মাদক নির্মূলে অভিযান কাজে লাগছে কি?
প্রকাশিত : ১৫:৩৫, ১৮ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৫:৪৭, ১৮ মে ২০১৯

মাদকের বিরুদ্ধে এক প্রকার যুদ্ধে ঘোষণা করেছে সরকার। প্রতিনিয়ত চলছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান। প্রতিদিনিই কথিত বন্দুক যুদ্ধে মারা যাচ্ছে কেউ না কেউ। এপর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রায় দুই শাতাধিক লোক মারা গেছে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী দাবি, নিহতরা সবাই কোন না কোন ভাবে মাদক ব্যবসায়ী। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এমন অভিযানের শুরু থেকে বলে আসছে এগুলো বিচার বর্হিভূত হত্যা। তবে এমন অভিযান সরকার ও প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপ মাদক নির্মূলে তেমন কোন কাজেই আসছে না। দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
একসময় দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ভারতীয় কফ সিরাপ‘ফেনসিডিল’আসক্তি ছিল বড় সমস্যা৷ পরে সেই স্থানটি দখল করে নেয় মিয়ানমার থেকে আসা উত্তেজক বড়ি‘ইয়াবা’৷ যদিও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে ধারণা করা হয়, বিভিন্ন পেশাজীবী এবং নানা বয়সি মানুষের মধ্যে ইয়াবা আসক্তি ছড়িয়ে পড়েছে৷ ২০১৭ সালে বিভিন্ন সংস্থা উদ্ধারই করেছে চার কোটি ইয়াবা, যা ২০১৫ সালের দ্বিগুণ৷ এ থেকেই ইয়াবাসেবীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়৷
ইয়াবা আসক্তির এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান কিছুটা জনসমর্থন পেয়েছে বলে মনে হয়েছে৷ কিন্তু কক্সবাজারের তথাকথিত‘বন্দুক যুদ্ধে’নিহত একরামুল হকের এক অডিও নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে দেশে-বিদেশে৷ জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি আর্ন্তজাতিক সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধসহ একরামের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আহ্বান জানিয়েছে৷ তবুও এই অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমন অভিযান বন্ধ নেই মাদক কেনাবেচা। ইয়াবাসহ মাদক পাচারকারী গডফাদাররা এখন কৌশল পাল্টিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। "ইদানীং মেয়েদেরকে এখানে মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারীদের এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে, ওরা শুধু বহনকারী মাত্র। অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীদের একটা অংশের আত্মসমর্পণের ঘটনাকে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটা বড় সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তবে এই অভিযান নিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আলোচনা সমলোচনা।
২০১৫ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি তরল কোকেনের চালান ধরা পড়ে৷ খানজাহান আলি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় বলিভিয়া থেকে আসা একটি কন্টেনারে ১০৭ ড্রাম সানফ্লাওয়ার তেলের মধ্যে দুই ড্রাম তরল কোকেন পাওয়া যায়৷ পরে ল্যারেটরি টেস্টেও কোকেনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ৷ এই ঘটনায় দায়ের করা মাদক আইনের মামলাটি এখন আদালতে বিচারের অপেক্ষায় আছে৷ বাংলাদেশে কোকেন সংক্রান্ত অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বাংলাদেশের মাদক চোরাচালান এবং ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাতে বাংলাদেশকে মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷
তাতে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়া বা এশিয়ার বাজারে বিভিন্ন ধরনের মাদক নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরাপদ রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে ৷ এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণেই চোরাচালানের রুট হিসেবে এ পথ পাচারকারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ বাংলাদেশে বর্তমানে মাদক হিসেবে এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে৷ এর ফলে কিডনি, লিভার ও ফুসফস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ সাময়িক যৌন উত্তেজনা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়৷ এছাড়া ইয়াবার কারণে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে৷
পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেন,‘‘ভারতে পাচার করার পথে চট্টগ্রামে এ সব কোকেন ধরা পড়ে৷’’তিনি বলেন,‘‘এ চালানের কাগজপত্র থেকে জানা গেছে, চালানটি ভারতের যে কোনো বন্দরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল৷ এ অঞ্চলে ব্যাপকহারে মাদক চোরাচালান কিছু দিন ধরে বেড়েছে ৷ তিন মাসে দক্ষিণ অ্যামেরিকা ও আফ্রিকা থেকে আসা বিপুল পরিমাণ কোকেন ভারতের বাজারে প্রবেশ করেছে ৷ এছাড়া একই সময়ে কাঠমান্ডুতেও প্রচুর পরিমাণে কোকেন জব্দ করা হয়েছে ৷ তবে জাতিসংঘ মনে করছে, দক্ষিণ এশিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে আরও প্রচুর কোকেন পাচার হচ্ছে, যা ধরাই পড়ছে না৷ গার্ডিয়ান বলছে, সম্ভবত ল্যাটিন অ্যামেরিকার একটি সংঘবদ্ধ চক্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে নিজেদের চোরাচালানের রুট আড়াল করতেই দক্ষিণ এশিয়াকে পাচারের পথ হিসেবে ব্যবহার করছে৷ এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই এ কাজ করছে তারা৷ এছাড়া মেক্সিকোর সিনালোয়া অথবা প্যাসিফিক কার্টেলের মতো চক্রগুলো এশিয়াকে মাদকের একটি বড় বাজার হিসেবে দেখছে৷’’
২০১২ সালে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৬ কেজি হেরোইনের একটি চালান ধরা পড়ে৷ এর কয়েক বছর আগে এই বিমানবন্দরেই ২০ কেজি হেরোইনের একটি চালানসহ একজন ব্রিটিশ নাগরিক গ্রেপ্তার হন৷ ওই মামলায় ব্রিটিশ নাগরিকের শাস্তিও হয়৷ পরে অবশ্য সাধারণ ক্ষমায় মুক্ত হয়ে তিনি দেশে ফিরে যান৷ এলিয়েডা ম্যাকগর্ড নামের ওই বৃটিশ তরুণী ছিলেন হোরোইন বহনকারী৷ মূল পাচারকারিদের তখন চিহ্নিত করা যায়নি৷ আর তখনও মাদক চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে৷ ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখ৷ আর এখানে এখন মাদক হিসেবে ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা নামের এক ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট৷ এছাড়াও হেরোইন, গাঁজা এবং ফেনসিডিলের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য৷
২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মোট হেরোইন উদ্ধার করেছে ৪৮ কেজি, গাঁজা ১৬ হাজার কেজি, ফেনসিডিল দেড় লাখ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ৫০ লাখ পিস৷ এর বাইরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে৷ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এই আইনে ২০১৭ সালে সারাদেশে মোট মামলা হয়েছে ১,০৬,৫৩৬টি৷ এই মামলাগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের অভিযোগ, আটক এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা হয়েছে৷ আর এ সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন৷
যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে, তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ৷ আর ৯০ শতাংশ মাদকই ধরা পড়ে না৷ জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ইউএনওডিসি)-র মতে, বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা ট্যাবলেটই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, প্রতিটির দাম দুইশ` টাকা হিসেবে যার বাজারমূল্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা৷ ২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবার ব্যবহার ৮০ শতাংশ বেড়েছে৷ আর ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪৬ শতাংশ৷ ২০১২ সালে মোট মাদকসেবীর মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা হয়েছে ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ৷
২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ৷ ৭০ লাখের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ৷ তাদের মধ্যে ৭০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে৷ ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আহসানিয়া মিশন পরিচালিত অ্যাডিকশন ম্যানেজমেন্ট এবং ইন্টেগ্রেটেড কেয়ার সেন্টার৷ সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় ছাড়াও এখানে আছে নারীদের জন্য মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও নিরাময় কেন্দ্র৷ এখান থেকেই গাজীপুর ও যশোরে পুরুষদের দু’টি নিরাময় কেন্দ্রের কার্যক্রমের তদারকি চলে৷ মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সপ্তম৷ মাদকাসক্তরা মাদকদ্রব্য কেনায় বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে৷
বাংলাদেশে মাদকের ব্যবহার কমছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর প্রায় সবারই জানা৷ বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়৷ যদি বড় ব্যবসায়ী বলা হয়, তাহলে সেরকম মাদক ব্যবসায়ী আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি৷ সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ১৪১ জন৷ তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই আছেন৷ মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার৷ কোনো কোনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করেন৷
বাংলাদেশের শুধু শহরাঞ্চল নয়, গ্রাম এলাকায়ও পৌছে গেছে মাদক৷ আর ঢাকাসহ শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মাদকসেবী এবং ব্যবসায়ীদের বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷ চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেও ঢাকার বসুন্ধরা এলাকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে গত ১১ জুন শতাধিক মাদকসেুবীকে আটক এবং ইয়াবাসহ বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়৷ মাদকসেবীদের চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম৷ তিনি বলেন,‘‘প্রধান তিনটি কারণে বাংলাদেশে মাদক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ ১. চাহিদার সঙ্গে পর্যাপ্ত জোগান, ২. মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত এবং কৌতূহল এবং ৩. হিরোইজম৷ মাদক সকল অপরাধের মূলে কাজ করে৷’’
তিনি বলেন,‘‘মাদকের চাহিদা আছে, তাই সরবরাহও আছে৷ আর এই সরবরাহ বন্ধ করতে না পারলে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না৷ সরবরাহ বন্ধের দায়িত্ব সরকারের৷ সরকার তার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করতে পারছে না বা মাদক সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না৷ বাকি দায়িত্ব সমাজ ও পরিবারের৷ যদি সরবরাহ বন্ধ করা না যায়, তাহলে সমাজ ও পরিবার দায়িত্ব পালন করলেও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই এর চাহিদা তৈরির জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তাই করবে৷’’ বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর৷ এর বাইরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে কাজ করে৷
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল এবং জল সীমান্ত থেকে এই সময়ের আলোচিত মাদক ইয়াবা পাচার হয়ে আসে৷ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে ইয়াবা সরবরাহ করে মিয়ানমার৷ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার শুরু ২০০৬ সাল থেকে৷ ২০১২ সালে চীন ও থাইল্যান্ডের মধ্যে চুক্তির পর মিয়ানমারের মাদক উৎপাদনকারীদের জন্য ঐ সব দেশে পাচার কঠিন হয়ে পড়ে৷ তখন তারা বাংলাদেশকেই মাদক পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে৷ এছাড়া ভারত সীমান্ত থেকে ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদক পাচার হয়ে আসে৷ আকাশ পথও ব্যবহার করে মাদক পাচারকারীরা৷ আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আছে তাদের সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক৷
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ অবশ্য মনে করেন, মাদকের চাহিদা এবং জোগান দু`টি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ তিনি বলেন, ‘‘মাদকের চাহিদা বন্ধ করা গেলে জোগান থাকলেও কোনো লাভ নেই৷ কেউ মাদক কিনবে না৷ আমরা এখন সাপ্লাই চেইন ধ্বংসের জন্য সমন্বিত অভিযান চালাচ্ছি৷ কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণভাবেও জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে৷ মাদকের ব্যাপারে অনেকের ভুল ধারণা আছে৷ কেউ কেউ এটাকে ফ্যাশন এবং হিরোইজম হিসেবে নেয়৷ এটার কুফল আমাদের বুঝাতে হবে৷’’
সব সংস্থা মিলে ২০১৭ সালে অন্যান্য মাদকের সঙ্গে আলোচিত মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে চার কোটি ৮০ হাজার পিস৷ মাদক মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ১,৮২,৮৩২ জনকে৷ বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে মোট ১১৬১২টি৷ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই বছরে শাস্তি পেয়েছেন ১০৬৫ জন আর খালাস পেয়েছেন ১৬১৫ জন৷ জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘আমাদের মাদক আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে৷ মাদকের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন৷ আমরা আইন সংস্কার ও ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য কাজ করছি৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত জনবল নেই, তা সত্য৷ তবে মাদক নিয়ন্ত্রেণ পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডও কাজ করে৷ আমরা সবাই মিলে মাদক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি৷’’বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার৷ আর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন প্রায় দেড় শতাধিক ব্যক্তি৷ কিন্তু এখনো মাদক চোরাচালানের কোনো গডফাদার আটক বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি৷
দেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে যারা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত, তারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ যাদের আটক করা হচ্ছে, তারা মাদকসেবী ও সাধারণ খুচরা বিক্রেতা৷ যারা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা মূল পাচারকারী, তারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না৷ তাদের কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে আবার কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকায়ই আছেন৷ মাদক আইনের ফাঁকের কারণে তাদের ধরাও যাচ্ছে না বলে পুলিশ জানায়৷ মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোনো কোনো এলাকার পুলিশ সদ্যদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় অভিযান দেখানোর জন্য সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে অনেক৷ অভিযানের মধ্যেই টেকনাফের মাদকের গডফাদার বলে পরিচিত সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আমানুর রহমান বদি তার দুই সহযোগীকে নিয়ে সৌদি আরবে ওমরাহ করতে চলে গেছেন৷
সাধারণ মানুষের ধারণা, বাংলাদেশে মাদকের বিস্তারের আইন-শঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি গ্রুপের হাত আছে৷ তারাই মাদক ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক৷ তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘মাদক কখনোই নির্মূল করা সম্ভব নয়৷ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷ মাদক একেবারেই থাকবে না, এই নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়৷ আমরা মাদকের সরবরাহ বন্ধ করতে সব জায়গায় কাজ করছি৷ মাদকের মূল গডফাদার থেকে শুরু করে এর বিক্রেতা, পাচারকারী, সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারী সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছি৷ তবে মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও জনসচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে৷ আমরা এই কাজও শুরু করেছি৷’’
অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশে মানসম্পন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রও গড়ে তুলতে হবে৷ যেসব নিরাময় কেন্দ্র আছে, সেগুলো মানসম্পন্ন নয়৷ প্রয়োজনীয় এবং দক্ষ চিকিৎসকও নেই৷’’
টিআর/
আরও পড়ুন