ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

শৈশবে হারানো শিশু ফিরে এলো ৮০’র বুড়ো হয়ে!

বদরুল হাসান লিটন, রাজশাহী থেকে

প্রকাশিত : ২০:৩৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ২০:৪১, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি

৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি

এ যেন সিনেমার এক বাস্তব কাহিনী। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে সৃষ্টি হয়েছে তেমনই এক পুনর্মিলনের বাস্তব জীবনের পটভূমি। হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর পর আপন ঠিকানাসহ প্রিয়জনদের খুঁজে পেলেন আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে খুঁজে পাবার পর স্বজনরা জানান, ছেলের আশায় এখনও পথ চেয়ে আছেন আব্দুল কুদ্দুসের শতবর্ষী মা মঙ্গলেমা বিবি। সব ঠিক থাকলে শনিবার দেখা হতে যাচ্ছে বয়োবৃদ্ধ মা-ছেলের।

৭০ বছর আগে পুলিশ সদস্য (দারোগা) চাচার হাত ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রাজশাহীর বাগমারায় বেড়াতে এসে হারিয়ে যান ১০ বছরের শিশু আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। অনেক খোঁজা-খুঁজির পরও তাকে না পাওয়া গেলে পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, সম্পত্তির লোভে পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান আব্দুল কুদ্দুসকে বেড়াতে নিয়ে যাবার নাম করে হত্যা করেন তার চাচা!

তবে সেই ধারণা মিথ্যে প্রমাণ হলো ৭০টি বছর পরে এসে। শৈশবে হারিয়ে যাওয়া সেই আব্দুল কুদ্দুস মুন্সিকে অবশেষে খুঁজে পেয়েছে তাঁর পরিবার। ১০ বছরের সেই ছোট্ট শিশুটি আজ ৮০ বছরের বৃদ্ধ।

আব্দুল কুদ্দুস মন্সির চাচাতো ভাইয়ের নাতি শফিকুল ইসলাম জানান, গত ১২ এপ্রিল নিজেরই পাশের গ্রামের আইয়ূব আলী নামের পরিচিত একজনের ফেসবুক আইডিতে হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলেন আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। সেখানে তিনি শুধু পিতা-মাতা ও নিজ গ্রাম বাড্ডার নাম বলতে পারেন। 

পরে ওই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাড্ডা গ্রামের বাসিন্দারা সাড়া দিতে থাকেন। একপর্যায়ে ভিডিওটি আমার নজরে আসলে আইয়ুব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সিকে খুঁজে পাই। এরপর আব্দুল কুদ্দুস মুন্সির ভাগ্নেসহ চারজন গত ২১ সেপ্টেম্বর তার বাসায় যান।

শফিকুল ইসলাম আরও জানান, আব্দুল কুদ্দুস মুন্সির পিতা কালু মুন্সির তিন সন্তান ছিলেন। এখনও জীবিত আছেন তার শতবর্ষী মা মঙ্গলেমা বিবি (১১০) ও এক বোন। গত ২১ সেপ্টেম্বর মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলেছেন আব্দুল কুদ্দুস। আর এত বছর পর নিজের পরিবার খুঁজে পাওয়ায় আনন্দিত আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী-সন্তানরাও।

শফিকুল ইসলাম বলেন, আশা করছি শনিবার মায়ের কোলে ফিরবেন আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আত্রাই স্টেশন থেকে রাতে ট্রেনে চড়ে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে নামবেন তিনি। সেখান থেকে আবার ট্রেনে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদেশ্যে রওনা দিবেন।

শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, পরিবারের সদস্যসহ গ্রামবাসীর মধ্যে প্রচার ছিল যে, জমি আত্মসাৎ করার জন্য ছোট চাচা পুলিশের দারোগা বেড়াতে নিয়ে গিয়ে তাকে মেরে ফেলেছেন। তাই এ ঘটনার পর তার চাচাও আর কোনোদিন গ্রামের বাড়িতে যাননি। 

আব্দুল কুদ্দুসের সেই ভিডিও ধারণকারী আইয়ুব আলী বলেন, বারুইপাড়া বাজারের মোড়ে এক চায়ের দোকানে বসে ৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। তার গল্পটি ফোনে রেকর্ড করে গত ১২ এপ্রিল আমার ফেসবুক পেজে আপলোড করি। আর ফেসবুকে ওই পোস্টের উপরে লিখে দেই, ব্রহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার এই বৃদ্ধ আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে হারিয়ে গিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। কেউ যদি তার কথা শুনে চিনতে পারেন, তাহলে যোগাযোগ করবেন।

তিনি আরো বলেন, তার পর বহু মানুষ সেই পোস্ট শেয়ার করেন। বিদেশে কিছু মানুষ ওই এলাকার আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন, তারাও দেখেন। তারপর ওই এলাকার মানুষ ফেসবুকে ওই ভিডিও দেখে ৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আব্দুল কুদ্দুসের সন্ধান পান তার পরিবারের লোকজন।

ঘটনার নায়ক আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি জানান, আমার চাচা বাগমারা থানায় আমাকে বেড়াতে নিয়ে আসে। তিনদিন থানায় ছিলাম চাচার সঙ্গে। তবে সেখানে থাকতে ভালো লাগছিল না। এ জন্য থানা থেকে বের হয়ে যাই, কিন্তু আর ফিরে আসতে পারিনি। হাঁটতে হাঁটতে আত্রাইয়ের সিংসাড়া গ্রামে চলে যাই। পরে ওই গ্রামের মৃত সাদেক আলীর বাড়িতে আশ্রয় পাই এবং সেখানেই বড় হই। পরে বাগমারা বারুইপাড়া গ্রামে বিয়ে করে সেখানেই সংসার করি। বর্তমানে তাঁর তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলে থাকে বিদেশে। আর এক ছেলে বাড়িতে। 

আট সন্তানের জনক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমার মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে প্রথম যখন কথা বলি, তখন আমার মা আমাকে বলে ‘তুই আমার হারিয়ে যাওয়া আব্দুল কুদ্দুস বাবা। তোর ছোট বেলায় হাত কেটে গিয়েছিলো।’ মায়ের মুখে এ কথা শোনার পরে আমি বলি, ‘মা তোর কুদ্দুসের কোন হাত কেটে গিয়েছিলো?’ তখন মা বলে, ‘বাম হাতের বুড়া আঙ্গুল কেটে গিয়েছিলো’। তখন আমি বুঝতে পারি যে, তিনিই আমার মা।

এদিকে, হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর পর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আব্দুল কুদ্দুসের বর্তমান আবাস বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে। চায়ের দোকান থেকে পাড়া-মহল্লার মোড়ে মোড়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে আব্দুল কুদ্দুসের অনবদ্য গল্প।

এনএস//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি