খুঁজে দেয়ার অনুরোধ করেন সানোয়ারা-দিদারুল আলম দম্পত্তি।

প্রায় ১ মাস পর আগস্টে ভোরের আলো’র প্রতিষ্ঠাতা উন্নয়ন কর্মী, সংগঠক ও সাংবাদিক মো. শফিকুল ইসলাম খান হাতিয়ায় শিরিনের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। স্থানীয় প্রবীণ সাংবাদিক মোস্তফা সাহেব স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারেন শিরিনের বাবা ও মা এবং অন্যান্য ভাই-বোনেরা সবাই বেঁচে আছেন। এরপরই শিরিনের বাবা আবুল কাসেম (৪৭) এবং মা ফাতেমা খাতুনকে (৪২) চট্টগ্রামে ভোরের আলো অফিসে ডাকা হয়। তাদের কাছে থাকা শিরিনের ছবি ও জন্ম নিবন্ধন কপি পাওয়া যায় যা সঠিক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও শিরিনও তার বাবা-মাকে চিনতে পারে।
  
নানান আইনী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পৃথকভাবে শিরিনকে লালন-পালনকারী পরিবার, শিরিনের শ্বশুর-শাশুরি ও স্বামীকে, শিরিনের প্রকৃত মা-বাবাকে নোয়াখালী থেকে ভোরের আলো অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। সব কাগজপত্র ও প্রমাণাদি মিলিয়ে প্রমাণ হয় শিরিনের মা-বাবা তারাই। দীর্ঘ ৯ বছর বাবা-মায়ের ¯স্নেহবঞ্চিত শিরিন আক্তার সেলিনাকে তার প্রকৃত মা-বাবার হাতে তুলে দেয়া হয়। 

আরকে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি