ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪

সমলিঙ্গের মানুষ থেকেও কি বাচ্চা জন্ম দেওয়া সম্ভব?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৪৫, ১৩ অক্টোবর ২০১৮

দুটি সমলিঙ্গের ইঁদুর মিলে কি একটি বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দিতে পারে? জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে কাজটা করে দেখিয়েছেন চীনের বিজ্ঞানীরা।

দুটি মা ইঁদুর থেকে জন্ম নিয়েছে একটি বাচ্চা ইঁদুর, কোনও বাবা ইঁদুরের দরকার পড়েনি। প্রাণী জগতে প্রজননের নিয়ম পাল্টে দেওয়া এই গবেষণাটি চালায় চীনের একাডেমি অব সায়েন্স।

চীনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুটি মা ইঁদুর থেকে জন্ম নেওয়া এই বাচ্চা ইঁদুরগুলো একেবারেই সুস্থ ও স্বাভাবিক। তারাও পরবর্তীতে বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দিয়েছে।

একই পরীক্ষা পুরুষ ইঁদুরদের ওপরও চালানো হয়। সেখানেও জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে বাচ্চা ইঁদুরের, কিন্তু সে সব বাচ্চা বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। কয়েক দিন পরেই মারা গেছে।

যে কারণে এই অভিনব পরীক্ষা

গবেষকরা আসলে একটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। প্রজননের জন্য দুই বিপরীত লিঙ্গ আসলে কতটা অপরিহার্য। মানুষ থেকে শুরু করে সব ধরণের স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে কেবল দুই বিপরীত লিঙ্গের মিলনের মাধ্যমেই নতুন বাচ্চা জন্ম দেওয়া সম্ভব। মায়ের কাছ থেকে দরকার হবে ডিম্বাণু, বাবার কাছ থেকে শুক্রাণু।

কিন্তু বিশ্বের অন্য অনেক ধরণের প্রাণীর বেলায় কিন্তু এই একই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কিছু মাছ, সরীসৃপ, উভচর এবং পাখি কিন্তু একা একাই প্রজননের কাজটি করতে পারে।

কিন্তু চীনের বিজ্ঞানীরা এখন যে কাজটি করে দেখালেন, তার মানে কি প্রজননের ক্ষেত্রে পুরুষের অপরিহার্য ভূমিকা ফুরিয়ে গেল? কুমারীর পক্ষে কি তাহলে এখন সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব, যাকে বলা হয় ‘পার্থেনোজেনেসিস।’

প্রজননের ক্ষেত্রে যে নিয়ম-কানুন, তার কোনটি ভাঙ্গতে পারলে একই লিঙ্গের দুজনকে ব্যবহার করে নতুন প্রাণীর জন্ম দেওয়া সম্ভব, সেটাই চীনা গবেষকরা জানার চেষ্টা করছিলেন। এটি জানতে পারলে এটাও বোঝা সম্ভব কেন এসব নিয়ম এত গুরুত্বপূর্ণ।

যেভাবে তারা এই কাজটি সম্ভব করলেন

খুব সহজ করে বলতে গেলে সর্বাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে। দুই মা ইঁদুর থেকে বাচ্চা ইঁদুর জন্ম দেওয়ার কাজটা ছিল অনেক সহজ। তারা একটি মেয়ে ইঁদুর থেকে একটি ডিম্বাণু নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় মেয়ে ইঁদুর থেকে নিয়েছেন এক ধরণের বিশেষ সেল বা কোষ। এগুলোকে বলা হয় ‘হ্যাপলয়েড এমব্রোয়োনিক স্টেম সেল।’

নতুন প্রাণের জন্ম দেওয়ার জন্য যত জেনেটিক কোড বা ডিএনএ দরকার, এই দুটিতে ছিল তার অর্ধেক অর্ধেক। কিন্তু দুটিকে মেলানোই যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানীরা ‘জিন এডিটিং’ এর মাধ্যমে এই দুটি থেকে তিন জোড়া করে জেনেটিক কোড ডিলিট করেছেন বা মুছে ফেলেছেন যাতে করে তাদের মধ্যে মিলন সম্ভব হয়।

তবে দুই বাবা ইঁদুরের ক্ষেত্রে কৌশলটা ছিল একটু ভিন্ন ধরণের। বিজ্ঞানীরা একটি পুরুষ ইঁদুর থেকে নিয়েছেন একটি শুক্রাণু, অন্য পুরুষ ইঁদুর থেকে নিয়েছেন একটি হ্যাপলয়েড এমব্রোয়োনিক স্টেম সেল। এটি আসলে এক ধরণের ডিম্বাণু, যা থেকে ‘জিন এডিটিং’ এর মাধ্যমে অনেক তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে।

যা জানতে পারলেন বিজ্ঞানীরা

এই যে প্রকৃতির নিয়ম ভেঙ্গে চীনা বিজ্ঞানীরা একই লিঙ্গের ইঁদুর ব্যবহার করে বাচ্চা জন্ম দিতে সফল হয়েছেন, এ থেকে তারা কী জানতে পারলেন? কী শিখলেন?

প্রজননের ক্ষেত্রে দুই বিপরীত লিঙ্গ কেন অপরিহার্য তা বুঝতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এক্ষেত্রে দু ধরণের বিপরীত লিঙ্গের দরকার পড়ে। কারণ আমাদের ডিএনএ বা জেনেটিক কোড বাবা নাকি মা, কার কাছ থেকে আসছে, তার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। জেনেটিক কোডের একটি যদি পুরুষ এবং একটি নারী থেকে না আসে তাহলে আমাদের পুরো শারীরিক-মানসিক বিকাশ গোলমেলে হয়ে পড়ে।

অর্থাৎ আমাদের যে ডিএনএ শুক্রাণু থেকে এবং যে ডিএনএ ডিম্বাণু থেকে আসে, তাতে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের ‘ছাপ’ থাকে। এটিকে বলে ‘জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং’। সেটাই আসলে নির্ধারণ করে কিভাবে এই দুয়ের সংযোগে নতুন কি তৈরি হবে।

এই জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং এর ক্ষেত্রে যদি কোনও ভুল হয়, তখন নানা রকম রোগ হতে পারে, যেমন ‘অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম।’

চীনা বিজ্ঞানীরা যখন একই লিঙ্গের ইঁদুর ব্যবহার করে নতুন বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দিয়েছেন, তখন তাদের জেনেটিক এডিটিং এর মাধ্যমে এই জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং বা ছাপ সংশোধন করতে হয়েছে বা মুছে ফেলতে হয়েছে। যাতে করে নতুন ইঁদুর জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়, সেটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়।

এই পরীক্ষা যারা চালিয়েছেন, তাদের একজন ড. ওয়েই লি বলেন, ‘আমরা এই গবেষণার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি কী করা সম্ভব। আমরা দেখেছি দুই মা থেকে যে বাচ্চা ইঁদুর হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে অনেক ত্রুটি সারিয়ে তোলা সম্ভব। স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে দুই বিপরীত লিঙ্গের অপরিহার্যতাকে অতিক্রম করা সম্ভব।’

তার মানে কী একই লিঙ্গের মানুষ থেকে মানবশিশুর জন্ম সম্ভব?

এর উত্তর হচ্ছে- না, খুব সহসা এটি সম্ভব হবে না। ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডের ড. টেরেসা হোম বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে এর সম্ভাবনা আছে।

‘এই গবেষণার মাধ্যমে একই লিঙ্গের যুগলরা নিজেরাই যেন স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্ম দিতে পারেন, তার পথ খুলে যেতে পারে।’

তবে তিনি এটি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এই পথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রশ্নের মীমাংসার দরকার হবে। অনেক ধরণের ঝুঁকি মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করার দরকার হবে।

তার মতে যতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত না হবেন যে এভাবে জন্ম নেওয়া শিশু শারীরিক এবং মানসিকভাবে আর দশটা শিশুর মতই বেড়ে উঠতে পারবে, ততদিন এটা ঘটবে না।

চীনা বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়ায় যে সব ইঁদুরের জন্ম দিয়েছেন, সেগুলো কতটা স্বাভাবিক তা নিয়ে অনেকের সংশয় আছে।

ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের ড. রবিন লোভেল-ব্যাজ বলেন, ‘দুটি মা ইঁদুর ব্যবহার করে যেখানে বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দেওয়া হয়েছেও সেখানেও আমি নি:সন্দেহ নই যে সেগুলো স্বাভাবিক। সেখানে সাফল্যের হার কিন্তু অনেক নীচে। আমার মনে হয় না এ রকম কিছু করার কথা কেউ ভাববে।’

কাজেই প্রজননের ক্ষেত্রে লিঙ্গ এখনও অপরিহার্য। এটির প্রয়োজন খুব শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে, এমনটা বলা যাচ্ছে না।

সূত্র: বিবিসি

একে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি