ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪

সুরা ইয়াসিনের ফজিলত-সার কথা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:২২, ১০ এপ্রিল ২০২৪ | আপডেট: ১৫:১১, ১০ এপ্রিল ২০২৪

সুরা ইয়াসিন পবিত্র কোরআনের ৩৬তম সুরা। সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর রুকু ৫টি ও আয়াত ৮৩টি। প্রথম দুটি অক্ষর থেকে এই সুরাটির নাম। আল্লাহর একত্ব ও মহানবী (সা.)-এর রিসালাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এই সুরায়। অংশীবাদের সমালোচনা, পৌত্তলিকদের অমরতা, অবিশ্বাসীদের কূটতর্কের উল্লেখ করে ইসলামের সত্যতা ও কিয়ামতের পুনরুত্থানের বর্ণনা রয়েছে এখানে। 

সুরা ইয়াসিন অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি সুরা। মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টির এক হাজার বছর পূর্বে সুরা ইয়াসিন ও সুরা ত্বহাকে তিলাওয়াত করেছেন। সুরা ইয়াসিন শুধু কোরআনে কারিমের মধ্যেই নয় বরং তাওরাত কিতাবেও এ সুরাটি ছিল। তখন এই সুরার নাম ছিল ‘মুনয়িমাহ’ বা কল্যাণ। এই সুরা পাঠকারী নিজের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনে।

হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুরই একটা হৃদয় থাকে আর কোরআনের হৃদয় হলো সুরা ইয়াসিন। যে ব্যক্তি সুরা ইয়াসিন একবার পড়বে, মহান আল্লাহ তাকে দশবার পুরো কোরআন পড়ার সওয়াব দান করবেন।’ (তিরমিজি)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘সুরা ইয়াসিন কোরআনের রুহ বা হৃৎপিণ্ড। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের কল্যাণ লাভের জন্য সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে তার জন্য রয়েছে মাগফিরাত বা ক্ষমা। তিরমিজি শরিফে উল্লেখ রয়েছে, সুরা ইয়াসিন একবার পাঠ করলে দশবার কোরআন খতম করার নেকি হয় এবং পাঠকের সব গুনাহ মাফ হয়।

হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তার সারা দিনের সব প্রয়োজন পূর্ণ করে দেবেন। এবং সব বিপদাপদ থেকে তাকে রক্ষা করবেন। হাদিসে আরও বলা হয়েছে, রাতে সুরা ইয়াসিন পাঠ করলে নিষ্পাপ অবস্থায় ঘুম থেকে ওঠা যায় এবং পূর্বের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ তাফসিরে রুহুল বয়ানে একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে তার সব মকসুদ হাসিল হইবে। যে ব্যক্তি সুরা ইয়াসিন বেশি বেশি পড়ে থাকে কেয়ামতের দিন এই সুরাই তার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খোলা থাকবে। 

হজরত আবু যর (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছি তিনি বলেছেন, মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তির কাছে সুরা ইয়াসিন পাঠ করলে তার মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ হয়ে যায়। (মাজহারি)। 

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি সুরা ইয়াসিন অভাব-অনটনের সময় পাঠ করে তাহলে তার অভাব দূর হয়, সংসারে শান্তি ও রিজিকে বরকত লাভ হয়। (মাজহারি)। 
ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর বলেন, যে ব্যক্তি সকালে সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুখে-শান্তিতে থাকবে। যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে সে সকাল পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে (মাজহারি)। 

অন্য এক হাদিসে এসেছে- হজরত ইবনে ইয়াসার (রা.) বর্ণনা করেছেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তাআলা তার বিগত জীবনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (বায়হাকি আবু দাউদ)। 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাতে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তার ওই রাতের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (দারেমি)

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত- মহানবী (সা.) বলেছেন, সুরা ইয়াসিনের বিশেষ কতগুলো নেয়ামত হলো এই সুরা পাঠ করলে ক্ষুধা দূর হয়, পিপাসা দূর হয়, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির ভয় ও বিপদ দূর হয় ইত্যাদি। এ ছাড়াও সুরা ইয়াসিন পাঠ করার অসংখ্য ফজিলত রয়েছে যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বেশি বেশি সুরা ইয়াসিন পাঠ করার তাওফিক দান করুক।

সূরা ইয়াসীন এর মূল বার্তা কি?

সূরা ইয়াসীনে একটি প্রারম্ভিকা, তিনটি অংশ এবং একটি উপসংহার রয়েছে। প্রারম্ভিকা অংশে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা সমগ্র কুরআন এর পরিচয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে স্বল্প বাক্যে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। গ্রন্থ, নবী(সাঃ), সীরাত, এবং লক্ষ্য।

সূরার প্রথম শব্দ ইয়া-সিন, এর পরপরই কুরআন কে উল্লেখ করে বলা হলো, অল কোরআনিল হাকিম (বিজ্ঞানময় কুরআনের কসম) এবং, এরপর ই নবী (সাঃ) কে নিয়ে বলা হলো, ইন্নাকালা মিনাল মোরসালিন (তুমি নিঃসন্দেহে রসূলদের অন্তর্ভুক্ত)। তার কাজ কি? তিনি কি করছেন? আ'লা সিরাতিম মোসতাকিম (সরল-সোজা পথ অবলম্বনকারী)। 

অর্থাৎ, আপনার কাছে এখন মেসেজ রয়েছে, রাসূল বা পথপ্রদর্শক ও রয়েছেন, পথনির্দেশ বা কোন পথে চলতে হবে তা ও জানা আছে। এবং গন্তব্য একটা ই, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা।

এভাবেই সূচনা পর্ব সাজানো হয়েছে।

সূরা ইয়াসীনের প্রথম অংশ, এখানে অতীত বা ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশ, বর্তমান অর্থাৎ আমাদের চারিপাশে বিদ্যমান নিদর্শনসমূহের কথা বলে। এবং তৃতীয় অংশ, ভবিষ্যৎ অর্থাৎ আমাদের পরিণতি নিয়ে অবগত করে। ইয়াওমুল কিয়ামাহ, জান্নাত, জাহান্নাম নিয়ে আলোচিত হয়েছে।

প্রথম অংশ, সূচনা এবং উপসংহার অংশে একটি বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক। তা হলো, মৃত ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করা এবং নিজেকে পুনরুজ্জীবিত হবার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ এর সেই সময়ের জন্য প্রস্তুত করা। এটিই সূরা ইয়াসীনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূল শিক্ষা! এবং এই কারণেই কোন ব্যক্তি মারা যাবার পূর্বে তার সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবার বিষয়ে এতো গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। 
আপনি প্রকৃতপক্ষে মারা যাচ্ছেন না। আপনার জীবনের সমাপ্তি তো ঘটছে না। এটি কেবল এই নশ্বর দুনিয়া থেকে আপনার অস্তিত্বের বিদায়। কিন্তু পরবর্তী দুনিয়ায় আপনি অনন্তকালের জন্য জীবন লাভ করবেন। আপনার কেবল শারীরিক মৃত্যু হচ্ছে। রূহের কোন মরণ নেই।

মরণাপন্ন ব্যক্তির সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তির রূহকে শরীর থেকে আলাদা হবার জন্য প্রস্তুত করা।

সূরা ইয়াসীন এর ভূমিকা অংশে জীবন এবং মরণ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম অংশে যে ঘটনার কথা এলো, সেখানেও জীবন এবং মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিটিকে হত্যা করা হলো এবং কি বলা হলো?

কি'লাদখুলিল জান্নাত (প্রবেশ করো জান্নাতে)। সে জান্নাত লাভ করলো। অর্থাৎ, এখানে ও জীবন এবং মরণ এর ব্যাপার টা এসেছে। মধ্যভাগে, যেখানে আল্লাহ চারপাশে বিদ্যমান নিদর্শন উল্লেখ করেছেন; আল্লাহ তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন। প্রথমত, এদের জন্য নিষ্প্রাণ ভূমি একটি নিদর্শন অর্থাৎ পৃথিবী! দ্বিতীয়ত, বেহেশত। এবং সর্বশেষ নিদর্শন হচ্ছে আমাদের মানবসত্তার সৃষ্টিরহস্য।

বস্তুতপক্ষে আল্লাহ প্রদত্ত এই তিনটি উপমা, অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা, এই বিশ্বজগত আমাদের চারদিকের সমস্ত কিছু নিয়ে গঠিত। একইভাবে, জান্নাত ভূমন্ডলের সীমার উপরিভাগে আসমানে রয়েছে। এবং সর্বশেষ, আল্লাহ আমাদের যে কাজগুলো করবার ক্ষমতা দিয়েছেন; তা সর্বশক্তিমান সত্তা প্রদত্ত নেয়ামত।

যা কিছু আমাদের দ্বারা সৃষ্ট, তা হয়তো পৃথিবী এবং জান্নাতের মতো আল্লাহর সরাসরি সৃষ্ট কিছু নয়। কিন্তু, যখন ই আমরা হাত দ্বারা কিছু তৈরি করছি, আল্লাহ বলছেন আমিই তোমাকে এ কাজ করবার বিচক্ষণতা দিয়েছি, তোমাকে এ কাজ করবার প্রয়োজনীয় উপকরণ সমূহ তো আমি ই আঞ্জাম দিয়েছি। আমি তোমাকে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির উপর দিয়ে ভ্রমণ করবার ক্ষমতা দিয়েছি। সুউচ্চ দালান, সুপার কম্পিউটার বানাবার শক্তি তোমায় আমি ই দিয়েছি। তোমার নিজের দ্বারা একা এটি কখনোই সম্ভব হতো না। আমি তোমাকে তুখোড় বুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্কের অধিকারী করেছি, যা কাজে লাগিয়ে তুমি এসব তৈরি করলে। তাই এসব আয়াতসমূহ ও প্রকৃতপক্ষে আমার অস্তিত্ব ই প্রমাণ করে।

এবার ভবিষ্যতের কথায় আসা যাক। যার সূচনা তারপর একটি শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে দিয়ে। এরপর আসে, সেই আয়াতটি যা আমরা ইশার সালাতের সময় পাঠ করে থাকি, জান্নাতীরা আজ আনন্দে মশগুল রয়েছে। কিছু পরেই রয়েছে জাহান্নামীদের প্রতি ধিক্কার। কিভাবে তারা সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখে ও অস্বীকার করতে থেকেছে।

সর্বশেষে আসছে, সূরার উপসংহার অংশটি। সমাপ্তি অংশ আলোকপাত করে একটি ঘটনার প্রতি। আমরা প্রত্যেকেই সেই অস্বীকারকারী ব্যক্তির ঘটনা শুনেছি যে একটি হাড় নিজ হাতে ভেঙে টুকরো টুকরো করে রাসূল(সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলোঃ হে মুহাম্মদ! তুমি কি আসলেই মনে করো যে ভেঙে টুকরো হয়ে ধূলায় মিশে যাওয়া এই অস্থি থেকে তোমার স্রষ্টা কোনভাবে কোন অস্তিত্বের পুনরুজ্জীবন দিতে সক্ষম? সে নিজ হাতে তা রাসূলের সামনে ভেঙে ফেলছিলো। তখন আল্লাহ এ আয়াত নাজিল করলেন যার অর্থ, “সে আমার সম্পর্কে এক অদ্ভূত কথা বর্ণনা করে এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে: (এই) অস্থিসমূহ যখন পচে গলে যাবে তখন কে তাকে জীবিত করবে?” সূরা ইয়াসীন, আয়াতঃ৭৮

আল্লাহ আমাদের সূরা ইয়াসীনের সারনির্যাস স্বীয় জীবনে সঠিক রূপে উপলব্ধি করে তার উত্তম প্রতিফলন করবার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা কুরআন'কে বিচারের সেই ভয়াবহ দিনে আমাদের জন্য সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে গ্রহণ করুন।

এমএম//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি