ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মুখর সময়ের সমাপ্তি, বিদায়ের পালা শুরু

প্রকাশিত : ১৭:৪৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৯:২৪, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রথম আলোর প্রতিবেদক রাজীব আহমেদ ও একুশে টেলিভিশনের সদ্য প্রয়াত সিনিয়র রিপোর্টার মামুনুর রশীদ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রতিনিয়ত দুষ্টুমি, খুনসুটি, হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকতেন। মজার মানুষ মামুন হাস্য রসিক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবন সবসময়ই তিনি অন্যকে মজা দিয়ে নিজে মজা পেতেন। 

রাজীব আহমেদ মামুনকে নিয়ে ফেসবুকে একটি স্মৃতিচারণমূলক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এতে তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাদের বন্ধুত্বমূলক নানা হাস্যরসাত্বক ঘটনা। ইটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

সিতারা পারভীন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক) : মামুন বলোতো, বদরুদ্দিন উমর কে?
মামুন: ম্যাডাম, উনি বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন।
সিতারা পারভীন: মামুন, তুমি আগামী ক্লাসে বদরুদ্দিন উমরের ওপর তিন পাতা লিখে নিয়ে আসবে। এটা তোমার অ্যাসাইনমেন্ট।

পরীক্ষার হলে আইফোন টেবিলে রাখার সময়
ফাহমিদুল হক(বিভাগীয় শিক্ষক): মামুন, তুমি আইফোন কিনেছ?
মামুন : জিঁ স্যার।
আমি: (পেছন থেকে) স্যার, ওটা চীনা আইফোন। ৩ হাজার টাকা কিনেছে।
মামুন: স্যার, ও আমার শত্রু। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়।

পরিসংখ্যান পরীক্ষার তিন মাস আগে মামুন মনোযোগী ছাত্র। পরিসংখ্যান বিভাগের এক বড় ভাইয়ের কাছে প্রাইভেট পড়ছে। আমরা ইমপ্রুভমেন্ট রাখার পরিকল্পনার পরও তিন দিন আগে মামুনের কাছে পড়া শুরু করলাম। মামুন শিক্ষক, আমরা মনোযোগী ছাত্র। পরীক্ষায় আমরা ভালোভাবেই উতরে গেলাম। মামুন ইমপ্রুভমেন্ট রাখল।

নতুন জুতা কিনে মামুন বিভাগে
আমি : কিরে, জুতা কত নেছে?
মামুন : সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।
আমি : চাপা মারস।
মামুন : পাঁচ হাজার টাকা নিছে।
আমি : কানারে হাইকোর্ট দেখাও।
মামুন : সাড়ে চাইর হাজার টাকা নিছে।
আমি : এই জুতার দাম এক হাজার টাকাও না।
মামুন : সাড়ে তিন হাজার টাকা নিছে। আর কমাইতে পারমু না। কসম।

লম্বা স্টেপের একটি শার্ট পড়ে মামুন বিভাগে
আমি: কিরে, শার্ট কি জাজিমের কভার কাইটা বানাইছস?
মামুন: এত ভালো শার্ট জীবনে দেখছস।
নবীন: আমার বাসায় এই কাপড়ের একটা জাজিম আছে।

বঙ্গবন্ধু হলে আমি, রাকিব আর নাজমুল; কবি জসিম উদ্দীন হলে রিয়াদ, সোহেল, গুড্ডু, আনু; সূর্যসেন হলে নবীন; মুহসীন হলের রোকন এবং হলের বাইরে একমাত্র মামুন। আমাদের সময়গুলো মুখরিত ছিল। সবাইকে হাসাতো মামুন। আমরা বলতাম লুই।

বঙ্গবন্ধু হলের ৪০২ নম্বর রুম। তখন রাত ৮টা। তৌহিদুজ্জামান ওরফে গুড্ডুর সব পড়া শেষ। রাকিব এখনও হলে ফেরেনি। নবীন আজিমপুরে কাউকে পড়া বুঝিয়ে দিতে গেছে। নাজমুল বিপুল পরিমাণ নোট নিয়ে রাত ১২টায় এসে সারারাত পড়ার ঘোষণা দিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে আরেকজনের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। মামুন কোনো নোটিশ ছাড়াই ব্যাগ নিয়ে হলে উপস্থিত। সঙ্গে নিম্নমানের কিছু নোট। সব শাহাদাত হোসেনের লেখা। শাহাদাত হোসেন এত নিম্নমানের নোট লিখে রেজা ভাইয়ের কাছে দিয়ে গেছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে বিভাগের শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ করেছে।
মামুন শাহাদাত হোসেনের নোট নিয়ে এসে ব্যাপক ভাব নিচ্ছে।
রিয়াদ: লুই, তুই রুম থেইকা বাইর হ। তোরে হলে আইতে কইছে কে?
মামুন: (ব্যাগ নিয়ে ফ্লোর থেকে বিছানায় উঠে বসে) আমার ঠাণ্ডা। আমি নিচে শুইতে পারুম না। তোরা নিচে শো।

মানুষের জীবনে যদি কোনো সোনালি সময় থাকে, আমাদের সেটা ছিল হলের জীবন। আমরা একে অপরকে পচাইতাম, বিচার বসাইতাম, বিচারে সাজা হইত, তা কার্যকর হইত। আমাদের সুদিন, আমাদের অনটন, আমাদের নোট, আমাদের জামাকাপড়, একটি শলাকা-সব কিছু ভাগাভাগি হইত। আমরা এসেছিলাম বিভিন্ন জেলা থেকে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না, সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল আত্মার সঙ্গে আত্মার-এক সময় আমরা জানলাম, আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শও একই। এর মধ্যে মামুন আমাদের যতটুকু আনন্দ দিয়েছে, তার সমপরিমাণ দিতে পেরেছে কেবল গুড্ডু।

পেশাজীবনে নাজমুল যমুনা টিভিতে, রাকিব জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রিয়াদ ও আমি প্রথম আলোতে। সোহেল সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্র্যাকে যোগ দিয়েছে। তৌহিদ প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে। আনু আত্মকর্মসংস্থানে। নবীন প্রশাসন ক্যাডারে। রোকন এনটিভিতে। মামুন ছিল একুশে টিভিতে।

বহু বছর আগেই আমাদের মুখরিত সময় সমাপ্ত হয়েছে। বিদায়ের পালা শুরু হলো ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তে। জন্মদিনে বন্ধুর মৃতদেহকে শেষ বিদায় জানালাম। আমার বন্ধু, আমাদের বন্ধু মামুন।

বেঁচে থাকা মানে মৃত্যুর অপেক্ষা। অপেক্ষার শেষে সবকিছু শেষ। বন্ধু, আমরাও আসছি।


লেখক: প্রথম আলোতে কর্মরত সাংবাদিক। লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া স্মৃতিচারণমূলক লেখা।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি