ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ জুন ২০২৫

জুলাই অভ্যুত্থানে সহিংসতা

বিএমইউ’র চিকিৎসকসহ ৩৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:০৬, ১ জুন ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

সিন্ডিকেট সূত্র বলছে, গত বছরের ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংস হামলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।

প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকরিচ্যুতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বেশ কয়েকজন নেতাসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা রয়েছেন। এসব শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চার ধরনের অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে কেবিন ব্লকের সামনে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ১৫ জন, ছাত্র-জনতার সঙ্গে মারামারিতে জড়িত ছিলেন প্রায় শতাধিক শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। নেপথ্যে থেকে ওই ঘটনার নেতৃত্বদান ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন ২৩ জন।

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট। দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) এলাকায়। সেদিন দুপুরে কেবিন ব্লকের সামনে একদল চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে চড়াও হন আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর। উপস্থিত সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে ভয়ংকর সব দৃশ্য। সেখানে দেখা যায়, এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ৩০টিরও বেশি গাড়ি-অ্যাম্বুলেন্স জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাঙচুর থেকে রক্ষা পায়নি প্রশাসনিক ভবন ও অফিস কক্ষ। এমনকি মূল্যবান যন্ত্রপাতি লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরে জানায়, সেদিনকার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সুস্পষ্ট ভিডিও প্রমাণ; ক্যাম্পাসে অগ্নিসংযোগ, মারামারি, ভাঙচুর ও লুটপাটে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

ওই ঘটনার ঠিক পরের সপ্তাহে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন যুক্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুলে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্যরা ওই সময়ের ভিডিও ফুটেজ, নিরাপত্তা প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ, প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের জবানবন্দি এবং অভিযুক্তদের লিখিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তদন্তে দেখা গেছে, অভিযুক্তদের একাংশ সরাসরি হামলায় অংশ নেয়, কেউ-বা নেপথ্যে থেকে নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা দেয়, আবার কেউ নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধ্বংসে ভূমিকা রাখে।

এমনকি তদন্তের ভিত্তিতে কমিটি দুই দফায় শিক্ষার্থী হত্যাচেষ্টা, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৩৪ জন শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ‘চূড়ান্তভাবে অপরাধ প্রমাণিত’ হয়েছে বলে সুপারিশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ও দক্ষতা অধ্যাদেশ অনুযায়ী, তাদের প্রত্যেককে চাকরি থেকে ‘পদচ্যুত’ বা ‘চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত’ করার প্রস্তাব করে কমিটি

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক শিক্ষার্থীকে ‘প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে’ যেভাবে নির্যাতন করা হয়, তার ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষ্য সুস্পষ্ট। ওই ঘটনায় ‘ক’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত ১৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা সরাসরি অংশ নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের ৫ (ঘ), ৫ (ঝ) এবং ৫ (ট) ধারায় আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়, তাদের চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে পদচ্যুত করার সুপারিশ করেছে কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় সংখ্যক চিকিৎসক-কর্মকর্তার একযোগে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ।

এছাড়া ‘খ’ ক্যাটাগরিতে থাকা ২৩ জনের মধ্যে ১৯ জনের বিরুদ্ধে সরাসরি ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, ভাঙচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগে অংশ নেওয়ার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিটিভি রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই ব্যক্তিরা হামলার সময় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাদের ক্ষেত্রেও অধ্যাদেশের ৬ (ঠ) ধারা অনুযায়ী চাকরি থেকে পদচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী, তাদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসক ও প্রশাসনিক পদে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

তদন্ত কমিটি বলছে, তারা কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় নয় বরং কেবল প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। কমিটির একাধিক সদস্যের ভাষ্যমতে, অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য ছিল গতানুগতিক ও অসংলগ্ন এবং ঘটনাস্থল সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট বা কার্যকর প্রমাণ উপস্থাপন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, সংশ্লিষ্টদের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য ছিল প্রমাণহীন ও দুর্বল। কেউই ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করতে পারেননি বা ঘটনার সময়ে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার মতো গ্রহণযোগ্য তথ্য দিতে পারেননি।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের জবাব চাওয়া হলে তাদের মধ্যে ১৮ জন পেনড্রাইভ ও সিডিতে ভিডিও জমা দেন; যেগুলো তদন্তে ‘একই উৎস থেকে তৈরি, এডিটেড এবং ঘটনাস্থলের সাথে সরাসরি সম্পর্কহীন’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটি বলছে, একাধিক অভিযুক্ত একই ভিডিও কনটেন্ট আলাদা আলাদা হিসেবে জমা দিয়েছেন, যা ঘটনাটির প্রকৃত প্রেক্ষাপট বা দোষ নির্ধারণে কোনোভাবেই সহায়ক নয়। বরং এটি বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা হতে পারে। এমনকি কমিটি জানায়, তদন্তের সময় অভিযুক্তদের পাঠানো বিভাগীয় হাজিরা শিট, ছবি বা চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্রও পরীক্ষা করে দেখা হয়। এসব তথ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা ঘটনার দিন ক্যাম্পাসে ছিলেন— এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়।

কমিটির এক সিনিয়র সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘একাধিকবার যাচাই-বাছাই ও প্রত্যক্ষ তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রস্তুত করেছি। গত জুলাই-আগস্টে দেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় চিকিৎসকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে— এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার।’

তিনি বলেন, ‘মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় একটি সেবামূলক ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা আসেন, তাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানুষের সেবা, জ্ঞানচর্চা এবং মানবিকতা। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক পরিচয়ে কেউ কেউ রাজনৈতিক হিংসা ও দমন-পীড়নের অংশ হয়েছেন, এমনকি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হয় না। এ কারণে আমরা সুপারিশ তৈরির সময় বিশেষভাবে খেয়াল রেখেছি যেন ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে গিয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হয়।’

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেট সদস্য জানান, এখন পর্যন্ত দুই দফায় ৩৪ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে, এখানেই তদন্ত থেমে নেই। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘মূলত তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৮ জনের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তদন্তাধীন চারজনকে আপাতত তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে আরও যাচাই চলছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় দফার সিদ্ধান্তে যেসব চিকিৎসক চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি উদ্বেগজনক।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তদন্ত এখনও অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন নজর দিচ্ছে অন্যান্য সহায়ক কর্মী— যেমন নার্স, ওয়ার্ডবয়, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের ভূমিকার দিকেও। হয়তো আগামী সিন্ডিকেট সভায় সেই তালিকাও আসবে। তখন তাদের বিষয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

শিক্ষার্থীদের ওপর সহিংসতার প্রসঙ্গে এ সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, ‘হামলাটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। আমরা দেখতে পেয়েছি, কিছু চিকিৎসক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এতে জড়িত ছিলেন। এমন ঘটনায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নয়, পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর একটা কালো দাগ লেগেছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এবং তদন্ত প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, ‘এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না। তদন্ত কমিটি স্বচ্ছভাবে কাজ করেছে, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা ব্যক্তিগত বিবেচনা এখানে কাজ করেনি। আমরা তদন্ত কমিটির সুপারিশ সিন্ডিকেটে আলোচনা করেছি এবং সেখানকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রশাসনিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছি।’

এসএস//
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি