ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রথম চিঠি- তবে প্রেমপত্র নয়

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ২০:৪৭, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

অরুমনি,
এটা তোমার কাছে আমার প্রথম চিঠি- তবে প্রেমপত্র নয়। তোমার পাওয়া প্রথম চিঠি যে প্রেমপত্র নয়, সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। সময়কালে তুমি বহু ছেলের মাথা খারাপ করবে, বহু তরুণের হৃদয় চুরমার করবে, গুচ্ছ গুচ্ছ প্রেমপত্র পাবে- সে সবই আমি জানি। সে সব ভবিষ্যৎ নায়কদের সঙ্গে এঁটে ওঠা আমার কম্মো নয়। আর তাছাড়া খুব সম্ভবত: তারা সব আমার সময় ও জীবনকালের পরে আসবে। 

তাই প্রেমপত্র না লিখে তোমাকে বরং একটি অন্য রকমের চিঠি লিখি। এই যেমন তোমার-আমার  জানা-শোনা, চেনা-পরিচয়, ভাব-ভালোবাসা নিয়ে- অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পেঁচিয়ে।

তোমার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বছর চারেক আগে। যখন তুমি তোমার মায়ের কোল আলো করে এ পৃথিবীতে এসেছিলে। মা-বাবাসহ বেশ সবাইকে উথাল-পাথাল করে এ পৃথিবীতে তোমার আগমন। ব্যতিব্যস্ত হয়েছি আমি এবং তোমার খালাও। আমি তখন চিলির পথে জন এফ. কেনেডী বিমানবন্দরে, আর তোমার খালা নাইরোবীতে। তারপর নিউ ইয়র্ক-ঢাকা-নাইরোবীতে নানান বার্তা চালাচালির পরে শান্তি। 

কিন্তু এগুলো বড় কথা নয়। বড় কথা হলো- তুমি আমাদের সবার জীবনে এক রাশ আনন্দ নিয়ে এসেছো। তোমার কারণেই তোমার মা-বাবা মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে, তোমার খালা হয়েছে খালা পদে অভিষিক্ত এবং সেই সঙ্গে আমার পদোন্নতি হয়েছে বাবা থেকে নানাতে। তুমি তাই তোমার মা’য়ের বাচ্চা, বাবার পুতুল, খালার বিল্লী ও নানার বুড়ি।

তোমার মা যখন আমাকে বললো যে, তোমার নাম রাখা হয়েছে ‘অরুণিমা’, তখনই আমি চমকেছিলাম। কারণ প্রায় ৩৫ বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তোমার প্রয়াত নানী মেয়েদের জন্যে একটা অনুষ্ঠান করতেন- তার নাম ছিল ‘অরুণিমা’। তোমার মা’ও এটা জানতো না। একদিন তুমি এটা জানবে। একদিন তুমি এটাও জানবে যে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তোমার নানী প্রায়ই বলতো, তাঁর কন্যাদের সন্তানেরা জানবে না যে, কি মজার একটা নানী তাদের হতে পারতো। 

নাম ডাকা নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার একটা কোস্তাকুস্তি তোমার মুখে বোল ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল। তুমি মা’কে ‘মা’ বলতে, বাবাকে ‘বাবা’, কিন্তু আমাকে বলতে ‘কাগা’। তোমার মা-বাবা এতে বেশ বিব্রত হত। তোমাকে পাখী পড়ানোর মতো বলা হতো- ‘ন’ আকার ‘না’, ‘ন’ আকার ‘না’- ‘নানা’। তুমি দু’টো অক্ষরই আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করে দু’টোকে মিলিয়ে ‘নানা’ বলার বদলে বলতে ‘কাগা’। তোমার ‘কাগার’ জবাবে আমি তোমাকে ‘কোজো’ বলতাম। 

তারপর সেই যে ‘হায় রে কুপাল’ এর সচল চিত্র। আমার বন্ধুদের কাছে আমি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়ে গেলাম তার কল্যাণে। বড় হয়ে কোন একদিন ‘কাগা-কোজোর’ গল্প শুনে তোমার মজাই লাগবে আর ‘হায় রে কুপাল’ দেখে তুমি হয়তো বিব্রত হবে। 

একদম ছোটবেলায় আমি ঢাকায় এলে তুমি আমার বিছানায় বসে খেলতে, আমার চশমা ধরতে, আমার নাকে-মুখে হাত বুলাতে। যখন হাঁটতে শিখলে তখন ভোরে উঠেই আমার ঘরে চলে আসতে। তারপর শুরু হতো আমাদের খেলা। ঢাকায় কখনও সখনো বিকেলের দিকে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতে তুমি- খেলতে, আমার ‘সুনতা’ খুঁজে না পেলে খুঁজে দিতে। চশমার প্রতিভাষা ‘সুনতা’ তোমারই আবিষ্কার। বড় আনন্দের সময় কাটতো আমাদের। এখনও মুঠোফোনের ক্যামেরায় আমাদের দেখা-সাক্ষাত হয়। আমরা গাড়ীর রঙ দেখি, ফল চিনি, গাছ শনাক্ত করি। 

আরো কত কিছু করার কথা ছিল তোমার-আমার। কিন্তু এর মধ্যেই করোনা পৃথিবীকে ওলোট-পালোট করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তোমার পৃথিবীও বদলে গেছে। এই যেমন- তুমি বাইরে যেতে পারছো না, ঘরে বসেই তোমাকে স্কুল করতে হচ্ছে। তোমার জন্মদিনও আগের মতো করা যাচ্ছে না।

কিন্তু পৃথিবীর যাই হোক না কেন, আমাদের সবার আদরে তুমি একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছো। তুমি তোমার মা-বাবার চোখের মনি, আমাদের সবার আদরের ধন। শীলা, নীপা, শিখা তোমাকে বড় মমতায় আগলে রাখে। আজ তোমার চার বছর পূর্ণ হল। এই জন্মদিনে তোমার জন্যে পৃথিবীর সব আদর আর ভালোবাসা নিয়ে এলাম।

জানি, আমার এ চিঠি তুমি এখন পড়তে পারবে না। তোমার মা পড়ে শোনালেও তুমি হয়তো তেমন কিছু বুঝবে না। কিন্তু একদিন বড় হয়ে এটা পড়বে, তখন দেখবে তোমার জীবনের প্রথম চার বছরে তোমার-আমার জানা-শোনা, আলাপ-পরিচয়, ভাব-ভালোবাসা এক প্রেম কাহিনীও বটে। স্মৃতিরা কখনো হারায় না, তারা শুধু লুকিয়ে থাকে। একদিন সেই লুকিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো তুমি ঠিকই খুঁজে পাবে। 
অনেক আদর আর চুমু,
নানাভাই

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি