ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

সালাহউদ্দিন সালমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সালাহউদ্দিন সালমান

প্রকাশিত : ২০:৪৯, ১০ জুন ২০২০ | আপডেট: ২০:৫১, ১০ জুন ২০২০

টাইবার নদীর কান্না
অন্তর আত্মার মায়াময় প্রেম ফুরিয়ে গেলে
মানুষ বেঁচে থাকার আশ্বাস খুঁজে নক্ষত্রের কাছে
চাহিদার অভিমুখে প্রভূত প্রতিঘাতে বিলীন হওয়া একটা শতক
বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটুকরো বিন্দু মেলানোর অবনত অজুহাতে
মাথা ঠুকে মরে মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডা দেবাস্তানে।

টাইবার নদীর তীর চতুর্দিকের সাতটি পাহাড়ে এখন বিস্তর ফারাক
মাঝে অগণন লাশের স্তবক নিঃশব্দ রেডিয়াম ডায়ালে শোকের মাতম
রোমান সভ্যতার বুদ্ধিদীপ্ত গতিবিধি প্রাক ইতিহাসের উর্বরতায়
লোম্বার্ডস বাইজান্টাইন্স সান মারিনো ভ্যাটিক্যান সিটিতে
দিনে রাতে এখন কেঁদে কেঁদে ঘুমায় মহা শূন্যের ভূতরে নিস্তব্দতায়।

বহু দুর্গ প্রাচীন প্রতিরক্ষাঘেরা রাইন নদীর বুকে তার অন্তর্গত বেদনা ভাসে
ভেনিস শহরের চাপা কান্না আর ফ্লোরেন্স শহরে আরনো'র হাহাকার
উৎকর্ষের যুগে রোমের শক্তিশালী ইতিহাসে লাশের পর লাশের মিছিল
বিস্ময়ের হিমাংকে থরে থরে শুয়ে আছে সফেদ কাপড়ে ডাকা গলিত মানবদেহ
উঠোনহীন মাটিতে পরে থাকছে অজস্র মায়াবী চোখের অপলক চাহনি
ঘরহীন প্রাগৈতিহাসিক সদর দরজায় কেবল ঝুলে আছে ইতালীয় অহংকার
একঝাক মূক শরণার্থীর চেতনায় বারংবার হানা দিচ্ছে সূর্যচেরা আর্তচিৎকার।    

কোন চৈত্রের গরম সন্ধ্যায় এক মিষ্টি ঠাণ্ডা আবহে তুমি সেরে উঠবে জানি
সভ্যতার প্রাচীন শিল্প মিউজিয়াম ইউফিজি গ্যালারিতে নতুন করে উৎকীর্ণ হবে
আ্যমালফি কোস্ট হল,পোর্টোফিনো সুমদ্র সৈকতে সূর্য অস্ত যাওয়ার ভূদৃশ্য
ছেষট্টির তীব্র বন্যায় আরনো নদীর দুই কূল ভেসে যাওয়া শৈল্পিক স্থাপত্যে
রাস্তার আনাচকানাচে অনবরত এ্যাম্বুলেন্স সাইরেনের শব্দ গির্জার করুণ ঘণ্টা
পিসার হেলানো টাওয়ারের নীরবতা কলোস্যিয়াম হলের অপূর্ণতা একদিন ঘুচে যাবে সহসা,
এইসব বিবদমান দিনরাত্রির করোনাবেষ্টিত মানবসভ্যতার গুরুতর চেহারা।


মানুষ মারা যায়

গ্রিলের বাহিরে পৃথিবীটা কেমন অপরিচিত দেখায় ইদানিং
সমুদ্রের জলে রক্তের রং,নক্ষত্রের শরীরে মৃতের মাংস
পিপাসার নদীতে লাশের গন্ধ চতুর্দিকের এলোমেলো আকাশ
নিঃসঙ্গ বাতাসের বুকে কেবলই কান্নার শব্দ শুনি আজকাল।
আহা সম্পর্ক,ভালোবাসার অটুট বন্ধন,আমরণ জীবনের অংশ
আজ বড়বেশী অসহায়,বড়বেশী দুঃসাধ্য দুর্গম  অপ্রতিরুদ্ধ।

ঘুমের ভিড়ে উদাসী বাউলের সুর শুধুই আর্তনাদ জাগিয়ে দেয় বারংবার
শ্মশানে পুড়া দেহের বৈরি ঘ্রাণ আরেকটা লাশের বাণী শোনায়
রাতে চাঁদের আলোর তলে জোনাকি পোকা হিশেব মিলায় শবযাত্রার
কবরস্থান থেকে মসজিদের মাইকে কেবলই শোক সংবাদ
ক্লান্তির মতন বিচ্ছিন্ন অন্ধকার নুয়ে পরে চতুর্দিকে বেদনায়
ব্যস্তর চেয়েও অধিক অধীরতায় অহেতুক মানুষ মরে যায় দুনিয়ায়
দিক্বিদিক ক্ষমতা পরায়ণের চোখের সন্মুখে শুধু মানুষ মারা যায়।

একটা মৃত্যুর থেকে আরেকটা মৃত্যুর দূরত্ব কয়েক সেকেন্ড মাত্র
একটা সম্পর্ক থেকে বিচ্ছেদের দূরত্ব কতিপয় পলক মাত্র
শীতের শেষে হেমন্ত,হেমন্ত শেষে এই বসন্তের খুশগল্প এখন স্মৃতিমাত্র
তবুও চোখজুড়ে কার্তিকের নীল কুয়াশায় অনাগত ভবিষতের স্বপ্ন
একদিন কেটে যাবে সন্ধ্যার ধূসর অন্ধকার,গণবিচ্ছিন্ন ভালোবাসার বসবাস
অবিনশ্বর প্রেমে আমরা আবার একত্রিত হবো সম্পর্কের উদ্দীপনে
অসীম আলোর বলয়ে পূর্বদিগন্তে উদয় হবে নব সূর্যের উদ্ভাস,
উত্তেজিত মহামারির এই মরন জিজ্ঞাসা সৃষ্টিকর্তার কৃপায়
একদিন ঠিক ঠিক মানবসভ্যতার কাছে হবেই ভুষ্টিনাশ।


করোনা

একটা হাঁচি একটু কাশি শরীরের অল্প তাপমাত্রাতেই
মুহূর্তে পর করে দিচ্ছে
জনম জনমের বন্ধনে 
আবদ্ধ হয়ে থাকার মানুষগুলোকে।

পাশাপাশি অথচ চিরশত্রুর চেয়ে দূরত্ব
চাইলেই স্পর্শ করা যাচ্ছেনা কাউকে
কেমন বিনা নোটিশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে একেকজন
এক রাষ্ট্র থেকে আরেক রাষ্ট্র।

একদিনের সঙ্গে মিল খোঁজে পাচ্ছেনা অন্যদিনের
সপ্তাহ থেকে মাসের দূরত্ব বাড়ছে ব্যাপক সংক্রমণে
এই গৃহবন্দী,দুটি দেহের মাঝখানের কোলবালিশের গল্প
অল্প অল্প করেই করোনা'র রাজ রাজত্বে দীর্ঘ হচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন।


সমীকরণের নামে বিভাজন

খুব ভীষণ একলা লাগে,প্রচণ্ডরকম একা
চারদিক সুনসান জনমানবহীন বিদঘুটে এক পরিবেশ
যেদিকে তাকাই কি নিদারুণ অভিমান অবহেলা চোখ রাঙায়
কোন আলো আলোকিত করার নামমাত্র নেই,কেবলই সন্ধ্যে
প্রেমহীন গল্পের আবছা আঁধার জটবাঁধা গভীর ষড়যন্ত্রের এ শহর
দুহাত চেপে আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়,গুমরে কাঁদায়।

সহস্র সময়ের উলঙ্গ জমিনে লাস্যময়ী আত্মহত্যার কিচ্ছা কাহানী
নরাধমের ধর্ষণপ্রবণ শিশ্নের উপর কাকধার্মিক রাষ্ট্রে মূকবধির আমি
আতঙ্কে অতিষ্ঠ রক্তপাতের কান্নায় নিরুপায় রাষ্ট্রযন্ত্রে দেখেও কিছু দেখিনা
ঘরে ঘরে শালিকের বুকে সাদা পালকে করে নবান্নের ধান আসে
ক্ষেতের আলপথ ধরে শ্রাবণ ধারা ভিজিয়ে যায় শিশিরে উড়ে ছোট্ট ঘাসফড়িং
দুঃখে ক্ষোভে অসুখী উড়ান আমার,আমাকে ব্যাবচ্ছেদ করে সমীকরণের নামে বিভাজনে।

অনিবার্য নয় তবুও গরমিলের মিলন খুঁজতে গিয়ে শব্দের আবডালে খুঁজি শব্দ
ছায়ার আড়ালে ছায়া,যাবতীয় নির্ভুলের নয়নে নামে গোপন মেঘের জলোচ্ছ্বাস
বহুরাতের ঘুম হারানো চোখে নিশাচর বাতাস দিয়ে যায় নিকোটিননিশির ঘ্রাণ
নিঃশব্দ চৌকাঠে পরজীবী গাছের লতায় নিঃশব্দে হই নিষ্প্রাণ।


নির্জলা

আঁধার আর আলোর সংঘর্ষে
এক অপরিচিত ঘোরের ভিতরে বেড়ে উঠি
আমার সাথে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হয় স্মৃতিচারণবিদ্যা।

ধলেশ্বরীর জল ঘোলা হবার আগেই
যৌবনবতী বেদনাবীর্যে দখল হয় প্রবহমান নদী
পালিয়ে যেতে যেতে শান্তিকামীর ভিতরে জাগে
ভারবাহী অতন্ত্র নিঃসঙ্গতা জমানো নিবিষ্ট এক স্থাণু চরাচর।

রাত্রির আগুনে পুড়ে ছারখার হওয়া
দিনের অভিমানে পরিপুষ্ট হয় চোখে মেঘের বেলা
মাথার তালু থেকে নাভিমূল অতপর পায়ের তলা
তুমি ছাড়া সব থাকে নিরব নিস্তব্দ একেবারে নির্জলা।


বেঁচে থাকা কারে কয়

আমি এই আমার দেশ তথা দুনিয়া
অবশেষ সারা জাহানের কেউ আমার ব্যক্তিগত নয়, কেউ আপন নয়
খরতাপের রোদমাখা দুপুরের খা খা শূন্যতা বিকেলের বিষণ্ণতা
অঘ্রাণের ম্লান এই পরিবেশ আহা বিতৃষ্ণ এই আটপৌরে জীবন
কোথাও যেনো নিজের বলতে কিছুই নেই বিদঘুটে অপার হাহাকার ছাড়া।

সম্পর্কে সম্পর্ক মেকীপনার এক অদ্ভুত অনাটনে মোড়া
অভুক্ত কাতর একটি দেহ আরেকটি দেহের লোভে প্রায় ম্রিয়মাণ
স্বার্থের উর্ধ্বে স্বার্থ যেখানে অবিচল নির্ভেজাল ভালোবাসা সেখানে অচল।
কোথাও তিলকদণ্ড রোমাঞ্চ নেই আনাচে কানাচে প্রচুর নীরবতা
অপরিসীম আকাশ যেখানে বিছিয়ে আছে তার শ্যামল সুস্নিগ্ধময় শীতল ছায়া
পৃথিবীময় মানবসভ্যতা সেখানে ছিটিয়ে রেখেছে পারমাণবিক মরনাস্ত্রের পসরা।

মরচেপড়া সন্ধ্যার রঙ সূর্যের শরীরঘেঁষা স্থির মেঘে যৎকিঞ্চিৎ ভরাবয়
নক্ষত্রের রক্তমাখা আহূতিতে কে যেনো সেটে দিয়েছে যন্ত্রনার ছয়নয়
মানুষ জ্যান্ত গিলে খাচ্ছে মানুষেরে,চতুর্দিকে মানসিক মুখে হায়েনার প্রতিমুখ
নগরীজুড়ে শৃঙ্খলতার বালাই নেই ভাঙাচোরা উশৃংখল পৃথিবীতে স্বয়ংঈশ্বর বিমূখ।
অতপর এই আমি আমার দেশ তথা দুনিয়াতে কেউ আমার ব্যক্তিগত আপন নয়
চোখের জলে ভিজে বামবুকের উৎকণ্ঠায় ধিকিধিকি মরে যাওয়াকে বেঁচে থাকা কয়।


প্রণয়ের প্রদীপ

এইসব ফিকে সময়ের অন্তরালে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা বড্ড নিদারুণ
উপচে পড়া কথাগুলো বুকে জমে জমে কবর হয়ে যাচ্ছে দিনমান
ভাষা আছে চির অম্লান অথচ বলার মাধ্যম নেই বলে সে মৃতপ্রায়।

ঠোঁটের সঙ্গম বুঝিনা তাই অপারঙ্গম বোকাবুড়ো হয়ে আছি
আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুলের সংখ্যা হিসেবেই অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে মহাকাল
অথচ দুঃখবোধ অনুভব করার জন্য যে ঘরে তোমার থাকার কথা ছিলো পাশাপাশি
সে ঘরে আমি আজ অনেকদিন যাবত গৃহবন্দী হয়ে আছি একাকী।

ক্ষতের ভেতরে কঠিন অন্যমনস্কা হয়ে আছে অযুত লক্ষ নিযুত ক্ষতবিক্ষত
ধোঁয়ার ভেতরে বন্দী হয়ে আছে কাঁচের নিঃসীম অন্ধকার আমাদের স্মৃতিযত
বিশ্বাসের দোহাই নেই অস্বীকার করা ভালোবাসার অবহেলা যেখানে চিরসজীব
নীরব প্রার্থনার কাছে হৃদয়ের পেটে জ্বেলে রেখেছি তোমার আমার প্রণয়ের প্রদীপ।


না ফেরার দেশগামী মানুষ

অতল শ্রদ্ধা ও বিদায়ী অভিবাদন দিয়ে দিলে অনায়াসে
অথচ এখনো প্রস্থান হয়নি সেভাবে
বিবেচনায় নিয়ে নিলে জীবনের সামগ্রীক যোদ্ধা হিসেবে
প্রতিশ্রুতিশীল হওয়াটা জন্মগতভাবে আক্রান্ত করেছে ভালোর দিকে
হয়তো এটাই ছিলো জীবদ্দশায় আমার আমৃত্যু ভুল সিদ্ধান্ত।

একজায়গায় থমকে যেতে হবে বলে এই সাময়িক চলে যাওয়া
তোমাকে হার মানানোর আরাধনায় ছিলাম না কোনদিন
বিন্দুমাত্র ভালোবাসতে ভুলিনি গুরুত্ব দিয়েছি অনাবিল
তোমার সাথেই ছিলো আমার সর্বাধিক দুর্বল সময়ের টানাপোড়েন
আর এটাই আমার পরবর্তী জীবনে নিঃশ্বাস নেওয়ার একমাত্র অবলম্বন।

বেঁচে থাকাকালীন সাধারণের মধ্যে তুমি ছিলে অসাধারণ
তীব্র সুখে হালকা বেদনার অনুভূত হতো তোমার ভেঙে পড়ার কারণে।
অথচ ভেঙে পড়তে খুব তাড়া ছিলো তোমার
অসুখময় এই পৃথিবী ছেড়ে আমার সাথে যেতে।

অপসৃয়মান দৃশ্যের মতো
স্থির মন্ত্রবলের অতর্কিত এক শিল্পের নাম মৃত্যু
যেটা মায়াবী আলোয় ভাসে মরণময় জীর্ণশীর্ণ ক্রীতদাসীচোখে
গভীর মমতা দিয়ে যা আগলে নিয়ে যায় দূরে বহুদূরে
অমনোযোগ কিংবা তুচ্ছ অবহেলায় অথবা নিদারুণ ভালোবাসাতেও
ফেরানো যায়না না ফেরার দেশগামী মানুষ কে।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি