ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

একজন অভিভাবকের কথা

কাওসার মাহমুদ

প্রকাশিত : ১৪:৫২, ২৬ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৪:৫৪, ২৬ জুলাই ২০২১

সায়মন ড্রিং-এর সঙ্গে লেখক কাওসার মাহমুদ

সায়মন ড্রিং-এর সঙ্গে লেখক কাওসার মাহমুদ

গেলো ১৬ জুলাই আকস্মিকভাবে একুশে টিভির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশের প্রকৃতবন্ধু-আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক সায়মন ড্রিং পঁচাত্তর বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সায়মন একুশে টিভির মাধ্যমে তৈরি করেছেন একদল দক্ষ তারকা সাংবাদিক। সেই সময় একুশে টিভির জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক-প্রযোজক কাওসার মাহমুদ স্মরণ করেছেন এক অন্যরকম সায়মনকে… 

২০০২ সালের আগস্টের শেষ দিন। সকাল থেকে একুশে টিভির সংবাদ বিভাগের কর্মীরা একে একে সমবেত হচ্ছেন। একদা প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর নিউজরুম কেমন যেন শীতল হয়ে আছে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে থাকা তরুণ সংবাদকর্মীদের চেহারা বেদনায় মলিন। আদালতের নির্দেশে গতকাল সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়- প্রাণপ্রিয় একুশে টিভির। সবার ভেতরে অজানা আশংকা। সামনে কি হবে? সকাল ১১টার দিকে ছ’ফুট দীর্ঘদেহী সায়মন ড্রিং, একুশে টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিরচেনা ভঙ্গিতে নিউজরুম কোঅর্ডিনেটর জামানকে খুঁজছেন।

জামানের টেবিলে এসে ফিসফিস করে কিছু একটা বলছেন। আমরা উৎসুক হয়ে ভাবছি, নিশ্চয়ই আমাদের জন্য কিছু বার্তা আছে। কথা শেষ করে সায়মন আবার চিরচেনা হাসি দিয়ে নিজ দপ্তরে গেলেন।

জামান প্লানিং এডিটর এস এম আকাশকে ডেকে পাসপোর্ট আর কি যেন সব কাগজপত্র চাইলেন। বিস্তারিত জেনে আমরা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। প্লানিং এডিটর এস এম আকাশ আর ভানুরঞ্জন চক্রবর্তীর কদিন পরেই একটি সংবাদ কর্মশালায় যোগ দিতে শ্রীলঙ্কা যাবার কথা। এতে যাতে কোনরকম অসুবিধার সৃষ্টি না হয় তার জন্য জামানকে অনুরোধ এবং নির্দেশ দিয়েছেন সায়মন। পরবর্তীতে জেনেছি, শেষ মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানের চরম সংকটের মাঝেও সায়মন ব্যক্তিগতভাবে দুজনের জন্য পকেটমানির ব্যবস্থা করেছেন। এরকম অসংখ্য ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে সেসময়ের একুশে টিভির প্রতি বিভাগে। সায়মন আমাদের কাছে শুধু পদবীসর্বস্ব অভিভাবক ছিলেন না। সকল সংকটে অগ্রগামী নেতা হয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলেছেন। পরম আদর আর স্নেহ নিয়ে কোন পেশাদার প্রতিষ্ঠানে এরকম পিতৃতুল্য অভিভাবকের দৃষ্টান্ত আমি আজও শুনিনি। শুরুর দিন থেকে একুশে টিভির শেষ দিন পর্যন্ত কি করে একজন মানুষ অকাতরে ক্লান্তিহীনভাবে টীমের ছোট বড় সবাইকে ভালবাসায় জড়িয়ে রাখতে পারে তা কখনো বুজতে পারিনি।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ানো সায়মনের পেশা জীবনের নানা গল্প অনেকেই জানে। আমরা জানি একজন নিবেদিত আইডিয়াম্যান এর কথা। একজন নির্ভরযোগ্য অভিভাবকের কথা। কাজের সূত্রে সায়মনের সাথে রকমারি অভিজ্ঞতা অনেক বেশি প্রকাশিত হওয়া দরকার। এই অভিজ্ঞতার বিবরণ চলমান টিভি সংকটে পাথেয় হিসাবে কাজ করবে। এতো জৌলুসের ভেতরে কাজ করেও কেন টিভিগুলো জ্বলে উঠতে পারেনি। নেতৃত্বের সংকটে টিভিগুলোতে কেন যোগ্য ক্যাপ্টেন নেই? এসব প্রশ্নের উত্তর সায়মন অনেক আগেই হাতে কলমে দিয়ে গেছেন।

আড্ডায় সায়মন ড্রিং

সায়মনের কাজের ধরনই ছিল আলাদা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিউজ বুলেটিন শেষ হলে আবশ্যিকভাবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মিটিং এ হাজির হতে হত। দুরু দুরু বুকে আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে থাকতাম, সায়মন কখন মুখ খুলবে। সায়মন শুরুতেই একেবারে ব্রিটিশ কায়দায় সদ্য শেষ হওয়া বুলেটিনের প্রশংসা করতেন। ওয়েল ডান বলে খুব মিহিসুরে “বাট” বলে একটু বিরতি দিতেন। এরপর একে একে নোটবুক দেখে বুলেটিনের পোস্টমরটেম করতেন। ভালোর সাথে কোথায় একটু মনোযোগ দিলে আরও ভাল করা যায় তার নির্দেশনা দিতেন। আমরাও এভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে পরিণত হতাম। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম, বাংলা না জেনেও সায়মন কি করে রিপোর্ট বা উপস্থাপনার ভুল ধরতেন। আসলে সায়মন বলতে না পারলেও বাংলা বুঝতেন। বাংলা আর বাংলাদেশের সাথে সায়মনের নিবিড় সম্পর্কতো যে দীর্ঘকাল থেকে একথা আমাদের মনে থাকতো না। একারণেই কি শেষদিন পর্যন্ত সায়মন তাঁর ফেসবুক পেইজে প্রোফাইল ছবি হিসাবে চিরায়ত বাংলার ছবি ব্যবহার করেছেন?

একজন ভিনদেশের মানুষ হলেও সায়মন এদেশের সংস্কৃতি আর মানুষদের হৃদস্পন্দন বুজতেন। সন্ধ্যার নিউজ বুলেটিন যখন দর্শক নন্দিত, তখন একইদিনে আরেকটা নিউজ বুলেটিনের অনিবার্যতার সমর্থন অনেকেই দেননি। আসলে সেসময়ে মানুষের জীবনধারা অনুযায়ী আমরা অধিকাংশজন বললাম, দ্বিতীয় নিউজ দর্শক পাবেনা। কিন্তু সায়মন অনড়, দ্বিতীয় নিউজ দর্শক অপার আগ্রহ নিয়ে দেখবে। সেসময়ের হিসাবে সবচে অফপিক টাইম রাত ১১ টায় যখন দ্বিতীয় বুলেটিন শুরু হলে আমরা ভুল প্রমাণিত হলাম।

এরকম অসংখ্য ধারণা ভুল প্রমাণ করে সায়মন দর্শক তো বটেই আমাদেরকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছেন। প্রতিদিনকার দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে মেতে থাকতেন সায়মন। টীমের প্রত্যেক সদস্যের শক্তি আর সীমাবদ্ধতা খুব ভাল করে বুঝতেন। ঝুঁকি নিতে পছন্দ করতেন। আমার ঘটনাই বলি। বিবিসির ট্রেনিং শেষে নিউজরুম এডিটর হিসাবে ডেস্কে কাজ করছি। অনেকের সাথে প্রতি ঘণ্টার মিনি বুলেটিন পড়ি। পাঁচ মিনিটের বুলেটিন। সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে তখন সামিয়া জামান এবং সামিয়া রহমান প্রাইম বুলেটিন উপস্থাপনা করেন। সন্ধ্যার প্রাইম বুলেটিন তখন দর্শকদের কাছে টপচার্ট। শুরুর মাস ছয়েক এভাবেই চলছে।

আমি একদিন একেবারে ক্যাজুয়াল পোশাকে অফডেতে দুপুরের দিকে অফিসে গেছি। ক্যান্টিনে আড্ডা মেরে নিউজরুমে ঢুকতেই সায়মনের মুখোমুখি। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, আজকে তোমাকে প্রাইম বুলেটিন পড়তে হবে। সায়মনের রসিকতা আমার পরিচিত। আমিও হাসি দিয়ে বললাম, কবে থেকে? সায়মন প্রতি উত্তরে বললেন, আজই। একটু পরে। সামিয়া জামান কলকাতা থেকে ফিরতে পারেনি। সামিয়া রহমান অসুস্থ। অতএব বাড়ি যাও। রেডি হয়ে আসো। একথা শুনে খুশির বদলে আমার ভেতর অজানা ভয় চেপে বসলো। পাঁচ মিনিটের পিচ্চি বুলেটিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রাইম বুলেটিন! তবুও সায়মন আমার ভেতরে সাহস ঢুকিয়ে দিলেন। বাসা থেকে রেডি হয়ে আসলে সায়মন আমার হলুদ সার্টের সাথে টাই পছন্দ করলেন না। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, নীচে তাঁর চেম্বার থেকে টাই এনে আমার গলায় বাঁধলেন। যেন পিতা পুত্রকে স্কুলের প্রথম যাত্রা উপলক্ষ্যে সাজিয়ে দিচ্ছেন। রান অর্ডার হাতে নিয়ে আমাকে শুধু বললেন, তোমার হাতে আজকে সবার পরিশ্রমের ফসল। ঘাবড়াবে না। আমার বিশ্বাস, তুমি পারবে। পাহাড় সমান চাপ নিয়ে ঢুকলাম স্টুডিওতে। কিভাবে ৩০ মিনিট পেরিয়ে গেলো জানিনা। বের হতেই দেখি সায়মন কয়েকজন সহকর্মীসহ দাঁড়িয়ে আছেন। “অয়েল ডান, মাই সান” বলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এমনি করে একজন পিতার মতো পরম মমতায় আমাদের একটু একটু করে ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, উসকে দিয়েছিলেন সায়মন। তাই সায়মন এখনো আমার কাছে, আমাদের কাছে দোসর পিতা হিসাবে হৃদয়ে আছেন। 

শুধু একুশে টিভির পরিবার নয়, বাংলাদেশের বেসরকারি টিভির ইতিহাসে সায়মন ড্রিং, একজন ম্যাজিশিয়ানের নাম। যার জাদুকরী অনুপ্রেরণায় অনেক তরুণ আজও নতুন নতুন কন্টেন্ট তৈরির স্বপ্ন দেখে। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের জন্য সায়মনের সাহস, নতুন নতুন আইডিয়া দিয়ে মানুষের গল্প বলার চেষ্টা যদি কোন তারুণ্যকে অনুপ্রাণিত করে তাহলেই সায়মন সরব থাকবেন আমাদের মাঝে।

(কাওসার মাহমুদঃ নির্মাতা ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।)

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি