ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

কপোতাক্ষ নদের ওপর বাঁশের সাঁকো এখন মরণফাঁদ

কলারোয়া (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ২০:৪২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

কলারোয়ায় কপোতাক্ষ নদের ওপর সেই বাঁশের সাঁকো। ছবি- একুশে টিভি।

কলারোয়ায় কপোতাক্ষ নদের ওপর সেই বাঁশের সাঁকো। ছবি- একুশে টিভি।

দীর্ঘ ৩৭ বছরে সরকারের ব্যাপক পালাবদল হলেও সাতক্ষীরার কলারোয়ায় কপোতাক্ষ নদের ওপর ব্রিজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি স্থানীয়দের। কলারোয়া উপজেলার ত্রিমোহিনী বাজার সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের ওপর ১৯ বছর আগের তৈরি একটি বাঁশের সাঁকো এলাকাবাসীর জন্য এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। জরাজীর্ণ এই বাশের সাঁকোটি যে কোনো সময় ভেঙে প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। 

প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজের জন্য কলারোয়া, মনিরামপুর, কেশবপুর, তালা ও পাটকেলঘাটা উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে ত্রিমোহিনী বাজার সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদ পারাপার হতে হয়। এক সময় স্থানীয়রা নৌকায় করে এই নদী পার হলেও জনসাধারণের সীমাহীন দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ২০০১ সালে  কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের ৯নং ওয়ার্ড বাসিন্দা লেয়াকত আলী জমিদারের উদ্যোগে ২০/২৫ জন মিলে পথচারীদের দুর্ভোগ লাঘবে কপোতাক্ষ নদের ওপর প্রায় ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৭৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এই সাঁকো নির্মাণ করেন। 

সাঁকোটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন বিএনপি দলীয় এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব। এসময় তিনি সাঁকোর জন্য ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেন এবং জনস্বার্থে এই নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রতিও দেন। এরপর দীর্ঘ ১৯ বছরে সরকারের পালাবদল হলেও কপোতাক্ষ নদের ওপর ব্রিজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি স্থানীয়দের। তাই প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়েই এই বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে পারাপার হতে হয় জনসাধারণকে।দীর্ঘদিন পার হলেও স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি এখন পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদের ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ না নেওয়ায় অসন্তুষ্টি বিরাজ করছে জনসাধারণের মাঝে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুটি নির্মিত হলে পাল্টে যেতে পারে তালা-কলারোয়া ও কেশবপুর উপজেলার লোকজনের জীবনযাত্রার মান। 

সরেজমিনে গত শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে দেখা যায়, কপোতাক্ষ নদের ওপর সেতু না থাকায় স্থানীয় কৃষক তাদের উৎপাদিত শাক-সবজি নিয়ে বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন। খোকা, সোহরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, বাবর আলী, হাসেম আলী, তরিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন কৃষক তাদের প্রতিদিনের কষ্টের কথা উল্লেখ করে জানান, সেতু না থাকায় যানবাহনের অভাবে কাঁধে ও মাথায় করে বিভিন্ন প্রকার সবজি, ধান, পাট নিয়ে ত্রিমোহিনী ও কেশবপুর বাজারে যেতে হয় তাদের। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে প্রায় ২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয়। 

স্থানীয়রা জানান, জনস্বার্থে প্রতিবছর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এই বাঁশের সাঁকোটি সংস্কার করা হয়ে থাকে। কপোতাক্ষ নদের ওপর একটি সেতু নির্মিত হলে এখানকার ৫টি উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রার মান পাল্টে যাবে। আর এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আর্কষণের পাশাপাশি সেতু নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও করেছেন স্থানীয়রা। 

এ বিষয়ে ত্রিমোহনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান আনিসুর রহমান বলেন, ত্রিমোহনীর কপোতাক্ষ নদের ওপর ব্রিজ না থাকায় দুই পারের স্কুল ও কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীসহ কয়েক হাজার মানুষের বাঁশের তৈরি এই সাঁকো পারাপারের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ত্রিমোহনীতে তিন থেকে চারটা স্কুল ও কলেজ থাকায় কলারোয়া উপজেলা ও তালা উপজেলার বহু স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের এই বাঁশের সাঁকোই পারাপারের একমাত্র অবলম্বন। কাজেই কপোতাক্ষ নদের ওপর একটি ব্রিজ তৈরি খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। 

তিনি আরও বলেন, ‘আমি বহুবার স্থানীয় এমপি মহোদয়কে বিষয়টি নিয়ে সমাধানের জন্য আলোচনা করেছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত এর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এছাড়াও বিষটি নিয়ে লিখিতভাবেও বহুবার এলজিইডি মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।’

এ ব্যাপারে কেশবপুর উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী বলেন, ত্রিমোহনীর কপোতাক্ষ নদের ওপর ব্রিজ নির্মাণ করা আমার দায়িত্ব নয়। এটা সাতক্ষীরা কলারোয়া ও তালা উপজেলার এলজিইডির প্রকৌশলীদের দেখভাল করার দায়িত রয়েছে। আপনারা ওখানে যোগাযোগ করতে পারেন। 

এদিকে ত্রিমোহনীর কপোতাক্ষ নদের ওপর বাশের সাঁকো নিয়ে শুরু হয়েছে নিয়মিত চাঁদাবাজী। ওখানকার একটি গ্রুপ এ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। মাঝে মধ্যে চাঁদার টাকা তোলা নিয়ে হাতাহাতিও হচ্ছে। 

স্থানীরা জানিয়েছেন, ইউপি সদস্য বাবুর আলী সরদার মধু ও শেখ হাসেম আলীর নেতৃত্বে ওই বাশের সাঁকোয় পারাপারে চাঁদা তোলা হচ্ছে। সরকারি ডাক ছাড়া প্রতিদিন ৪/৫ হাজার টাকা তোলা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যে কোন সময় টাকা তোলা নিয়ে সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারনা। এ বিষয়ে বাবর আলী মধু মেম্বার বলেন, সাঁকো মেরামতের জন্য পয়সা তোলা হচ্ছে। 

তবে এলাকাবাসী এই চাঁদা তোলা বন্ধের দাবি জানিয়ে সাতক্ষীরা ও যশোর জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এদিকে কিছু দিন আগে ওই সাঁকো মেরামতের জন্য কলারোয়া উপজেলা পরিষদ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক নেয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে মাত্র ৮ হাজার টাকার আধা ভাঙ্গা ইট দেয়া হয়েছে সাঁকোর সামনে। বাকি টাকা কোথায় জানতে চাইলে জমিদার লেয়াকাত আলী বলেন, তিনি ৫০ হাজার টাকা থেকে ২১ হাজার টাকা পেয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি সাঁকো মেরামতের জন্য বাশ কিনবেন। বাকী টাকা প্রকল্প কমিটির কাছে আছে। 

এই সাঁকো নির্মাণের উদ্যোক্তা জমিদার লেয়াকাত আলী বলেন, তার দুই ছেলে বিদেশ থাকেন। তিনি নিজ উদ্যোগে এই সাঁকো নির্মাণ করেছেন শুধুমাত্র এলাকার লোকজনের পারাপারের কথা চিন্তা করে। তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন পর্যন্ত এই বাশের সাঁকো মেরামত করে যাবেন জনস্বার্থে। 

এ বিষয়ে দেয়াড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান মফে বলেন, ত্রিমোহিনী বাজার সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের ওপর বাঁশের সাঁকোটি এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। জরাজীর্ণ এই বাশের সাঁকোটি যে কোনো সময় ভেঙে প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। 

তিনি আরো বলেন, ওই সাঁকো পারাপারের সময় অনেকে আহত হয়েছেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আর্কষণের পাশাপাশি সেতু নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান। 

কলারোয়া উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন বলেন, ত্রিমোহনীর কপোতাক্ষ নদের ওপর ব্রিজ নির্মাণ করার বিষয় নিয়ে মাপজোখ করা হয়েছে। কিন্তু যশোর-সাতক্ষীরা এই দুই জেলার রশি টানা টানিতে বাধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। তারপরেও জনগণের চিন্তা মাথায় নিয়ে তালা-কলারোয়ার এমপি এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ ব্রিজ নির্মাণের জন্য ডিও লেটার দিলে আমরা সেটি এলজিইডি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে ব্রিজ নির্মাণের চেষ্টা করবো। 

এ ব্যাপারে তালা-কলারোয়ার এমপি এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, এই বাশের সাঁকোটি হচ্ছে কিছুটা যশোরের কেশবপুরের মধ্যে। সে জন্য দুই জেলার রশি টানা টানিতে বাধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। দুই জেলার সম্মতিতে এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে ত্রিমোহিনী বাজার সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের উপর ব্রিজ নির্মাণ হবে। 

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি