ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

সেই সব চিরন্তন অমলিন স্মৃতি

ওবায়েদ-উল-হক

প্রকাশিত : ১৬:০৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১

আব্রাহাম লিংকন সম্পর্কে ইমার্সন বলেছেন, 'His heart was as great as the world, but there was no room in it to hold the memory of a wrong.' জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ করতে গেলেই কথাটা মনে পড়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয়ে সামান্য অন্যায় অবিচারের ঠাঁই ছিল না। তাঁর সারা অন্তর ছিল অসীম মহত্ব, অবর্ণনীয় নম্রতা-ভদ্রতা, অপরিসীম ভালোবাসা এবং এমনই মানবিক গুণাবলিতে ঠাসা। তাঁর মনজুড়ে ছিল বাংলা ও বাঙালি প্রেম এবং স্বদেশকে মুক্ত করার দুর্জয় সংকল্প।

মৃত্যুকে তুচ্ছ করে ফাঁসির মঞ্চে যিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন, স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর মুক্তির সংগ্রামী সংগীত গেয়েছেন, তাঁর মানবপ্রীতি ও জনদরদের কিছু কিছু স্মৃতি আজ মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে।

বাহাত্তরের কথা। একদিন সকাল ১০টা-১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু পুরনো গণভবনের নিচতলায় বড় কক্ষটিতে বসে কথা বলছেন। আমিও সেখানে ছিলাম। হঠাৎ একজন জানাশোনা মানুষ সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাঁটুতে মাথা রেখে হু-হু করে কাঁদতে লাগল। তিনি তার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন এবং বলছেন, কী হয়েছে বল। সে পরে কান্না থামিয়ে বলল, খানসেনারা আমার থাকার ঘর পুড়িয়ে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর চেহারা বেদনা-মলিন চোখ ছলছল। ধরা গলায় বললেন, অমানুষ দুশমনরা দেশটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে গেছে। এই ছাইভস্ম থেকে আমরা সোনার বাংলা গড়ব। তারপর গৃহনির্মাণ ব্যয় বাবদ তাকে কয়েক হাজার টাকা দেওয়া হয়।

ভাবলাম কবির কথা- নতুন করিয়া গড়িব আমরা ধুলায় তাজমহল। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের ধুলায় তাজমহল গড়ার কঠিন কাজ তাঁর। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর এবার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং নতুন করে দেশ গড়ার সংগ্রাম। বাহাত্তর সালেই একদিন ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়িতে আমরা বসে আছি। বঙ্গবন্ধুও আছেন। এক তরুণী সেখানে এসে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তির কন্যা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন বলে অনেকের ধারণা। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে? তরুণীটি কেঁদে কেঁদে বললেন, তার বাবাকে জেলে নেওয়া হয়েছে। তাকে মেরে ফেলা হবে না তো? বঙ্গবন্ধু বললেন, নিরাপত্তার জন্যই তাকে জেলে নেওয়া হয়েছে তারই অনুরোধে। বাড়িতে তিনি নিরাপদ ছিলেন না। আর বিনাবিচারে কাউকে কোনো দণ্ড দেওয়া হয় না। আমিও কন্যার পিতা। বাবার জন্য তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারি মা। তরুণীটি তার বুকে মাথা রেখে পিতৃস্নেহের স্পর্শ পেয়ে কাঁদল। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিলেন। পরে সে তাকে কদমবুসি করে চলে গেল। বঙ্গবন্ধু বললেন, ভুল স্বীকার করে অনুতপ্ত হলে ক্ষমার বিধান আল্লাহই দিয়েছেন। ঠিকমতো তওবা করে নিষ্পাপ হওয়া যায়।

আরেকদিন পুরোনো গণভবনে সেখানকার স্টাফের একজন বঙ্গবন্ধুর হাতে একখানা কাগজ দিল। তিনি তাতে চোখ বুলিয়ে বললেন, যুদ্ধের সময়ে কেউ কেউ প্রাণের ভয়ে ওদের পক্ষে এবং আমাদের বিপক্ষে কিছু কাজ করেছে। হুমকির মুখে এ রকম হয়ে থাকতে পারে। শত্রুদের নজরবন্দি থেকে তাদের হুকুম অমান্য করতে পারেনি। এখনো যদি বিরুদ্ধাচরণ করে তবে নালিশ করো। ভ্রান্তদের রিক্লেইম করাই তো দণ্ডদানের মূলনীতি। তিনি যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন তার পেছনেও এই যুক্তি, নীতি ও দর্শন কাজ করেছিল। প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করা হয়নি। যারা অতীতের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করে সৎ নাগরিক হিসাবে জীবনযাপনের অঙ্গীকার করবে, কেবল তারাই এই ক্ষমার যোগ্য হবে।

নিয়ন্ত্রণাতীত পরিস্থিতি ও অবস্থার শিকার পথহারাদের ঠিক পথে ফিরে আসার যাচিত সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। যারা এই সুযোগের অপব্যবহার করেছে তারা বিবেকহীন, মনুষ্যত্বহীন অপরাধী এবং কোনো প্রকার ক্ষমার যোগ্য নয়। এতে অপরাধীর দুর্বৃত্ততা প্রমাণিত হয়, ক্ষমাকারীর মহত্ত্ব ক্ষুণ্ন হয় না।

এই একই মানবিকতার প্রকাশ আমরা দেখেছি বাহাত্তরের ১০ই জানুয়ারিতে যেদিন পাকিস্তানের বধ্যভূমি থেকে, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে জাতির পিতা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে এসে তার অশ্রুসিক্ত ভাষণে বলেছিলেন, অনেক রক্তপাত হয়েছে আর রক্ত নয়। তার সেই অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত ভাষণে যে রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও স্টেটসম্যানসুলভ প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া গেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। খন্দকের যুদ্ধ জয়ের পর মহানবি (সা.) বলেছিলেন, এখন মুসলিমদের মতো অমুসলিমদের জানমাল রক্ষা করাও আমার দায়িত্ব।
সেদিন বঙ্গবন্ধু যদি বলতেন তারা আমাদের অনেক রক্ত ঝরিয়েছে। এবার বদলা লও, প্রতিশোধ নাও। তবে তখন বাংলাদেশ রক্তবন্যায় নিমজ্জিত হতো, সারা দেশে দোষী ও নির্দোষের লাশের পাহাড় জমে উঠত। বঙ্গবন্ধুর মতো অত্যুন্নত, মহৎ নেতার কারণেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর মতো আরেকজন মহৎ নেতার অভাবে দেশে এখনো রক্তস্রোত বন্ধ হয়নি। জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্যের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ববোধ না থাকায় শহিদের মিছিল থামছে না। আজীবন বিরুদ্ধশক্তির নিপীড়ন-নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করে বাংলা ও বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য মরণপণ সংগ্রাম করে যিনি দেশকে স্বাধীন করার মহত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেই বঙ্গবন্ধু দেশ ও দেশবাসীকে ভালোবেসে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করেননি। যারা গড়ার কষ্ট করেনি, তাদের এই ভালোবাসা থাকার কথা নয়।

গভীর বিষাদক্লিষ্ট পঁচাত্তর সালে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স নগরে। সেখানে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশও তাতে যোগদান করেছিল। তাঁর অনট্রুজে আমারও থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সম্মেলন উপলক্ষ্যে নির্মিত বিশাল প্রাসাদোপম ভবনটিকে খুব মনোরম সাজে সাজানো হয়েছিল। ভবনের সামনে বিভিন্ন দেশের পতাকার সারিতে সুউচ্চ দণ্ডে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন সেই ভবনের সম্মুখে গাড়ি থেকে নামলেন, তখন স্বাগতিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বুমেদিন, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, কাম্বোডিয়ার প্রিন্স সুহানুক প্রমুখ বিশ্বনেতা যেভাবে তাঁকে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে অভ্যর্থনা জানালেন, তা দেখে সর্বাঙ্গে যে মহানন্দের শিহরণ জেগেছিল তা অবর্ণনীয়, অনির্বচনীয়।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের ষাটোর্ধকাল পেরিয়ে সেই প্রথম স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হওয়ার গর্বে বুক স্ফীত হয়ে উঠেছিল। এই গর্ববোধ ছিল যে, মহান নেতার অশেষ ত্যাগের কারণে বিদেশের মাটিতে তাঁর অভূতপূর্ব সম্মান লাভের দৃশ্য দেখে আমরা অভিভূত হয়েছিলাম।

তারপর একদিন আমরা সুন্দর আলজিয়ার্স শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। ফিরতে বেশ দেরি হয়েছিল। আসলে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে দেশের মাতৃভাষা আরবি, ফরাসি কলোনি ছিল বলে দ্বিতীয় ভাষা ফ্রেঞ্চ। ফ্রেঞ্চ আবার আমাদের কাছে হিব্রু। তাদের কোনো কথাই সহজে বোঝাতে পারছিলাম না। ফলে যথাস্থানে পৌঁছতে দেরি হয়েছিল। ওদিকে রাত বাড়ছে দেখে বঙ্গবন্ধু অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। বারবার খোঁজ নিচ্ছিলেন। ফিরে এসে যখন তাঁর সামনে দাঁড়ালাম, ভয়ে ভয়ে বলা বাহুল্য, তখন তিনি আমার দু’কাঁধে হাত রেখে বললেন, উঃ চিন্তামুক্ত হওয়া গেল। এতক্ষণ যা দুর্ভাবনায় রেখেছিলেন।

সবার জন্য তাঁর চিন্তাভাবনা। সবার কুশলে কুশল মানতেন। জেলখানায় তাঁর জন্য খাবার পাঠাতে হতো মস্তবড়ো টিফিন ক্যারিয়ারে। জেল-সাথীদের ফেলে একা খাবেন না, তাই। একা তিনি অনেক বড়ো হতে পারতেন। এমন চিন্তা মনে ঠাঁই দেননি কখনো। সবার সঙ্গে সবার মাঝে, সবার জন্য তাঁর বাঁচা। তিনি সবার বন্ধু। তিনি বঙ্গবন্ধু।

লেখক: প্রয়াত সাংবাদিক
এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি